৪ মার্চ ২০২৪, সোমবার, ৭:২০

শুল্ক কমানোর প্রভাব নেই বাজারে

নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দাম কমাতে, এলসি মার্জিন শিথিল ও আমদানি শুল্ক কমানোসহ একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। জাতীয় সংসদে আলোচনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন। তবে দাম খুব বেশি কমছে না। উলটা বেড়েই চলেছে। যেমন- ১লা মার্চ থেকে সয়াবিন তেলের দাম কমানোর ঘোষণা দেয়া হলেও বাস্তবে বাজারে বিক্রি হচ্ছে আগের বাড়তি দরেই। ফলে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে ভোক্তাদের।

বিক্রেতারা জানান, কোনো কোম্পানি এখনো তাদের নতুন দরের বোতলজাত তেল সরবরাহ করেনি। খোলা সয়াবিনেও আগের দাম রাখছেন ডিলাররা। তবে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, আগামী দু-একদিনের মধ্যে খুচরা বাজারে ভোজ্য তেল প্রতি লিটার ১৬৩ টাকা দরে বিক্রি শুরু হবে।

ক্রেতারা জানান, দেশে যেকোনো নিত্যপণ্যের দর বাড়ানোর খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎগতিতে বাজারে ওই পণ্যের দর বেড়ে যায়। কিন্তু দাম কমানোর ঘোষণা দেয়া হলেও তা কার্যকর হতে সপ্তাহ পেরিয়ে যায়।

এদিকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দু’দিনের মাথায় বাড়ানো হয় পাইকারি ও খুচরা বিদ্যুতের দাম।
নতুন দাম ফেব্রুয়ারি থেকেই কার্যকর হয়েছে। এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এবারের বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে সাধারণ গ্রাহকদের ওপর কোনো চাপ পড়বে না। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এ মন্তব্য করেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাজার পরিস্থিতি এমনিতেই মানুষের নাগালের বাইরে। এ অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ায় মূল্যস্ফীতি হবে ভয়াবহ। সব ধরনের পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। কারণ জ্বালানি এমন একটি খাত, যার মূল্যবৃদ্ধি সবকিছুর ওপর প্রভাব ফেলে।
বাজারে রমজানের আগেই প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। মোটা দাগে এখন বাজারে চিনি, ভোজ্য তেল, গরুর মাংস, মসুর ডাল, অ্যাংকর ডাল, খেসারি ডাল, ছোলা ও পিয়াজের দাম বেড়েছে। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সামনে রমজান, ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফার প্রবণতার ফলে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।

গত ২২শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফসি) দেশে উৎপাদিত লাল চিনির কেজিতে ২০ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল। মুহূর্তেই উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে বাজারে। তাতে পাইকারি পর্যায়ে পরিশোধিত সাদা চিনির বস্তায় (৫০ কেজি) ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেড়ে যায়। খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যেও অনেকে ১৪৪ টাকার প্যাকেট ১৬০ টাকায় বিক্রি শুরু করেন। তবে বিএসএফসি’র দাম বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন জারির প্রায় ৬ ঘণ্টা পর তা প্রত্যাহার করে নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাজারে সেই বাড়তি দাম রয়ে গেছে।

এই ঘোষণার দু’দিন আগে অর্থাৎ ২০শে ফেব্রুয়ারি আমদানিকারকরা প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দর ১০ টাকা কমানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। নতুন দর অনুযায়ী, বোতলজাত প্রতি লিটারে দর ১৬৩ এবং ৫ লিটারের দর ৮০০ টাকা হওয়ার কথা। আর খোলা প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম হওয়ার কথা ১৪৯ টাকা। যদিও ওইদিন তারা বলেছিলেন, নতুন দর কার্যকর হবে ১লা মার্চ থেকে। সেই হিসাবে শুক্রবার নতুন দরে তেল বেচাকেনা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে সেই চিত্র দেখা যায়নি।

