৮ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ৬:৪৩

ইসলাম ও বাংলাদেশের রাজনীতি: একটি সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ

-প্রফেসর আবদুল লতিফ মাসুম

বিগত ৭ জানুয়ারির অবৈধ ডামি নির্বাচনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি স্থবিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। তথাকথিত বিজয়ী আওয়ামী লীগ নতুন করে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে শুরু করেছে। নতুন বোতলে পুরনো মদ পরিবেশনের রাজনৈতিক আয়োজন সমাপ্ত প্রায়। মন্ত্রিসভা নাকি আরও সম্প্রসারিত হবে। শাসকদল প্রয়াসী ৪০ দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। সে প্রেক্ষিতে আরও বেশিদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও শুভ সূচনার কোনো লক্ষণ পরিদৃষ্ট হচ্ছে না। রাজনীতিতে নির্বাচনের পূর্বাপর নিপীড়ন-নির্যাতনের যে মহড়া চলছিল, তা অব্যাহত রয়েছে। অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুভঙ্করের ফাঁকির আয়োজন করলেও রিজার্ভ বাড়ছে না। সবচেয়ে কষ্টের কথা, দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার বেপরোয়া দৌড় সমানতালে এগিয়েই চলছে। নতুন সরকারের মন্ত্রীরা লম্ফ-ঝম্প দেয়ার পরও কোথাও কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। কথিত আওয়ামী লীগের সেই পুরনো সিন্ডিকেট নতুন গতিতে আবারও মানুষের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে। রাজনীতিতে এই যে দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে- লুটপাট ও দুর্নীতির অর্থনীতি কায়েম হয়েছে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে যে নৈতিকতার বিপর্যয় ঘটেছে তার প্রেক্ষাপট নিকট অতীতের।

