৬ মার্চ ২০২৪, বুধবার, ৭:৫৬

গবেষণায় উদ্বেগজনক তথ্য

বছরের আট মাসই প্রয়োজনীয় অক্সিজেন থাকে না বুড়িগঙ্গায়

রাসায়নিকমিশ্রিত পানি গিয়ে পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। এতে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি আরো দূষিত হচ্ছে। সম্প্রতি তোলা। ছবি : কালের কণ্ঠ
দূষণে বিপর্যস্ত বুড়িগঙ্গা নদী। বছরের চার ঋতু অর্থাৎ আট মাসই এই নদীর পানিতে প্রাণধারণের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকছে না। এতে নদীটির প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থা চরম হুমকিতে পড়েছে। নদীটির জীববৈচিত্র্য ও মৎস্যসম্পদ ধ্বংসের ঝুঁকিতে।
সাম্প্রতিক সময়ে নদীতে ছড়িয়ে পড়েছে আগ্রাসী জাতের মাছ ‘সাকার ফিশ’ও।

দৃক পিকচার লাইব্রেরি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির ‘বুড়িগঙ্গা : নিরুদ্ধ নদী পুনরুদ্ধার’ শীর্ষক গবেষণায় বুড়িগঙ্গার এই করুণ চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর দৃক পাঠ ভবনে এই গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন প্রধান গবেষক ও নদ-নদী বিষয়ক সংগঠন ‘রিভারাইন পিপল’-এর মহাসচিব শেখ রোকন।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই গবেষণায় আরো সহযোগিতা করে স্টামফোর্ড বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস), রিভারাইন পিপল, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), দ্য ডেইলি স্টার ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)।

গবেষণায় বলা হয়, জলাভূমিতে জীব বা অণুজীবের জীবনধারণের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ন্যূনতম পাঁচ মিলিগ্রাম দ্রবীভূত অক্সিজেনের প্রয়োজন। কিন্তু বছরের চার ঋতু অর্থাৎ হেমন্ত, শীত, বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে বুড়িগঙ্গায় জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম অক্সিজেনও থাকে না। গ্রীষ্মকালে দ্রবীভূত অক্সিজেন ৩-এর কাছাকাছি থাকলেও বাকি তিন ঋতুতে তা আরো কমে ২-এর নিচে নেমে আসে।
গবেষণাটি সম্পর্কে প্রধান গবেষক শেখ রোকন বলেন, এর প্রথম উদ্দেশ্য ছিল বুড়িগঙ্গা সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত ও বিভিন্ন চিত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং তা প্রকাশের মাধ্যমে জ্ঞান ও তথ্য বিনিময় করা।

এ ছাড়া বুড়িগঙ্গা পুনরুদ্ধারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জন্য সুপারিশমালা তৈরি এবং এই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী সময়ে আরো বড় গবেষণা, সমীক্ষা ও কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা।

এই গবেষণায় ১৪টি প্রধান দিক উঠে এসেছে বলে জানান শেখ রোকন।

নেই প্রয়োজনীয় ন্যূনতম অক্সিজেন
গবেষণায় বছরের ছয়টি ঋতু ধরে বুড়িগঙ্গার পানির গুণগত মান পরীক্ষা করা হয়েছে। নদীর প্রবহমান অংশের বসিলা সেতু ও সদরঘাট পয়েন্ট থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে দ্রবীভূত অক্সিজেন, তাপমাত্রা, দৃশ্যমানতা, ধাতুর উপস্থিতি, ক্ষারত্বসহ ১০টি সূচক পরীক্ষা করা হয়েছে।

জলাভূমিতে জীব বা অণুজীবের জীবনধারণের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ন্যূনতম পাঁচ মিলিগ্রাম দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকা প্রয়োজন।
গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল বর্ষা ও শরৎকালে বুড়িগঙ্গায় প্রয়োজনীয় ন্যূনতম অক্সিজেন থাকে। বর্ষাকালে সদরঘাটে প্রতি লিটারে সর্বোচ্চ ৬.৫ মিলিগ্রাম অক্সিজেন পাওয়া গেছে।

বাকি চার ঋতু অর্থাৎ হেমন্ত, শীত, বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে বুড়িগঙ্গায় জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম অক্সিজেন থাকে না। সবচেয়ে নাজুক অবস্থা থাকে হেমন্তকালে। দ্রবীভূত অক্সিজেন এ সময় এক-এরও নিচে নেমে আসে।

