৭ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৩:১৫

দুই দিনের ব্যবধানে বস্তা প্রতি চিনির দাম বেড়েছে ৭০/৮০ টাকা

কর্ণফুলী নদীতে পোড়া চিনি ফেলায় মরছে মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী

এখনও নিভেনি চট্টগ্রামে এস আলম সুগার মিলের আগুন। ৩ দিনের চেষ্টাতেও আগুন নির্বাপন করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। ওই চিনির মিলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বাজারে প্রভাব পড়েছে। ২ দিনের ব্যবধানে বস্তা প্রতি দাম বেড়েছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। আগুনে পুড়ে যাওয়া চিনি ও কেমিক্যাল নালা দিয়ে সরাসরি ফেলা হচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে।

ফলে বিষক্রিয়ায় মারা যাচ্ছে কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। বুধবার সকাল থেকে খবর সংগ্রহ করতে যাওয়া সংবাদকর্মীদের কারখানায় প্রবেশ করতে দিচ্ছে না কারখানা কর্তৃপক্ষ। কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সে ব্যাপারে মুখ খুলছে না কেউ। তবে, মালিক কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা একেকজন একেকভাবে বলছে ক্ষতির পরিমাণ। এর আগে সোমবার বিকালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ইছানগর এলাকায় এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিলের চারটি গুদামের মধ্যে একটিতে আগুন লাগে।

গতকাল বুধবার দুপুর দেড়টায় ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ হারুণ পাশা বলেন, যে গুদামটিতে আগুন লেগেছে সেটিতে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত চিনি মজুত ছিল। গুদামটি প্রায় ২৫ হাজার বর্গফুটের। উচ্চতা প্রায় ৫-৬ তলা ভবনের সমপরিমাণ। যেখানে ১ লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত চিনির মজুত ছিল।

‘এগুলো এক ধরনের দাহ্য পদার্থ। পানি দিয়েও এ আগুন নেভানো যাচ্ছে না। এ কারণে আগুন নেভাতে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে। তবে আগুন যাতে ছড়িয়ে না পড়ে আমরা তা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। কবে নাগাদ আগুন নেভানো যাবে তা এ মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। আমাদের ১০টি ইউনিট কাজ করছে।’Ñ তিনি বলেন।

বাজারে প্রভাব পড়েছে : এস আলম গ্রুপ আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেও তাদের গুদাম পুড়ে যাওয়ার জেরে চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারে চিনির দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। দেশের অন্যতম বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ-চাক্তাইয়ের ব্যবসায়ীরা বলছেন, মঙ্গলবার বস্তাপ্রতি চিনির দাম ৭০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। গতকাল বুধবারও একইভাবে কেনাবেচা হয়েছে।

আগুন লাগার পর খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা এস আলমের চিনির এক মণের (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) বস্তার দাম পেয়েছেন ৪৯৯০ টাকা পর্যন্ত। সে হিসেবে প্রতিকেজি চিনির দাম পাইকারি বাজারে উঠেছে ১৩৩ টাকা ৭০ পয়সা পর্যন্ত। অথচ আগের প্রতি বস্তা চিনির পাইকারি দর ছিল ৪৯১০ টাকার মত। সে হিসেবে কেজিপ্রতি দর ছিল ১৩১ টাকা ৫৬ পয়সা।

চট্টগ্রামের রেয়াজুদ্দীন বাজারে বেশিরভাগ মুদি দোকানি চিনির দাম কেজিপ্রতি দুই থেকে তিন টাকা পর্যন্ত বাড়তি রাখছেন। তারা কেজি প্রতি চিনি ১৪২ থেকে ১৪৩ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন। অথচ এরআগে খোলা চিনির দর ছিল ১৪০ টাকা।