২০০০ সালের মধ্যভাগ থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বাঁকপরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নিয়ে যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়, তার সমাপ্তি ঘটে একটি হিংসাত্মক অঘটনের মাধ্যমে। এ বছরের ২৮ অক্টোবর রাজপথে লগি-বৈঠার তাণ্ডব ঘটে। বিরোধীদল আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াত জোটকে পরাভূত করার জন্য রাজনৈতিক পন্থার পরিবর্তে সাংঘর্ষিক পথ বেছে নেয়। ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারও যথার্থভাবে একটি রাজনৈতিক সমাধানে আসতে ব্যর্থ হয়। এ অরাজকতা ও অস্থিরতার পথ ধরে সেনাবাহিনী সমর্থিত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েম হয়। সংবিধানে সংযোজিত তত্ত্বাধায়কের ফর্মুলা অনুযায়ী তিন মাস থাকার কথা, কিন্তু শক্তির সমর্থনে তাদের শাসন দীর্ঘায়িত হয় দু’বছর। দৃশ্যমানভাবে এটি মনে হতে পারে ক্ষমতার রদবদল মাত্র। কিন্তু এ পর্যন্ত প্রাপ্ত গবেষণা ও প্রকাশিত স্মৃতিকথায় প্রমাণ হয় যে, এটির উৎসমূলে ছিল একটি বড় ধরনের ষড়যন্ত্র। দূরের সাম্রাজ্যবাদ এবং কাছের সম্প্রসারণবাদ তাদের বৈশ্বিক নিরাপত্তা এবং জাতীয় স্বার্থে একমত হয় যে, বাংলাদেশে চলমান বিএনপি-জামায়াত সরকারকে আর ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া যায় না। স্বাভাবিকভাবে কোনো সেনা অভ্যুত্থান বা সেনা শাসনকে স্বাগত জানানোর কথা নয়। কিন্তু তারা অস্বাভাবিক পথে ১/১১ ঘটনাবলীকে স্বাগত জানায়। ভারতীয় গবেষণা জার্নালে সেনাসমর্থিত সরকারকে ‘গণতন্ত্রের পরিচর্যাকারী’ বলে পরিচয় দেওয়া হয়। ‘ইয়াজউদ্দিন-ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন’ এ ত্রয়ী দু’বছরে গোপনে এবং প্রকাশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; বিশেষত ভারতের সাথে এমনসব চুক্তি ও সমঝোতায় পৌঁছে, যা হয়ে দাঁড়ায় ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের গতিপথ নির্ধারণের নিয়ামক। ১/১১ এর সরকারের নির্দেশিত ব্যতিক্রমী নির্বাচনে (ইয়াহইয়া আখতার : ২০০৯ : ৩৬৭) বিএনপি-জামায়াত সরকারের ভরাডুবি ঘটে।
১৯৯৬ সালে তারা রাজনৈতিক বিভাজনে ক্ষমতাসীন হয়। দূরের সা¤্রাজ্যবাদ এবং নিকটের সম্প্রসারণবাদ পরবর্তীকালে একই সমীকরণসূত্রে গ্রথিত হয়। রাজনীতির আকাশ-বাতাসের অনুযোগ অভিযোগে প্রতিবেশী অভিযুক্ত হয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, সম্পর্ক বিন্যাসের অপ্রকাশ্য বিষয় থাকা অস্বাভাবিক নয়। সম্ভবত ভারতীয় এজেন্সিগুলো বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অতিরঞ্জিত তথ্য দেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিএনপি-জামায়াতের সময়কালে ভারতের রাষ্ট্রপতি মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশ সফর করেন, তখন ২৫ শতাংশ লোক বাংলাদেশে জামায়াত করে এরকম অসত্য তথ্য দেওয়া হয়। তখন পাশ্চাত্যের তরফ থেকে আরও তথ্য দেওয়া হয় যে, আফগানিস্তানের পরে ইসলামী সরকারের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। রাজপথে স্লোগান দেওয়া হয় ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। এটি মার্কিনীদের তাড়িত করে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থনে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিরোধীদল আওয়ামী লীগ এবং ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীরা তাদের লেখনী, গবেষণা ও তথ্য-উপাত্ত দিয়ে পাশ্চাত্যকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হনÑবাংলাদেশে সত্যি সত্যিই তালেবান বিপ্লব ঘটবে। এর আগে বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বা সম্ভাব্য ইসলামী বিপ্লবের ক্ষেত্রভূমি প্রমাণ করার জন্য তারা চৌষট্টি জেলার তেষট্টিটিতে পটকা ফোটায়। এ পটকাকে বিরোধী গণমাধ্যম রূপরস গন্ধ দিয়ে পারলে ‘পারমাণবিক বোমা’ বানায়। বিদেশী এজেন্সিগুলো দু-একটি সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটায়। যখন বাংলাদেশ পুলিশ বলছে, তাদের দেশে সন্ত্রাসী নেই, তখন মিডিয়া বলছে অন্যকথা। বাস্তবতা এই যে, প্রধান ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে কওমি ঘরানার ধারণা ভালো নয়। মাজার ও পীরপন্থীরাও তাদের বিপরীত। বিদেশী এজেন্সিগুলোর প্রত্যক্ষ অর্থে এবং পরোক্ষ তৎপরতায় জামায়াতবিরোধী সকল ইসলামী দল ও গ্রুপকে একত্রিত করা হয়। গঠিত হয় তরীকত ফেডারেশন এবং ইসলামী মোর্চা। বিএনপি-জামায়াতবিরোধী দেশী-বিদেশী শক্তিগুলো আরও একটি কৌশল অবলম্বন করে। ঠা-া যুদ্ধের সময় মার্কিনীরা সমাজতন্ত্রকে ঠেকানোর জন্য সমাজতন্ত্রকেই ব্যবহার করে। এ কৌশল ‘এ রেড ফ্লাগ অপোজ টু এ রেড ফ্লাগ’ বলে কথিত। সমাজতন্ত্রের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করার জন্য সমাজতান্ত্রিক শক্তির একটিকে এমন চরমভাবে উপস্থাপন করা হয় যে, তারাই আসল সমাজতন্ত্র কায়েমে সক্ষম। তখন কৃত্রিম সমাজতন্ত্রীরা প্রকৃত সমাজতন্ত্রীদের হাতে পরাভূত হয়। বলা হয়, বাংলাদেশে ভারতের সহযোগিতায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ নাকি ছিল এমনই একটি প্রজেক্ট। জামায়াতের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার কৌশলকে ভ্রান্ত বলে প্রচার করা হয়। তারা বিচারক-উকিল খতম করে তাৎক্ষণিকভাবে ইসলামী শরিয়াহ আইন প্রচারের স্বপ্ন দেখায়। বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমান তথা জেএমবি গাজীপুরে ও ঝালকাঠিতে অঘটন ঘটায়। পাশ্চাত্য এবং প্রতিবেশী ঘটনাগুলোকে তাদের উদ্দেশ্য সাধনের উপায় হিসেবে ব্যবহার করে। যা হোক অবশেষে তারা সফল হয়। বিএনপি-জামায়াত সরকারের শুধু পরাজয়ই ঘটে না, বরং তারা দীর্ঘ ভবিষ্যতের জন্য ক্ষমতাসীনদের আক্রোশ ও আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়।

