৫ মার্চ ২০২৪, মঙ্গলবার, ৩:২০

১৩ ছাড়পত্র নিয়মে আছে, কেউ নেই ধারেকাছে

যেসব রীতি মেনে রেস্তোরাঁ ব্যবসা চালানোর কথা; রাজধানীর তারকা হোটেল ছাড়া আর কেউ ওসব নিয়মের ধারেকাছে নেই। স্থানভেদে সরকারি কমবেশি ১৩ প্রতিষ্ঠান-দপ্তর থেকে অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও মাত্র দু-তিনটি ছাড়পত্র হাতে নিয়েই দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে রেস্তোরাঁ ব্যবসা। অনেকে একটি ব্যবসায়িক নিবন্ধন নিয়ে পাঁচ-সাতটি শাখা খুলে বসেছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, রেস্তোরাঁ ব্যবসার নিয়মকানুন এত জটিল করা হয়েছে; সংশ্লিষ্ট দপ্তর-সংস্থার অনুমতি নিতে গেলে গলদঘর্ম হতে হয়। ঘাটে ঘাটে ঢালতে হয় টাকা। এসব কারণে ব্যবসায়ীরা অনুমতি নেওয়ার ক্ষেত্রে মুখ ফিরিয়ে নেন। আমরা দীর্ঘদিন ধরে রেস্তোরাঁ ব্যবসাকে এক ছাতার নিচে আনার দাবি জানিয়ে আসছি, তবে কাজ হচ্ছে না। যে কারণে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির নেতারা মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টেরও পূর্ণাঙ্গ কাগজপত্র সংগ্রহ করতে পারেননি। দু-চারটি দপ্তর-সংস্থার অনুমতি নিয়েই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তারকা হোটেল ছাড়া সারাদেশে রেস্তোরাঁর প্রকৃত সংখ্যা কত, সঠিক হিসাব কারও কাছে নেই। তবে রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের মতে, এ সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ লাখ। এর মধ্যে রাজধানীতে আছে প্রায় ২৫ হাজার। দু-তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে ব্যবসা করছে ৩ হাজারের মতো রেস্তোরাঁ। ঢাকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অনুমোদন আছে মাত্র ৫ হাজার ৬০০টি রেস্তোরাঁর। সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স আছে ৭ হাজারের মতো রেস্তোরাঁর। ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন কয়টি রেস্তোরাঁ আছে, তা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সও বলতে পারেনি।

জানা গেছে, রেস্তোরাঁ ব্যবসার জন্য ফায়ার সার্ভিসের অনুমতি ছাড়াও সিটি করপোরেশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, কলকারখানা অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, বিদ্যুৎ বিভাগসহ মোট ১৩টি দপ্তর-সংস্থার অনুমতি নিতে হয়। তবে বেশির ভাগ রেস্তোরাঁ শুধু জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অনুমোদন ও সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদনের বিষয়টি একটু জটিল বলে অনেকেরই সে অনুমোদন নেই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়মিত ভ্যাট আদায় করলেও অনেক রেস্তোরাঁ সংস্থাটির অনুমোদনের বাইরেই রয়ে গেছে। তবে এনবিআরের অনুমোদন সহজেই পাওয়া যায় বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, এনবিআর রাজস্ব আদায় বাড়ানোর স্বার্থেই তারা সহজে অনুমোদন দিয়ে দেয়। সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রেও তাই।

জানা গেছে, ২০২২ সালের হিসাবে বর্তমানে দেশে তারকা হোটেলের সংখ্যা ৪৩টি। এর মধ্যে পাঁচতারকা হোটেল ১৭টি। চার তারকা ছয়টি ও তিন তারকা হোটেল ২০টি। তাদের রেস্তোরাঁর মান নিয়ে বড় অভিযোগ নেই। এর বাইরে রাজধানীতে ঢাকার জেলা প্রশাসকের তালিকায় থাকা রেস্তোরাঁর মধ্যে ৩০ শতাংশ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। নিম্ন-মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্তদেরই এসব রেস্তোরাঁয় যাতায়াত। এগুলোই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ধারণা করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।

বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর রেস্তোরাঁ ব্যবসা চলা ভবনগুলোতে অভিযান ও তথ্য অনুসন্ধান চালাচ্ছে রাজউক। তারাও মাঠ পর্যায়ে গিয়ে পাচ্ছে রেস্তোরাঁ পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ঘাটতির চিত্র। রাজউকের বনানী এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইমরুল হাসান বলেন, গত দু’দিনে আমরা বেশ কিছু ভবনের তথ্য সংগ্রহ করেছি। তাতে দেখা গেছে, ডিসি অফিস, সিটি করপোরেশন ও এনবিআরের অনুমতিপত্রই রেস্তোরাঁ মালিকরা দেখাচ্ছেন। পাশাপাশি ভবনের অনুমোদনবিষয়ক কাগজপত্রও তাদের কাছে পাওয়া যাচ্ছে। এর বাইরে তেমন কিছু নেই।

এ ব্যাপারে এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহসভাপতি আমিন হেলালী বলেন, ‘আমাদের দেশে একটি ঘটনা ঘটলে তখন টুঁটি চেপে ধরা হয়। এর আগে কিছু করা হয় না। অথচ দেশের মানুষের জীবনযাত্রা বদলে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তবে রাষ্ট্রের পরিকল্পনা নেই। প্রতিটি কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত না করে আমরা উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখছি।’

তিনি বলেন, ‘কারখানা বন্ধ করে দিলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ কেউ ৫০ টাকায় দুপুরের খাবার খায়। কেউ খায় ৫০০ টাকায়। আবার ৫ হাজার টাকায়ও খায়। এ জন্য রেস্তোরাঁর ক্যাটেগরি করতে হবে। ক্যাটেগরি করে যে ঘাটতি আছে, সেটা পূরণের সময় দিতে হবে। বন্ধ করে দিলেই হবে না। কারণ এখানে অনেক মানুষ কাজ করেন।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রানা হাসান বলেন, নিয়মকানুনের জটিলতার কারণে অনেক কাগজপত্র নেওয়া যায়নি। বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করে রাখা হলেও শর্তের বেড়াজালে সেগুলো আটকে আছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম বলেন, ভবন তৈরির সময় ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন নেওয়া ছাড়াও রেস্টুরেন্ট ব্যবসা পরিচালনা করতে হলে তার জন্য আরেকটি অনুমোদন ফায়ারের কাছ থেকে নিতে হয়। তবে কতটি প্রতিষ্ঠান রেস্তোরাঁ পরিচালনার জন্য ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নিয়েছে, এ তালিকা করা হয়নি। এখন সেই তালিকা করার সময় হয়েছে।

https://samakal.com/bangladesh/article/226015