৭ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৩:২৭

দায় চিহ্নিত, হদিস নেই ফাইলের

রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে স্যানিটারি মার্কেটে বিস্ফোরণে ২৬ জন নিহতের ঘটনায় করা মামলায় দুই সরকারি সংস্থার দায়িত্বে চরম অবহেলার বিষয়টি উঠে এসেছে। ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও তদারকি না করার কারণেই। এ ছাড়া ভবন মালিক ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (রাজউক) গাফিলতি এবং অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।

তবে এই মামলার তদন্ত এগিয়ে নেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি নথি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের কাছে চেয়েছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা। গত সেপ্টেম্বরে তিতাসকে ওই নথি সরবরাহ করতে আদেশ দেন আদালতও। ওই আদেশের ছয় মাস পার হলেও নথি হাতে পায়নি মামলার তদন্ত সংস্থা ডিএমপির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট। নথির সন্ধান না পাওয়ায় তদন্তও কার্যকরভাবে এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না।

এ অবস্থার মধ্যেই সিদ্দিকবাজারের ভয়াবহ বিস্ফোরণের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। গত বছরের এদিন বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটের বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে সিদ্দিকবাজার ও আশপাশের এলাকা। সাত তলাবিশিষ্ট ১৮০/১ নম্বর ভবনের স্যানিটারি মার্কেটের প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ভবনের বেজমেন্ট ছাড়াও প্রথম ও দ্বিতীয় তলার ছাদ ধসে পড়ে। এই ঘটনায় পুলিশের উপপরিদর্শক পলাশ সাহা বাদী হয়ে মামলা করেন।

তদন্ত সূত্র বলছে, দুর্ঘটনার পরপরই ভবন মালিকের দুই ছেলে ওয়াহিদুর রহমান ও মতিউর রহমান এবং ভবনটির বেজমেন্টে গড়ে তোলা ‘বাংলাদেশ স্যানিটারি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার মোতালেব মিন্টুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এখন তারা সবাই জামিনে।

গতকাল বুধবার সরেজমিন দেখা যায়, সিদ্দিকবাজারের ওই ভবনের সামনের কিছু অংশ এখন সড়ক বিভাজক দিয়ে ঘেরা। তবে আশপাশ এলাকার ফুটপাত জমজমাট। ‘এখনও পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে ক্যাফে কুইন। চটের বস্তায় ভবনের একটি অংশ ঢেকে রাখা হয়। নিহত অনেকের স্বজন গতকাল সেখানে কালো কাপড় টানিয়েছেন। অনিকা এজেন্সির মালিকের শোক ব্যানার টানানো হচ্ছিল। নিহত ইদ্রিস মীরের ছেলে রিফাত বলেন, বাবার হঠাৎ এমন করুণ মৃত্যু এখনও মেনে নিতে পারি না। কীভাবে এই দুঃখ ভুলব।

জানা গেছে, বিস্ফোরণস্থল থেকে জব্দ নানা আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। বিস্ফোরক পরিদপ্তর, বিএসটিআই, সিআইডির ফরেনসিক ও ডিএনএ ল্যাব এবং ডিএমপির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। আলামত পরীক্ষা করে ঘটনাস্থলে কোনো বিস্ফোরকের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি।

তদন্তে উঠে আসে, দুর্ঘটনাস্থলে একসময় ক্যাফে কুইন নামে একটি টিনশেড রেস্তোরাঁ ছিল। ১৯৮৩ সালে ভবন মালিকের আবেদনের পর ওই রেস্তোরাঁয় একটি বাণিজ্যিক গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়। এর পর ওই জায়গায় তৈরি করা হয় একটি চারতলা ভবন। তখনও ওই ভবনের নিচতলায় হোটেলটি চালু ছিল। এক পর্যায়ে তা বন্ধ করে ভবন মালিক স্যানিটারি মার্কেট হিসেবে সেটিকে রূপ দেন। ২০০৩ সালে ভবন মালিক আবার বাণিজ্যিক গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আবাসিক গ্যাস লাইন সেখানে নেন। চারতলার ভবন সাত তলায় রূপ দেন।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাঁচ তলা ভবন তৈরির অনুমতি থাকলেও সেখানে সাত তলা পর্যন্ত উঠে যায়। বিধি না মেনেই সাত তলা পর্যন্ত তৈরি করা হলেও রাজউকের সংশ্লিষ্ট পরিদর্শক বছরের পর বছর কোনো ব্যবস্থা নেননি। ওই পরিদর্শকের ব্যাপারে তথ্য চেয়ে রাজউককে চিঠি দিয়েছে পুলিশ। ভবনের দায়-দায়িত্বের ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

আরেকটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, আদালতের অনুমতি নিয়ে তিতাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ওই ভবনের গ্যাস লাইনের সংযোগ পরীক্ষা করা হয়। সেখানে ভয়াবহ গাফিলতির দৃশ্য উঠে আসে। বাণিজ্যিক গ্যাসের লাইনের ব্যাস থাকে ১ দশমিক ৫ ইঞ্চির। আর আবাসিক সংযোগে থাকে দশমিক ৭৫ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ। ক্যাফে কুইন ভবনে বাণিজ্যিক ব্যাসের পাইপ লাইনের সঙ্গে আবাসিকের সরু পাইপের সংযোগ দেওয়া হয়। এতে বাণিজ্যিক লাইনের গ্যাসের চাপ আবাসিক লাইন নিতে পারেনি। এ ছাড়া রাইজার থেকে ওই ভবন পর্যন্ত যে গ্যাস লাইন ছিল, তা থাকার কথা মাটির ওপরে। সেখানে মাটির নিচে ছিল। দুই দশকের বেশি সময় ধরে গ্যাসের লাইনের ছিদ্র কাঠের টুকরো দিয়ে বন্ধ করে রাখায় ভবনে ঝুঁকির মাত্রা বহু গুণ বেড়ে যায়।

একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, গ্যাসের লাইন সংযোগ, এর পর বাণিজ্যিক থেকে আবাসিক ক্যাটেগরিতে কবে রূপান্তর হলো, তা জানাতে তিতাসকে চিঠি দেওয়া হয়। কোন ঠিকাদার ওই ভবনের গ্যাস লাইন সংযোগগুলো দিয়েছেন, তা জানাতে একাধিক চিঠি দিলেও তার উত্তর পাননি তদন্ত কর্মকর্তা। এর পর আদালতের শরণাপন্ন হয় তদন্ত সংস্থা। আদালত গত সেপ্টেম্বরে তিতাসকে এক আদেশে ওই সময়ে তিতাসে কর্মরত সিদ্দিকবাজার এলাকার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের নামের তালিকা তদন্ত সংস্থাকে সরবরাহ করতে বলা হয়।
জানা গেছে, দুর্ঘটনার পেছনে ভবন মালিকেরও দায় উঠে এসেছে। ভবনের অনুমোদিত নকশা বদল করেন তিনি। বেজমেন্ট ছিল গাড়ি পার্কিংয়ের অনুমোদন। সেটা না করে তিনি বেজমেন্টে ‘এয়ার টাইট’ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ভাড়া দেন। বেজমেন্টের পুরোটা ছিল স্যানিটারি দোকান। এ ছাড়া ভবন মালিক গ্যাস লাইন সংযোগ নিয়মিত যথাযথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাননি। ভবনের বেজমেন্টে বাংলাদেশ স্যানিটারি দোকানের মালিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। বাড়ি মালিকের কাছে বেজমেন্টকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতেই ভাড়া নেন।

মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান উপকমিশনার রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, তিতাসসহ এই ঘটনায় কার কী দায় ছিল তা চিহ্নিত করা হয়েছে। গ্যাসের লাইন থেকেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের পরিদর্শক এসএম রইসুল ইসলাম বলেন, তিতাসের কাছে একটি নথি এখনও পাওয়া যায়নি। এর পরও তদন্ত গুছিয়ে আনা হয়েছে। দ্রুত মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে।

ঢাকার মগবাজার, সিদ্দিকবাজার ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার তিনটি ভবনে বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৪৪ জন। তদন্ত সংস্থা বলছে, সবক’টি বিস্ফোরণই ঘটে পাইপলাইনের ছিদ্র দিয়ে বের হওয়া গ্যাস জমে।

মগবাজার ও সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনা দুটি মামলা তদন্ত করছে বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট। আর সায়েন্স ল্যাবরেটরির ঘটনা তদন্ত করছে নিউমার্কেট থানা পুলিশ।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির যে ধারায় মামলা হয়েছে তাতে সর্বোচ্চ সাজা পাঁচ বছর। অবহেলা, গাফিলতি ও তদারকির অভাবে বারবার বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় কাউকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো না গেলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

https://samakal.com/capital/article/226405