১/১১-এর বিয়োগান্তক ঘটনাবলীর পর আওয়ামী লীগ যখন শক্তপোক্ত হয়ে ক্ষমতায় বসে, তখন তারা পূর্বনির্ধারিত নীলনকশা অনুযায়ী অগ্রসর হয়। কাদের মোল্লার বিচারকে কেন্দ্র করে কথিত শাহবাগের গণবিপ্লব ঘটে। সেখানে একই সাথে নাস্তিকতন্ত্রের উদ্ভবও লক্ষ করা যায়। সরকারের অব্যাহত ইসলামবিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবাদে ইসলামের রক্ষণ ও লালনের জন্য গঠিত হয় হেফাজতে ইসলাম। হেফাজতে ইসলামের দু’দফা বিশাল আন্দোলনের মুখে সাময়িকভাবে হলেও ইসলামবিরোধী শক্তি রণে ভঙ্গ দেয়। এদিকে সরকার নিজ স্বার্থে শাহবাগ সৃষ্টি করলেও যখন দেখা যায়, এটি বামধারায় প্রবাহিত হচ্ছে, তখন তারা এর যবনিকা ঘটায়। হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ মহাঅবস্থান কর্মসূচির রূপ নেয়। সরকার নির্মম রক্তপাতের মাধ্যমে হেফাজতে ইসলামের মোকাবিলা করে। বরাবরের মতো সরকার অনুসৃত স্টিক এন্ড ক্যারট পলিসি বা লাঠি ও লোভের কূটকৌশলে হেফাজতে ইসলাম প্রধান আল্লামা শফীকে গণভবনে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। তিনি অভিহিত হন কওমি জননী হিসেবে। এভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময় ইসলামী বিপ্লবের অবসান ঘটে। হেফাজতে ইসলামের সুবিধাবাদী অংশ আপস করলেও ভেতরে ভেতরে ফুসতে থাকে ঈমানী অংশ। দেশের সর্বত্র বঙ্গবন্ধুর মূর্তি বানাতে গেলে বাধা দেয় হেফাজত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সফরে এলে আবারও গর্জে ওঠে হেফাজতে ইসলাম। ফলে অসংখ্য আলেম উলামার বিরুদ্ধে জেল-জুলুমের খড়গ নেমে আসে।

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঘটে দু’ধরনের সমীকরণ। খালেছ ও দীনি ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো আওয়ামীবিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়। অপরদিকে ইসলামের নামে ইসলামের বিরোধিতাকারী অংশটি হাত মেলায় শাসকদলের সাথে। অর্থ ও অনর্থের বিনিময়ে এসব দলগুলো ডামি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ইসলামপন্থী বলে কথিত ছটি নিবন্ধিত দল এবারের সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। দলগুলো হলো বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন এবং জাকের পার্টি। এর মধ্যে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও ইসলামী ঐক্যজোট কওমি মাদরাসাভিত্তিক দল। নির্বাচনে যে ফলাফল তারা লাভ করেছে, তা একদিকে হাস্যকর অপরদিকে লজ্জাজনক। যেমন বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট মোমবাতি মার্কা নিয়ে ৩৫টি আসনে অংশগ্রহণ করে। ভোট পেয়েছে মোট ৬৯ হাজার ৩৩। ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ চেয়ার মার্কা নিয়ে ভোট করেছে। তারা ৩৯টি আসনে ৫৬ হাজার ৫৬৭টি ভোট পেয়েছে। বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন ফুলের মালা নিয়ে নির্বাচন করেছে। ৩৭টি আসনে ২৪ হাজার ৬৮৩ ভোট পেয়েছে তারা। অপরদিকে জাকের পার্টি গোলাপ ফুল মার্কা নিয়ে ৮ হাজার ৩০৩ ভোট পায়। এসব দল ভেবেছিল যে, সরকারের দেওয়া টোপ অনুযায়ী তারা বিনা ভোটেই নির্বাচিত হবে। ভোটের আগে ও পরে তারা কাইকুই করলেও সরকারের অনুগ্রহ হারানোর ভয়ে আর টুঁ টা শব্দ করছে না। বাংলাদেশে ইসলামী দলগুলোর ক্ষেত্রে এ ধরনের আপসকামিতা নতুন নয়। ১৯৭৯ সালে প্রথমবারের মতো ইসলামী দলগুলো রাজনীতি করার সুযোগ পায়। তখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বগুণে প্রায় সকলেই তাকে সমর্থন দেয়। সময় গড়িয়ে যখনই যে শাসক এসেছে এ ধরনের পার্টি তাকেই সমর্থন দিয়েছে। এরশাদের সময়ে এদের বড় একটি অংশ তার সমর্থনে কাজ করে। আবার বিএনপি ক্ষমতায় আসলে তাদের দিকে ভিড়ে যায়। বিএনপি ক্ষমতাচ্যুত হলে এ ধরনের সুবিধাবাদি আলেম শ্রেণি আওয়ামী লীগের সমর্থনে ফতোয়া দেয়া থেকে শুরু করে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। তাদের বিরুদ্ধে সরকারের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ও সম্পদ সুবিধা লুটে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