পুড়ে যাওয়া চিনি নিয়ে তথ্যের গরমিল : কারখানার গোডাউনে মজুদকৃত কাঁচামালের পরিমাণ নিয়ে তথ্যের গরমিল দেখা গেছে খোদ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের কথায়। ঘটনার শুরুতে সোমবার সন্ধ্যায় এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘গোডাউনে ৬৫ হাজার মেট্রিক টন চিনির কাঁচামাল ছিল।’ আবার রাতে এস আলম লিমিটেড চট্টগ্রাম মূল কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক (মানবসম্পদ ও প্রশাসন) হোসাইন রানা বলেন, ‘গোডাউনে চিনির কাঁচামালের পরিমাণ ছিল এক লাখ মেট্রিক টন।’ আবার মঙ্গলবার সকালে এস আলম কোম্পানির হেড অব স্টেট মোস্তাফা আদিল সাংবাদিকদের বলেন, ‘গোডাউনে দেড় লাখ মেট্রিক টন চিনির কাঁচামাল ছিল। সব পুড়ে গেছে।’

অথচ বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ওই কারখানায় ৫টি গোডাউন রয়েছে। এসব গোডাউনের প্রত্যেকটির ধারণ ক্ষমতা ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়া জিএম মোহাম্মদ আকতার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি কৌশলে বিষয়টি এড়িয়ে যান। এতে গোডাউনটির ধারণ ক্ষমতা নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে।

কর্ণফুলী নদীতে পোড়া চিনি, মরছে মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী : আগুনে পুড়ে যাওয়া চিনি ও কেমিক্যাল নালা দিয়ে সরাসরি ফেলা হচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে। ফলে বিষক্রিয়ায় মারা যাচ্ছে কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও কাঁকড়াসহ নানান জলজ প্রাণী। বুধবার দুপুর দেড়টার দিকে কারখানা সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীর বাংলাবাজার ঘাটে এ চিত্র দেখা যায়। এতে করে নদীর পানি তামাটে রং ধারণ করেছে। স্থানীয় জেলেরা জানান, মঙ্গলবার রাত থেকে নদীতে মরা মাছ ভেসে আসছে। এছাড়া নানা জাতের মাছ কূলে আসছে, এলাকার মানুষ তা সংগ্রহ করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পোড়া চিনির বর্জ্যরে কারণে নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে গেছে। সে কারণে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন না পেয়ে মাছ ও বিভিন্ন জলজ প্রাণী ভেসে উঠছে। এ বিষয়ে কর্ণফুলী উপজেলা মৎস্য অফিসার স্বপন চন্দ্র দে বলেন, আমি যা দেখেছি অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে মাছগুলো মারা যাচ্ছে। মাছ গুলো খাওয়া যাবে কিনা এ মূহুর্তে পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া কিছু বলা যাচ্ছে না।
চট্টগ্রামের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ বলেন, আমাদের একটি দল নদীর পানির ফিজিক্যাল ও কেমিকেল কমপোনেন্টের টেস্ট করছে। পানিতে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। দ্রবীভূত অক্সিজেন দ্রুত কমে যাচ্ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরীক্ষাগারের চিফ কেমিস্ট কামরুল আলম বলেন, গতকালই (মঙ্গলবার) আমরা পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠিয়েছি। নদীর পানিতে ডিও (দ্রবীভূত অক্সিজেন) কমে গেছে।

‘মানমাত্রা যেখানে ৫ থাকার কথা সেটা কমে ওইদিন ছিল ১। চিনি পুড়ে কার্বনডাইঅক্সাইড হয়েছে, সেসব পোড়া অংশ পানিতে এসে পড়ায় পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে।’ ‘এ বিষয়ে এস আলম গ্রুপের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। নদীতে যেন আর পোড়া অপরিশোধিত চিনি না পড়ে সেজন্য তারা পোড়া তরল বালি দিয়ে চাপা দেওয়ার কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছে।’Ñ বলেন তিনি।
এর আগে সোমবার বিকেল ৩টা ৫৩ মিনিটে এস আলম সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট সেখানে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। সঙ্গে যুক্ত হন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের সদস্যরাও। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর সোমবার রাত সাড়ে ১০টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর প্রায় ৩ দিন পেরিয়ে গেলেও আগুন পুরোপুরি নেভেনি।

https://www.dailysangram.info/post/550647