৫ মার্চ ২০২৪, মঙ্গলবার, ৩:১৭

রাজধানীতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি

ঢাকার বায়ুদূষণ বেড়েই চলেছে। গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে ঢাকার বায়ুদূষণ ছিল বিগত আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এ বছরের শুরু থেকে সে দূষণ আরও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঢাকার বাতাস ১২ দিনই ছিল দুর্যোগপূর্ণ। আর বাকি দিনগুলি ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। ফেব্রুয়ারি মাসেও ঢাকার বাতাস ৮ দিন ছিল দুর্যোগপূর্ণ আর বাকি দিন খুবই অস্বাস্থ্যকর ছিল। গতকালও এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে ঢাকার বাতাস ২০৫ স্কোর নিয়ে বিশ্বের দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় শীর্ষে ছিল। গত তিনদিন ধরে ঢাকা দূষিত বাতাসের শহরের শীর্ষে রয়েছে। ঢাকার এ বায়ুদূষণের প্রভাব পড়ছে সরাসরি স্বাস্থ্যের উপর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টানা দুই মাসেরও বেশি সময় ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার ফলে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ঢাকাবাসী। বাড়ছে শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। বিশেষ করে শিশু ও প্রবীণরা ভুগছেন বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্বাস্থ্যকর বায়ুর কারণে এলার্জি, চর্মরোগ, সর্দি-কাশি থেকে শুরু করে হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট ও ফুসফুসের ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। তাদের মতে, দূষণের ফলে দীর্ঘমেয়াদি রোগের সম্ভাবনা থাকে। প্রথম দিকে সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া হলেও একটা সময় রোগীদের ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় লিভার ও কিডনি। এ ছাড়া মহিলাদের প্রজনন স্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী এ বিষয়ে ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণ এখন মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। প্রায়ই এ শহর বিশ্বের মধ্যে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় শীর্ষে থাকছে। এই বায়ুদূষণ নগরবাসীর জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করেছে। দূষিত বায়ুতে নিঃশ্বাস নেয়ার ফলে শ্বাসতন্ত্রজনিত সমস্য বাড়ছে। যাদের হাঁপানি আছে তারা মারাত্মকভাবে আরও আক্রান্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া এলার্জি, চর্ম রোগ এগুলোও বাড়ছে। নিঃশ্বাসের সাথে দূষিত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রকণা দেহে প্রবেশ করে রক্তের সাথে মিশে কিডনি এবং লিভারের মারাত্মক ক্ষতি করছে। ফুসফুসে ক্যান্সার হচ্ছে। নারীদের বন্ধ্যাত্ব বাড়ছে। এ ছাড়া স্ট্রোকে মারা যাওয়া রোগীর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই বায়ুদূষণের কারণে হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসাবে তিনি বলেন, বায়ুদূষণের যে উৎসগুলো আছে যেমন ইটভাটা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, নিম্ন মানের জ্বালানি তেলের ব্যবহার বন্ধ করা। উন্নয়ন খোঁড়াখুঁড়ি, নির্মাণ কাজ এগুলো নিয়ম মেনে করা। হাইকোর্ট যে ১৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছে সেগুলো কার্যকর করা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো এ ব্যাপারে যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। তাদের ব্যর্থতার জন্য রাজধানীবাসী এখন চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুসারে, বায়ুদূষণের ফলে স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণে মৃত্যুহার বেড়েছে। ফলে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের গবেষণায় বলা হয়, বায়ুদূষণে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু কমেছে ৭ বছর। আর রাজধানীবাসীর (ঢাকাবাসীর) গড় আয়ু কমছে ৮ বছর করে।

পরিবেশবিদরা বলছেন, বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব অনেক। এটি আমাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। কিন্তু দূষণরোধে আমাদের সরকারের আন্তরিক কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না। দূষণরোধে পরিবেশ মন্ত্রণালয় বা অন্যদের মধ্যে সমন্বয় নেই। সংশ্লিষ্টদের যথাযথ পরিকল্পনা নেই। ফলে প্রতি বছর মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদি রোগের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বায়ুদূষণ রোধে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। প্রতিদিন রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দুইবার পানি ছিটানোর নির্দেশনা থাকলেও সিটি কর্পোরেশন তা ঠিকমত করছে না। মাঝে মাঝে কোথাও পানি ছিটালেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। পানি দেয়ার জন্য মেশিন কেনা হলেও এগুলো এখন ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়ে আছে।

বায়ুদূষণ নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত কাজ করা সবুজ আন্দোলনের চেয়ারম্যান বাপ্পি সরদার ইনকিলাবকে বলেন, বায়ুদূষণ ক্রমাগত ঢাকাসহ সারাদেশে অক্ষমতা এবং মৃত্যুর ঝুঁকির শীর্ষে স্থান করে নিয়েছে। দূষিত বায়ুর কারণে হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ এবং ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ বাতাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক মানের (পিএম ২.৫) চেয়ে ঢাকার বাতাসের মান ১৬ গুণ বেশি। তারা আরও বলেন, ঢাকাসহ সারাদেশে ক্রমাগত বায়ুদূষণ বাড়লেও এনিয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। কিন্তু বায়ুদূষণ রোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করলে এটি রোধ করা সম্ভব। পাশাপাশি এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) নেতা শরিফ জামিল ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। অথচ এ ব্যাপারে সরকারের আন্তরিক কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না, সরকার একেবারেই নিশ্চুপ। বর্তমান বায়ু দূষণের যে মাত্রা তা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরও পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট যারা তারা এ ব্যাপরে উদাসীন।

তবে এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতর বলছে তারা বায়ুদূষণ রোধে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকার আশপাশের অবৈধ অনেক ইটভাটা বন্ধ করা হয়েছে। রাজধানীতে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় মিলে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী আগামী ১০০ দিনের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বায়ু দূষণের জন্য যেসব উৎস দায়ী সেগুলোর বিরুদ্ধে এবার সমন্বিতভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

https://dailyinqilab.com/national/article/642970