৫ মার্চ ২০২৪, মঙ্গলবার, ৩:০৬

আলোচিত ‘গোল্ডেন রাইস’ ধান নিয়ে আবারো সক্রিয় ইরি-ব্রি

পরিবেশবাদীদের বিরোধিতা, ছাড়পত্র আটকে আছে ৭ বছর

‘গোল্ডেন রাইস’ নামের ধানের নতুন জাত চাষাবাদের অনুমোদনের জন্য ফের তৎপর হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) কর্তা ব্যক্তিরা। বিশেষ ধরনের এই ধানের জাতটি রিলিজ দেয়ার লক্ষ্যে নতুন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুস শহীদের সাথে গতকাল বৈঠক করেছেন সংস্থা দু’টির শীর্ষ কর্মকর্তারা। ইরি’র হেলদিয়ার রাইস প্রোগ্রামের প্রজেক্ট লিডার রাসেল রেইনকের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে জিএমও গোল্ডেন রাইস জাত অবমুক্তির বিষয়ে কৃষিমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করে। তারা জানান, ফিলিপাইনে গোল্ডেন রাইস চাষ হচ্ছে। এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে বলে জানান কৃষিমন্ত্রী। এ সময় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক শাহজাহান কবীরও উপস্থিত ছিলেন।

জানা যায়, মূলত ইরি ও মার্কিন দাতব্য সংস্থা বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ব্রি বিশেষ জাতের ধান ‘গোল্ডেন রাইস’ উদ্ভাবন করে। সাধারণত চালের রঙ সাদা হলেও বিশেষ এই জাতের চালের রঙ হলদে সোনালি হয়। তাই এই ধানের নাম দেয়া হয়েছে ‘গোল্ডেন রাইস’। এটি জেনেটিক্যালি মডিফাইড শস্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিআর-২৯ জাতের ধানের সাথে ভুট্টার জিন মিলিয়ে এই গোল্ডেন রাইসের জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে বলে সূত্রে জানা যায়। ব্রি বলছে এটি ‘ভিটামিন-এ’ সমৃদ্ধ ধানজাত। ‘গোল্ডেন রাইস’ নামের এ ধান চাষাবাদ নিয়ে শুরু থেকেই পরিবেশবাদীরা বিরোধিতা করে আসছেন। ২০১৭ সালে তথা প্রায় সাত বছর আগে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করে ব্রি। এর মধ্যে সাবেক দু’জন কৃষিমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মহলের সাথে বৈঠক করেন ব্রি ও ইরি’র কর্তা ব্যক্তিরা। কিন্তু পরিবেশ ছাড়পত্র না পাওয়ায় ‘গোল্ডেন রাইস’ নামের এ জাতটি রিলিজ দিতে পারছে না কৃষি মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ গতকাল সোমবার নতুন কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুস শহীদের সাথে সচিবালয়ে সাক্ষাৎ করেছেন দু’টি সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা। তারা পরিবেশ ছাড়পত্র আদায়ে কৃষিমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করেন বলে জানা যায়।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক (পরিবেশগত ছাড়পত্র) মাসুদ ইকবাল মো: শামীমের সাথে যোগাযোগ করা হয়। তিনি জানান, ‘গোল্ডেন রাইস’ বিষয়টি আরেক পরিচালক (গবেষণাগার কার্যালায়) মুহাম্মদ সোলায়মান হায়দার দেখছেন। সোলায়মান হায়দারকে ফোন করলে তিনি বলেন, আগে দেখতাম, বছরখানেক হলো এটি দেখছেন পরিচালক (প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা) সৈয়দা মাছুমা খানম। তবে সৈয়দা মাছুমা খানমের সাথে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

ব্রি ও ইরি বলছে, ‘গোল্ডেন রাইস’ দরিদ্র মানুষের ভিটামিন-‘এ’র ঘাটতি পূরণে সক্ষম। প্রায় দেড় যুগ ধরে গবেষণা করে জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ ধানের চাল ভিটামিন-‘এ’ সমৃদ্ধ। দরিদ্র মানুষের ভিটামিন-‘এ’র ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যেই এ চাল বাংলাদেশে বিস্তৃত করার কথা বলছেন ব্রি’র কর্তা ব্যক্তিরা। সরকারি এই সংস্থাটি বলছে, ‘ব্রি’র বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে এই চাল নিয়ে নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন যে, এটি মানবশরীর, পশুপাখি ও পরিবেশের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। ব্রি ধান ২৯ যতটুকু নিরাপদ, গোল্ডেন রাইসও ততটুকুই নিরাপদ।

