৫ মার্চ ২০২৪, মঙ্গলবার, ৩:০৪

সবলের সাথে এক হবে দুর্বল ব্যাংক

গভর্নরের সাথে জরুরি বৈঠক বিএবির

সবলের সাথে একীভূত করা হবে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে। ব্যাংকগুলো স্বেচ্ছায় নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে একীভূত হয়ে যেতে পারবে। আর তা না হলে বাংলাদেশ ব্যাংকই বলে দেবে কোন ব্যাংকগুলো দুর্বল এবং কীভাবে একীভূত করা হবে সেসব ব্যাংককে। ঠিক কতগুলো ব্যাংককে একীভূত করা হবে তা নিশ্চিত করা না হলেও প্রাথমিকভাবে ১৫ থেকে ১৬টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

তবে, সব কিছু নির্ভর করছে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচকের ওপর। আর এ মানদণ্ড নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ)’ নামে একটি ফ্রেমওয়ার্ক দেয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণ, তারল্য, মূলধন ও সুশাসন এ চার মানদণ্ডের ভিত্তিতে আগামী বছর মার্চের মধ্যে র্যাংকিং হবে। এরপর থেকেই একীভূতকরণ শুরু হবে। র্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর চলতি বছরের আর্থিক প্রতিবেদন মূল্যায়ন করা হবে। কোনো ব্যাংক পিসিএ ফ্রেমওয়ার্কে উল্লেখিত লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে ব্যর্থ হলে সেগুলোকে অন্য ব্যাংকের সাথে একীভূত করে দেয়া হতে পারে।

এ দিকে ব্যাংক মার্জার করার উদ্যোগের খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যাংকের উদ্যোক্তারা। ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) চেয়ারম্যান ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের নেতৃত্বে সংগঠনের অন্যরা গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সাথে জরুরি বৈঠক করেছেন। এ বৈঠকে গভর্নরের কাছে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে কিভাবে দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করা হবে এবং ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা হবে সি বিষয়ে প্রশ্ন করেন।

এ বিষয়ে বিএবি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ব্যাংক একীভূত করার খবরে আমাদের অনেকেই উদ্বিগ্ন ছিলেন। আমরা এজন্য গভর্নরের সাথে বৈঠকে বসেছিলাম। তবে গভর্নরের সাথে বৈঠকে আমরা আশ্বস্ত হয়েছি। উদ্বেগ কেটে গেছে। গভর্নর তাদের জানিয়েছেন, সবলের সাথে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে মিলিয়ে দেয়া হবে। এ ক্ষেত্রে মালিকরা নিজেরা আলোচনা করে মিলে যেতে পারেন, না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই এ কাজটি করে দেবে। গভর্নর আমাদের প্রশ্নগুলোর উত্তর ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমরা বুঝতে পেরেছি ব্যাংক একীভূত হলে কারো ক্ষতি হবে না, দুর্বল ব্যাংক শক্তিশালী হবে এবং ভালো ব্যাংকও আরো শক্তিশালী হবে। তিনি বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যাংক একীভূত করার উদাহরণ রয়েছে। তাই জাতীয় স্বার্থে আমরা এটি মেনে নেব। তিনি বলেন, সরকার যদি চায় তাহলে জাতীয় স্বার্থে যেকোনো সিদ্ধান্ত মানতে আমরা বাধ্য। তবে কোন প্রক্রিয়ায় ব্যাংক একীভূত হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তাই এখনই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আসেনি। মালিকদের পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে একীভূত হবে নাকি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত দিবে এমন প্রশ্ন তিনি বলেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়নি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত আমরা জাতীয় স্বার্থে মেনে নেব।’

বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংক খাতের ভালোর জন্যই আমরা ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের সামনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ রয়েছে। সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে আমরা একটি নীতিমালা তৈরি করব কিভাবে একীভূত করা যায়। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করার জন্য পিসিএ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। আগামী বছরের মার্চ নাগাদ আমরা দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করতে পারব। এরপর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে কোন কোন ব্যাংক একীভূত করার প্রয়োজন রয়েছে। তখন সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে প্রণীত নীতিমালার আলোকে ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে।

মেজবাউল হক বলেন, অন্যান্য দেশের উদাহরণগুলো লক্ষ করলে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মালিকদের নিজস্ব উদ্যোগেই ব্যাংক একীভূত হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিদ্ধান্ত দিয়েছে। আমরাও চাই মালিকরা সিদ্ধান্ত নিক। যদি প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় তাহলে আমরা সিদ্ধান্ত জানাব।