দলভিত্তিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। প্রধান বলার কারণ হলো ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তারা ১৮টি আসন পায়। বিএনপি তাদের সমর্থনে সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তাদের পরোক্ষ সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর তারা সরকারের অংশীদার হয়ে দাঁড়ায়। জনসমর্থন, সাংগঠনিক দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা ও আদর্শবাদিতার জন্য তারা জনগণের মাঝে একটি স্থায়ী আসন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এ কারণেই তারা আওয়ামী লীগ সরকারের রোষানলে পড়েছে। আগেই বলা হয়েছে, তারা যাÑ তার চেয়েও পাশ্চাত্য এবং প্রতিবেশী তাদের বড় করে উপস্থাপন করেছে। তার ফলে বড় বিপদও তাদের হয়েছে। এখন তারা সক্ষমতা ও দৃঢ়তার সাথে বিএনপিসূচিত আন্দোলনের সমসাথী হয়েছে। সেখানেও তাদের জটিলতা ও কূটিলতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিএনপি ইসলামী মৌলবাদের বদনামটি আর নিতে চায় না। তাই জামায়াত থেকে বিএনপি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে চায়। দেশের বামপন্থী দলগুলো জামায়াতকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি নয়। তাদের কাঁধে এখনো যুদ্ধাপরাধের বদনাম আরোপিত হচ্ছে। পাশ্চাত্যেও তাদের সম্পর্কে উল্টোপাল্টা ধারণা রয়েছে। যদিও অতীতে মার্কিনীরা তাদের মডারেট ফোর্স বলেছে, এখনো তাদের সেই কথা ঠিক আছে কিনা, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। মার্কিন প্রসঙ্গটি আসলো এ কারণে যে, বিএনপি তথা বিরোধী রাজনীতি মার্কিন নৈতিক সমর্থনপুষ্ট। এছাড়া জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নয়। সুপ্রিম কোর্টের শেষ মামলায়ও তারা হেরে গেছে। তাদের নির্বাচনী প্রতীক দাঁড়িপাল্লা স্থগিত রয়েছে। সব মিলিয়ে তারা একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে। তাদের বেশি বেশি ত্রাণতৎপরতা দেখে মনে হচ্ছিল যে তারা রাজনীতিবিমুখ হয়েছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে নাগরিক সাধারণের সে ধারণা ভেঙে গেছে। তারা যেভাবে শক্তিমান এবং নতুন প্রজন্মকে যেভাবে তারা টানছে তাতে দেশের প্রবীণ বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং আবুল কাশেম ফজলুল হকের মতো প্রবীণ বুদ্ধিজীবী তাদের ক্ষমতায় আরোহণের আশঙ্কা দেখছেন ১০ বছর সময়ের মধ্যে। তাদের এ আশঙ্কা নেতিবাচক, ইতিবাচক নয়।

এ সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে সক্রিয় ইসলামী দল চরমোনাই পীর সাহেবের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন। হাফেজ্জি হুজুরের ধারাবাহিকতায় কওমি ঘরানার এ রাজনৈতিক সংগঠনটি তাদের সহজ-সরল এবং কৌশলগত অবস্থানের কারণে ইতোমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের নিজস্ব নির্বাচনী এলাকা তৈরি হয়েছে। সংগঠনটির সাথে সরকারের তলে তলে বোঝাপড়া আছে এরকম অভিযোগ নাকচ হয়ে যায় তখন, যখন এর দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব আওয়ামী গুণ্ডাদের হাতে অপদস্থ হন। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে নিজস্ব ধারায় কর্মসূচি পালন করছে তারা। ইসলামী আন্দোলন বিএনপির সাথে সরকার পতন আন্দোলনে শামিল রয়েছে। তবে জামায়াতের মতো তারা একইদিনে একই সময়ে কর্মসূচি পালন করছে না। তারা অনেকটা স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য কৌশল গ্রহণ করছে। এ মুহূর্তে তারা ট্রান্সজেন্ডার ও পাঠ্যপুস্তকে নানা অসঙ্গতির অভিযোগে সরকারবিরোধী আন্দোলন করছে। দেশের সব মহলে পেশাজীবী ও শ্রমিক ফ্রন্টে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। শীর্ষনেতৃত্বের ওপর হামলার পর জামায়াত কঠিন বিবৃতি দেয়। সহানুভূতি জ্ঞাপনের জন্য স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ের প্রতিনিধি দল ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করেন। পরবর্তী পর্যায়ে দুই দলের দূরত্ব নিরসনে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