কিন্তু শুরু থেকেই এ ধানের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা কয়েকটি সংগঠন। এর মধ্যে বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ) বলছে, এ ধরনের জিএম খাবার চালু করার মতো পরিবেশ এখনো বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। কারণ এ ধরনের একটি ফসল চালু করতে হলে পরিবেশের ওপর, অন্যান্য ফসলের ওপর যে প্রভাব পড়বে, তা যাচাই করে দেখা হয়নি। বাংলাদেশের মতো দেশে এ রকম ফসলের দরকারও নেই। কারণ অনেক খাবারে ভিটামিন-‘এ’ পাওয়া যায়, বরং সেসব খাবার খেতে উৎসাহ তৈরি করতে হবে।

উবিনীগের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতারের মতে, বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকে এটা বিকৃত বীজ; মাঠপর্যায়ে বা কৃষকপর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার দ্বিতীয় উদ্যোগ। বিকৃত বেগুনবীজ বা বিটি বেগুন ছাড় দেয়ার পর একের পর এক জিএম ফসল দিয়ে বাংলাদেশের প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর কৃষিব্যবস্থাকে বহুজাতিক বীজ কোম্পানির স্বার্থে শুধু সর্বনাশের দিকেই ঠেলে দেয়া হচ্ছে না, পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যকেও চরম হুমকির মুখে ফেলে দেয়া হচ্ছে।

তিনি জানান, ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের কথা বলে ‘বিটি বেগুন’ প্রবর্তনের সময় যেসব দাবি করা হয়েছিল তা সত্য প্রমাণিত হয়নি। এর পক্ষে যেভাবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পদ্ধতি অনুসরণ এবং বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দাখিলের বাধ্যবাধকতা ছিল, তা পালন করা হয়নি। কোম্পানির পক্ষ হয়ে গবেষণা প্রতিবেদন দাখিল করে ভুয়া দাবির ভিত্তিতে এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিকৃত বীজ মাঠে প্রবর্তনের ক্ষেত্রে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা না মেনে বিটি বেগুন কৃষকদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তদুপরি কৃষকরা এ ফসল চাষ করে লাভবান হননি। তা সত্ত্বেও নতুন আরো একটি জিএম ফসল কেন অনুমোদন দেয়া হচ্ছে, তা গুরুতর প্রশ্ন নিয়ে হাজির হচ্ছে।

তার মতে, বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান এবং বিশেষ করে ধান উৎপাদনকারী দেশ। এখানে স্বাভাবিক প্রাণকোষের বিকৃতি ঘটিয়ে তৈরি করা ধান বা জিএম ধানের স্রেফ বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থে অনুপ্রবেশ ঘটানোর কোনো যুক্তি নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিকৃত বীজ বা জিএমের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রভাব গড়ে উঠছে, কারণ এ ধরনের প্রযুক্তি এক দিকে স্থানীয় ফসলকে দূষিত করছে, অন্য দিকে বীজসহ সামগ্রিক কৃষিব্যবস্থার ওপর বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য ও দখলদারি বাড়িয়ে তুলছে।

জানা যায়, ২০০৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মোট আট বছর এই ধান নিয়ে গবেষণা করে ব্রি। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ২০১৭ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে গোল্ডেন রাইসের জৈব-নিরাপত্তা (বায়োসেফটি) বিষয়ক অনুমোদনের জন্য আবেদন করে ব্রি। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে সেই আবেদন পাঠানো হয় পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীন জৈব নিরাপত্তা বিষয়ক জাতীয় কমিটির (এনসিবি) কাছে। এনসিবি ব্রি’র আবেদনটি পর্যালোচনা (রিভিউ) বা পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাইয়ের জন্য পরিবেশ বিভাগের আওতাধীন বায়োসেফটি কোর কমিটির (বিসিসি) কাছে প্রেরণ করে।