এ দিকে দেশের ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে গত ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পিসিএ নামক একটি ফ্রেমওয়ার্ক দেয়া হয় ব্যাংকগুলোর জন্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জারিকৃত পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক ২০২৫ সালের মার্চ থেকে কার্যকর হবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে সব ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীকে পিসিএ বাস্তবায়ন কমিটি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ‘খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি থেকে উত্তরণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ সভায় একটি রোডম্যাপও উপস্থাপন করা হয়। সেটিও অনুমোদন হয়েছে। রোডম্যাপ অনুযায়ী লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একে একে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলে ব্যাংক আছে ৬১টি। এ থেকে ৪৫টিতে নামিয়ে আনা হতে পারে। গভর্নরও এ বিষয়ে এর আগে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গত ৩১ জানুয়ারি ব্যাংক নির্বাহীদের সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বলেন, ‘আমরা একীভূতকরণের মাধ্যমে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনতে চাই।’ তখন একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানতে চান, ‘একীভূতকরণ প্রক্রিয়াটি কি পর্ষদের সাথে পর্ষদ হবে নাকি ব্যালান্সশিটের সাথে ব্যালান্সশিট?’ জবাবে গভর্নর বলেন, ‘ব্যালান্সশিটের সাথে ব্যালান্সশিট একীভূত হবে। দু’টি ব্যাংক নিজে থেকে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দিলে সেটিও বিবেচনায় নেয়া হতে পারে।’ এ সময় গভর্নর ব্যাংকের সংখ্যা ৬১ থেকে কমিয়ে ৪৫-এ নামিয়ে আনার মনোভাব প্রকাশ করেন বলে ওই বৈঠক সূত্র জানিয়েছে।

এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষিত রোডম্যাপের প্রধান লক্ষ্য হলো ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ১০ ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিতের মাধ্যমে সীমার বাইরে দেয়া ঋণ, বেনামি স্বার্থসংশ্লিষ্ট ঋণ এবং জালিয়াতি বা প্রতারণার মাধ্যমে দেয়া ঋণ বিতরণের পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।

খেলাপি ঋণের হার ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য বাস্তবায়নে ঘোষিত কর্মপরিকল্পনার মধ্যে খেলাপি ঋণ অবলোপন, অবলোপনকৃত ঋণ আদায় জোরদার, বেসরকারি খাতে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন, ঋণখেলাপিদের আর ছাড় না দেয়ার পরিকল্পনা, খেলাপির মেয়াদ গণনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চর্চাসহ বেশকিছু পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরা হয়েছে। আর করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠায় শেয়ারধারী পরিচালকদের যোগ্যতা নির্ধারণ, যোগ্য স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ প্রক্রিয়া কঠোর করা, সীমার বেশি ঋণ না দেয়া, দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সাথে একীভূত করার পরিকল্পনা রূপরেখায় স্থান পেয়েছে।

ব্যাংক উদ্যোক্তাদের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রের তথ্য মতে, দেশের কয়েকটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক একে অন্যের সাথে একীভূত হওয়ার বিষয়ে উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। বর্তমানে দেশে শরিয়াহভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ ধারার ব্যাংকের সংখ্যা ১০। আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে এ সংখ্যা পাঁচ-ছয়টিতে নেমে আসতে পারে। দেশের প্রথম প্রজন্মের কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকও একে অন্যের সাথে একীভূত হওয়ার আলোচনা চলছে। আবার চতুর্থ প্রজন্মের একাধিক ব্যাংকও দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের ব্যাংকের সাথে একীভূত হতে পারে। সেটি হলে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের সংখ্যাও কমে আসবে।

করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাংকের শেয়ারধারী পরিচালকদের যোগ্যতা ও দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কিত নীতিমালা সংশোধন করা হবে বলে কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, যোগ্য পরিচালক নির্বাচিত হলে ব্যাংকের করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত হবে, যা ব্যাংকের সামগ্রিক ঋণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করবে।

রোডম্যাপে বলা হয়, ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ, তাদের সম্মানী নির্ধারণ এবং দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কিত নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। উপযুক্ত স্বতন্ত্র পরিচালক নিযুক্ত হলে আমানতকারী ও শেয়ারধারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ হবে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ ও পুনঃনিয়োগের বাছাই প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা আগামীতে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। এমডিদের কর্ম মূল্যায়নে পারফরম্যান্স নির্দেশক যুক্ত হবে। এটি হলে দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ পাবেন।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/818892