ইসলামপন্থী এ দুটি প্রধান দলের বাইরে রয়েছে আরও অনেক দল। খেলাফত মজলিস তাদের অন্যতম। কওমি ঘরানা ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মহলে তাদের অল্পবিস্তর সমর্থন আছে। অপরদিকে হাফেজ্জি হুজুর প্রতিষ্ঠিত খেলাফত আন্দোলনও উল্লেখযোগ্য ছিল। এখন তার ছেলে আতাউল্লাহ হাফেজ্জি এ দলের আমীর। এই দলের অপর অংশের নেতৃত্বে ছিলেন হুজুরের জামাতা মরহুম মুফতি ফজলুল হক আমিনী। এখন তার ছেলে আবুল হাসনাত আমিনী এ দলের চেয়ারম্যান। রাজনৈতিক দল হিসেবে আদর্শিক দৃষ্টিতে দেখলে কওমি ঘরানা অনেক সমর্থনপুষ্ট। এগুলো হলোÑ জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলন ইত্যাদি। তবে এদের এতো বিভক্তি ও বিভাজন যে, হিসাব-নিকাশ নেওয়া বড়ই কঠিন। এদের এক একটি ঘরানার ব্যক্তিত্বের এক একটি রাজনৈতিক দল।

বামপন্থীদের মতো ব্রাকেটেড হতে হতে তাদের হদিস পাওয়া মুশকিল। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর উভয় পক্ষের ছোট ছোট ইসলামী দলগুলো নিষ্ক্রিয় রয়েছে। এর বাইরে সেই সাড়াজাগানো হেফাজতে ইসলামের কোনো পাত্তা নেই। গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২৯ ডিসেম্বর সংগঠনটি কারাবন্দী নেতাকর্মীদের মুক্তিসহ আরও কিছু দাবিতে ঢাকায় সমাবেশ করেছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে রহস্যজনক কারণে সমাবেশ স্থগিত করা হয়। গুঞ্জন আছে যে, সরকারের লাঠি ও মুলোর কারণে তারা কর্মসূচি বাতিল করেন। তবে তারা আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। ট্রান্সজেন্ডার বিষয়েও তারা বিবৃতি যুদ্ধ করছে। উল্লেখ্য যে, আহমদিয়া সম্প্রদায় মুহাম্মদ সা.-কে শেষ নবী বলে স্বীকার করে না। তাই হেফাজতে ইসলাম সম্মিলিত খতমে নব্যুয়ত সংরক্ষণ পরিষদ ব্যানারে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে।

বাংলাদেশ একটি নিরঙ্কুশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী জনসংখ্যার ৯২ শতাংশ মুসলমান। দেশে রয়েছেন লাখ লাখ আলেম-ওলামা। তিন লাখ মসজিদ। দেশে আলিয়া মাদরাসার সংখ্যা আনুমানিক ১৮ হাজার। কওমি মাদরাসার সংখ্যা ২০২২ সালে শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনির দেওয়া তথ্যমতে ১৯ হাজার ১৯৯টি। মাজার, খানকাহ ও অন্যান্য ইসলামী প্রতিষ্ঠানে ভরপুর এ দেশ। মসজিদে বিশেষত শুক্রবারে মুসল্লিতে ভরে যায়। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম সমাবেশ তবলিগ ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রতিবছর বাংলাদেশে। অথচ সমাজ, রাষ্ট্রে ও ব্যবহারিক জীবনে এর কোনো প্রতিফলন নেই। পাশ্চাত্যে যখন বড় দিনে ডিসকাউন্ট এর প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তখন আমাদের মুসলিম ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বাড়াতে বাড়াতে আকাশে তোলে। এই যদি হয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং মুসল্লিপ্রবণ জনসমাজের অবস্থা, তখন হতাশ না হয়ে উপায় নেই। এটি প্রমাণ করে যে, ধর্ম তাদের মর্মে পৌঁছেনি। শুধুই পোশাক। শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। আর ইসলামের সমাজ ও ইসলামী রাজনীতি তো দূরের কথা। তবে বাংলাদেশের জনজীবনের গহীন গভীরে যে ইসলামের আবেগ রয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষ চায় ইসলাম অনুসরণ করতে। বিদআত ও বেশরিয়তি প্রতিষ্ঠানেও যখন হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ, তখন ইসলামের প্রতি তা ভালোবাসারই প্রমাণ দেয়। প্রয়োজন শুধুমাত্র ঈমানের এ চেতনা ও ভালোবাসাকে যথার্থ পথে পরিচালিত করা।