দুই তীরে ১০০ ড্রেন
২০১৯ সালে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ) উচ্চ আদালতের নির্দেশক্রমে বুড়িগঙ্গায় পড়া ভূগর্ভস্থ নালা বা ড্রেন শনাক্ত করে। এ সময় ৬৮টি ড্রেনের প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এই গবেষণায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার দুই তীরে রয়েছে মোট ১০০টি ড্রেন। এর মধ্যে ৪৭টি স্লুইস গেটসহ, ৫৩টি খোলা।

৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের দৃশ্যমান প্রভাব নেই
এই গবেষণায় বুড়িগঙ্গা সম্পর্কিত আটটি প্রকল্প পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, সরাসরি বা আংশিকভাবে বুড়িগঙ্গাবিষয়ক আটটি প্রকল্পে গত দুই দশকে অন্তত তিন হাজার ২৯৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু নদীটি পুনরুদ্ধারে এর প্রভাব দৃশ্যমান নয়।

ছড়িয়ে পড়ছে ক্ষতিকর সাকার ফিশ
গবেষণায় বুড়িগঙ্গার প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থার অতীত ও বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি এতে অপরিকল্পিত স্থাপনা ও নগরায়ণের চিত্র ও প্রভাব উঠে এসেছে। অববাহিকার জীবন-জীবিকার ওপর বুড়িগঙ্গা পরিস্থিতির প্রভাবও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দেখা গেছে, নদীটির জীববৈচিত্র্য বহুলাংশে বিনষ্ট হয়ে গেছে এবং মৌসুমি হয়ে পড়েছে। সারা বছর এতে মৎস্যসম্পদ থাকে না। অন্যদিকে ‘সাকার ফিশ’ নামের আগ্রাসী জাতের একটি মাছ ছড়িয়ে পড়েছে।

প্রকৃত দৈর্ঘ্য ৪১ কিলোমিটার
বুড়িগঙ্গার প্রকৃত উৎসমুখ ও দৈর্ঘ্য নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। সরকারি সংস্থাগুলোর নথিতেও এই নদীর দৈর্ঘ্য একেক জায়গায় একেক রকমের। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের হিসাবে নদীটির দৈর্ঘ্য ২৯ কিলোমিটার। পর্যটন করপোরেশন বলছে, বুড়িগঙ্গার দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লিউটিএ) হিসাবে এটি ৪৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদী।

গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিকভাবে বুড়িগঙ্গার সম্পূর্ণ অংশ শনাক্ত করে এর প্রকৃত দৈর্ঘ্য নিরূপণ করা সম্ভব হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, উৎপত্তিস্থল কেরানীগঞ্জের হযরতপুর ইউনিয়ন সংলগ্ন ধলেশ্বরী থেকে কেরানীগঞ্জের কোণ্ডা ইউনিয়নের জাজিরার কাছ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার দৈর্ঘ্য ৪১ কিলোমিটার।

গবেষকদলের প্রধান শেখ রোকন বলেন, এই দৈর্ঘ্যের সঙ্গে ইতিহাসগ্রন্থগুলোতে উল্লেখ করা দৈর্ঘ্যের মিল রয়েছে। ১৯১২ সালে প্রকাশিত যতীন্দ্রমোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’ গ্রন্থেও বুড়িগঙ্গার দৈর্ঘ্য ২৬ মাইল (৪১.৮ কিলোমিটার) উল্লেখ করা হয়েছে।

সুপারিশ
গবেষণা প্রতিবেদনে নদীপ্রবাহের প্রকৃত দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা চিহ্নিত করা, দখল উচ্ছেদ ও খননের মাধ্যমে নদীপ্রবাহ ফিরিয়ে আনা, গৃহস্থালি ও শিল্প বর্জ্যের উৎসগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো বন্ধ করা, সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম ও সমন্বয়হীনতা দূর করা এবং জবাবদিহি বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।

গবেষণা পদ্ধতি
সামাজিক গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার মিশ্রণে পরিচালিত হয় এই গবেষণা। এর মধ্যে নিবন্ধ পর্যালোচনা, ভূমি মানচিত্র পর্যালোচনা, পানির গুণগত মান পরীক্ষা ও পর্যালোচনা, মানচিত্র আঁকা ও তুলনা, উপগ্রহচিত্র পর্যালোচনা, সরেজমিন পরিদর্শন, মাঠ জরিপ, দলীয় আলোচনা ও সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে বুড়িগঙ্গার অস্তিত্ব, এর অতীত, বর্তমান ও সম্ভাবনা এবং নদীটি পুনরুদ্ধারে করণীয়র ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2024/03/06/1369168