ঢাকার কারওয়ান বাজার, মালিবাগ, মহাখালী কাঁচাবাজারসহ কয়েকটি বাজারে বোতলজাত প্রতি লিটার ১৭৩, ৫ লিটার ৮৪৫ ও খোলা প্রতি লিটার ১৫৭ থেকে ১৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারগুলোয় দরকষাকষির মাধ্যমে লিটারে দু-তিন টাকা ছাড় পাওয়া গেলেও পাড়া-মহল্লায় সেই সুযোগ পাচ্ছেন না ভোক্তারা।

বাজারে ক্রেতা আবুল হোসেন বলেন, যখন কোনো পণ্যের দাম বাড়ে কোম্পানিগুলো সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়ে দেয়। দোকানদাররা সঙ্গে সঙ্গে তা কার্যকর করে ফেলেন। কিন্তু দাম কমানোর সময় এমনভাব করে যেন তারা বিষয়টি জানেই না।

কনজুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ১০ দিন আগে ঘোষণা দিলেও বাজারে কম দরের তেল সরবরাহ না করা কোম্পানিগুলোর গাফিলতি। এটি ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।

রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মসলার বাজারে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এলাচের দাম। প্রতি কেজি এলাচের দাম বেড়েছে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত। মানভেদে প্রতি কেজি এলাচ খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকায়। যা এক সপ্তাহ আগেও বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ এখন প্রতি ১০০ গ্রাম এলাচ কিনতে হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০টাকায়।

বাজারে প্যাকেটজাত মসলা সরবরাহ কোম্পানিগুলোও তাদের মসলার দাম বাড়িয়েছে। হলুদের গুঁড়ার ছোট প্যাকেটের দাম ৫৫ টাকা থেকে ১০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৬৫ টাকা। মরিচের গুঁড়ার দাম ১০ টাকা বেড়ে হয়েছে ১০০ টাকা। গরুর মাংসের মসলা ২০ টাকা থেকে ৫ টাকা বেড়ে হয়েছে ২৫ টাকা। মুরগির মাংসের মসলার প্যাকেট ১ টাকা থেকে ২ টাকা বেড়ে হয়েছে ২০ টাকা।

অন্যদিকে, বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে পিয়াজ, যা প্রতি কেজি ১২০ টাকা। এখনো পিয়াজের দাম কমার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি বাজারে। এ ছাড়াও আদা-রসুনের দাম বেড়েছে ২০ টাকা পর্যন্ত। প্রতি কেজি ২৪০ টাকার নিচে আদা বা রসুন কেনা যাচ্ছে না।

রামপুরা বাজারে বিক্রেতা ইউনুস হোসেন বলেন, এবার রোজার অনেক আগে থেকেই ছোলা খেসারি ডালসহ অন্যান্য সব ডালের দাম চড়া। গত দুই-তিন মাসের ব্যবধানে হিসাব করলে আগের তুলনায় প্রতি কেজি ডালের দাম ২০-৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশ পাইকারি ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শফি মাহমুদ বলেন, ডালের আমদানি খরচ বাড়ছে। ডলারের দামের কারণে এ অবস্থা। তবে রমজানের প্রয়োজনীয় অধিকাংশ ডাল দেশে আমদানি হয়েছে। রমজানের মধ্যে নতুন করে দাম বাড়ার সম্ভাবনা নাই, কমারও সম্ভাবনা কম।

এদিকে সরকার বারবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করছে, শুল্ক কমানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে, বাজার মনিটরিং করছে। কিন্তু কোনোকিছুতেই প্রত্যাশিত ফল আসছে হচ্ছে না; বাজার উল্টো আচরণ করছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ২০শে ফেব্রুয়ারি একটি সভা করে ব্যবসায়ীদের নিয়ে। সেখানে এক উপস্থাপনায় তুলে ধরা হয়- আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম ২৮.২৩ শতাংশ, অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ২৯ শতাংশ ও পিয়াজের দাম ৮৩ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।

বিবিএস’র হিসাব বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯.৫৬ শতাংশে। গ্রামে এই হার ৯.৪১ শতাংশ ও শহরে ৯.৯৮ শতাংশ।

https://mzamin.com/news.php?news=100155