ইসলামের রাজনীতি কেন বাংলাদেশে সংকটাপন্ন অথবা ইসলামী রাজনীতির প্রতি কেন গরিষ্ঠ মানুষের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন নেই, তা নিয়ে মৌলিক গবেষণা প্রয়োজন। সাধারণভাবে আমাদের কাছে একটি বড় কারণ দৃশ্যমান। আর তা হলো লাখ লাখ আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখের ইসলামকে অন্য ধর্মের মতোই শুধুই ধর্ম বলে ধারণা করা। তারা একরকম নীরব, নিঃসঙ্গ ও নিস্পৃহ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। এতে আলেম-ওলামার দোষ নেই। কারণ ব্রিটিশ প্রভুরা শিখিয়েছে ধর্ম এবং রাজনীতি ভিন্ন জিনিস। ইংরেজরা ১৮৮৭ সালে মুসলমানদের প্রতি ‘দয়াপরবশ’ হয়ে আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। সেখানে পাঠ্যসূচি তারাই প্রণয়ন করত। সেখানের অধ্যক্ষ ছিল ইংরেজ। এখন এ বাংলাদেশে শত বছর পরও প্রায় সেই নেসাবে চলছে মাদরাসা। মাদরাসার অধ্যক্ষ এখন আর ইংরেজ নেই। তবে তাদের স্থান দখল করেছে ব্রিটিশ শিক্ষানীতির প্রণেতা লর্ড মেকলের উত্তরাধিকারীরা। তাদের গায়ের রং সাদা নয়, বাদামি। অর্থাৎ মেকলের দীক্ষিত ইংরেজি শিক্ষিত বাংলাদেশী প-িতরা। তারাই দেশ পরিচালনা করেন। তারা মনে করেন ধর্ম ও রাজনীতি ভিন্ন জিনিস। সুতরাং আলেম-ওলামা এবং সাধারণ মানুষ যতদিন পর্যন্ত ইসলামকে জীবন ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ না করবে, ততদিন ইসলামী রাজনীতি সফল হবে না। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষকরা বলেন, কোনো দেশের জনসংখ্যার অন্তত তেত্রিশ ভাগ যদি সে ব্যবস্থা গ্রহণে রাজি থাকে, তা সফল হয়। আশার কথা শেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ সংখ্যা বেশ এগিয়ে গেছে। সকল ইসলামপন্থী রাজনৈতিক জনসমষ্টিকে যদি একত্র করা যায়, এখনই সে লক্ষ অর্জন করা সম্ভব। সুতরাং শেষ কথাটি কী দাঁড়ালো? ঐক্য, ঐক্য এবং ঐক্য। সকল ভেদাভেদ, ব্যক্তিগত বিদ্বেষ, ফেতনা-ফ্যাসাদ এবং সুবিধাবাদ অতিক্রম করে যদি সকল ইসলামী রাজনৈতিক দল ইস্পাতকঠিন, দৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলতে পারে, তবেই মনজিলে মাকসুদে পৌঁছা সম্ভব। তার আগে অন্তর্বর্তীকালীন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে জুলুম ও দুর্নীতির সরকার হটানো। ‘শুধু গাফিলতি শুধু খেয়ালের ভুলে, দরিয়া অথৈ ভ্রান্তি নিয়েছি তুলে’। সেই ভ্রান্তি অবসানের একমাত্র উপায় হচ্ছে গণতন্ত্র। নির্বাচন ব্যবস্থা হচ্ছে জনগণের সম্মতি জ্ঞাপক একমাত্র পন্থা। সেই নির্বাচন ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটলে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে ইসলামী রাজনীতির ইতিবাচক সমীকরণ ঘটবে।

https://www.dailysangram.info/post/550679