এ বিষয়ে ব্রি’র মহাপরিচালক ড. মো: শাহজাহান কবীরকে ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে সংস্থাটির উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের চিফ সাইন্টিফিক অফিসার (সিএসও) ড. মো: আবদুল কাদের-এর সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। যিনি ২০১৫ সাল থেকে ‘গোল্ডেন রাইস’-এর প্রধান গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি জানান, গত কয়েক মাস আগে বায়োসেফটি কোর কমিটির (বিসিসি) মিটিং হয়েছে। সেখানে তাদের কিছু কোয়ারি ছিল, সেগুলো পূরণ করেছি। এখন ন্যাশনাল বায়োসেফটি কমিটির মিটিং হলেই বোঝা যাবে যে, অ্যাপ্রুভাল হয় কি হয় না।

ড. মো: আবদুল কাদের বলেন, পরিবেশবাদীরা বলে (বিরোধিতা) অন্য অ্যাঙ্গেল থেকে; তারা যেটা বলে সায়েন্টিফিক না। বায়োসেফটি কোর কমিটি টেকনিক্যাল বিষয়গুলো আলোচনা হয়েছে। এখন অনেকটা পজিটিভই বলা যায়। ইরি’র একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসছে। গতকাল (রোববার) কৃষি সচিব মহোদয়ের সাথে দেখা করেছেন তারা। আজ (সোমবার) কৃষিমন্ত্রী মহোদয়ের সাথে দেখা করেছেন।

হাইব্রিড ধানের মতোই ‘গোল্ডেন রাইস’ জাতের বীজ হয় না বলে একটা প্রচারণা রয়েছে। এ বিষয়ে ড. মো: আবদুল কাদের বলেন, না- এ কথা সঠিক নয়। অন্যান্য ভ্যারাইটির মতোই এ ধান, চিরজীবনই বীজ হবে। ব্রি ধান ২৯-এর চেয়েও বেশি ‘গোল্ডেন রাইস’ ধানের ফলন হবে। প্রতি বিঘায় ৩০-৩২ মণ উৎপাদন হবে। প্লাস পয়েন্ট হলো এটি বিটা ক্যারোটিন-সমৃদ্ধ। যেটা খাওয়ার পরে ভিটামিন-এ তৈরি হয়।
জানা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মানুষ ও প্রাণির নিরাপদ খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের জন্য গোল্ডেন রাইসকে অনুমোদন দিয়েছিল দেশটির কৃষি বিভাগ। সেই অনুমোদন পাওয়ার পর, ফিলিপাইনের জাতীয় ধান গবেষণা সংস্থা ফিলরাইস গোল্ডেন রাইসের সেনসরি ইভ্যালুয়েশন বিষয়ক গবেষণা শুরু করে। গবেষণা শেষে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করা হয়। বিগত ২০২১ সালে ‘গোল্ডেন রাইস’ বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ ও ব্যবহারের অনুমোদন দেয় ফিলিপাইন সরকারের কৃষি বিভাগ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গতকাল কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুস শহীদের সাথে সাক্ষাৎ করে ইরি ও ব্রি’র কর্মকর্তারা ফিলিপাইনে গোল্ডেন রাইস চাষাবাদের বিষয়টি তুলে ধরে বাংলাদেশে চাষাবাদের বিষয়টিও তুলে ধরেন।

ফিলিপাইন ও বাংলাদেশে হেলদিয়ার রাইস প্রকল্পের আওতায় গোল্ডেন রাইস-এর ফলন ও খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে গবেষণা করছেন দুই দেশের বিজ্ঞানীরা। এই প্রকল্পের আওতায়, গোল্ডেন রাইস ছাড়াও, বর্তমানে উচ্চমাত্রার জিংক ও আয়রন-সমৃদ্ধ চাল উদ্ভাবনে কাজ করছেন ফিলরাইস ও ব্রি’র বিজ্ঞানীরা।

ধান বিজ্ঞানীরা বলছেন, জৈবনিরাপত্তা বা বায়োসেফটি অনুমোদন পাওয়া গেলে ব্রি প্রয়োজনীয় পরীক্ষা এবং জাত অবমুক্তির জন্য বিভিন্ন ফিল্ড ট্রায়াল পরিচালনা করবে। ফল সন্তোষজনক হলে প্রচলিত পদ্ধতি বা প্রোটোকল অনুযায়ী জাতীয় বীজ বোর্ড (এনএসবি)-এর কাছে গোল্ডেন রাইসের জাত অবমুক্তির জন্য আবেদন করবে ব্রি। জাতীয় বীজ বোর্ড আবেদনটি যাচাই-বাছাই করে সন্তুষ্ট হলে গোল্ডেন রাইস অবমুক্তির জন্য অনুমোদন দেবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/818890