৪ মার্চ ২০২৪, সোমবার, ৭:১৯

প্রাণে বাঁচলেও পিছু ছাড়ছে না আতঙ্ক

আগুনের লেলিহান শিখায় বিধ্বংসী ভবনে ঠাহর করা মুশকিল তখন ঠিক কেমন ছিল এর এক-একটি তলা। পুরো সাত তলা ভবনটিকে একেবারে বিবর্ণ করে দিয়েছে আগুনের বিধ্বংসী উত্তাপ। ভয়াবহ যে আগুনের উত্তাপ কেড়ে নিয়েছে ৪৬টি তাজা প্রাণ। বলছি, রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিনকজি কটেজ ভবনের কথা। বৃহস্পতিবার যেখানে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের করুণ মৃত্যু হয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে অর্ধশতাধিকের বেশি। ২২ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এখনও সেখানে ভর্তি রয়েছেন শঙ্কিত ৩ জন। ভয়াবহ আগুনের লেলিহান শিখার কবল থেকে বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে কেউই এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন না। প্রাণে বেঁচে গেলেও আতঙ্ক এখন তাদের পিছু ছাড়ছে না। রাতে ঘুমাতে গিয়ে চোখ বুজলেই কানের কাছে বাজে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ চিৎকার। মৃত্যুর মুখে থাকা মানুষের জীবন বাঁচানোর এ আর্তচিৎকার তাদেরকে দুচোখের পাতা এক করতে দেয় না।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ফরিদুল ইসলাম সেদিনের আগুন থেকে প্রাণে বেঁচে গেছেন। চিকিৎসক বলছেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীনরা এখনও শঙ্কায় রয়েছেন। যারা চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন-তারাও ট্রমায় ভুগছেন। অর্থাৎ বেইলি রোডের ভয়াবহ আগুনের প্রত্যক্ষদর্শীদের স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন ঘটেছে। অগ্নিকাণ্ডের সময় ভবনের ৫ম তলায় গিয়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন ফরিদুল ইসলাম। নিজের প্রাণ বাঁচাতে এক পর্যায়ে তিনি ঝুলন্ত তার বেয়ে ভবনের বাইরে এসির অংশে ঝুলে ছিলেন। ওই সময় তীব্র আগুনের তাপে তার প্রাণ প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল। কোনো উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে লাফ দিয়ে তিনি নিচে পড়েন। এরপর মারাত্মক আহত অবস্থায় তিনি ভর্তি হন হাসপাতালে।

ঘটনার তিন দিন পরও জীবন ফিরে পাওয়া ফরিদুল ইসলাম স্বাভাবিক হতে পারেননি। হাসপাতালে বিদ্যুতের বাল্ব দেখেও এখন তিনি চমকে ওঠেন। ওয়াশরুমের বাতির সুইচে হাত দিয়ে আলো জ্বালালেও এখন তিনি ভয় পাচ্ছেন। কেন এমন হচ্ছে-ফরিদুল ইসলাম জানালেন, নিচ চোখে দেখেছেন দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুন আর ধোঁয়ার বিষাক্ত নীল ছোবল। যে ছোবলে চোখের সামনে নিভে গেছে অনেকের জীবনপ্রদীপ। মৃত্যুর আগে প্রত্যেকের বাঁচার তীব্র আকুতি তিনি নিজ কানে শুনেছেন। কিন্তু মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ওই মানুষগুলোকে উদ্ধার করতে তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারেননি। তেজগাঁও কলেজে মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ফরিদুল ইসলাম ফুড পান্ডায় রাইডার হিসাবে কাজ করেন। বৃহস্পতিবার রাতে কাচ্চি ভাই থেকে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়েই ওই ভবনে আটকা পড়েন। তিনি বললেন, চোখের সামনে ভেসে ওঠে মৃত্যু-বাঁচার আকুতি। সারাক্ষণ ভয় হয়। ঘিরে থাকে আতঙ্ক।

সেদিনের আগুন থেকে বেঁচে যাওয়া সোমাইয়া বলছিলেন, ‘মনে হচ্ছে এখনই বুঝি কিছু একটা ঘটবে। আগুন-ধোঁয়া বুঝি এখনই গ্রাস করবে।’ আতঙ্ক এভাবেই তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে যে, হাসপাতালে শুয়ে তিনি ঘুমোতেই পারছেন না। ঘুমোতে গেলে মনে হচ্ছে তার দম যেন আটকে আসছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বারেবারে চোখের সামনের ফিরে ফিরে ভাসছে সেই রাতের সেই ভয়াবহ দৃশ্য। সোমাইয়া বলেন, তিনিও মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন। সঙ্গে থাকা স্বামীকেও তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন ধোঁয়ার কারণে। অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। একপর্যায়ে জ্ঞান ফিরলে তিনি টয়লেটে আশ্রয় নেন। পানি ঢালতে থাকেন শরীরে। তিনিসহ স্বামী বেঁচে গেলেও সব সময় তাড়া করছে সেই ভয়াবহ দৃশ্য।

ফয়সাল আহমেদ ছাড়া পেয়েছেন হাসপাতাল থেকে। তার সঙ্গে কথা বলতেই চোখে অশ্রু গড়াচ্ছিল। চোখে-মুখে আতঙ্কের ছায়া। তিনি বললেন, কিছুতেই অস্থিরতা কাটছে না। এখন তিনি কোনো কিছুর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারেন না। অত্যন্ত কাছ থেকে যে মৃত্যু আর হাহাকার দেখেছেন, তা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে কাউকে বাঁচাতে পারেননি ভেবে এখন নিজেকেও তিনি দোষী মনে করছেন।

আরেক তরুণ আফজাল হোসেন বলছিলেন, প্রায়ই যেতেন কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে। ওই দিন খাবারের অর্ডার দিতেই তিনি অগ্নিকাণ্ডের শিকার হন। প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা-এ কথা জানিয়ে তিনি বললেন, ‘জানের সাদকা দেব, নামাজ পড়ব, আল্লাহ-রাসুল পাকের পথে চলব। কিন্তু আমি যে কিছুই ভুলতে পারছি না। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সেই ভয়াবহ দৃশ্য। চোখ বুজলেই কেমন যেন ভয় হয়।’ একই অবস্থা বেঁচে যাওয়া সুজন মন্ডল, প্রহিত, অবিনা, রাকিব, কাজি নওশাদ, আব্রার, মেহেদী হোসেনসহ অনেকের।

জহিরুল ইসলাম বলছিলেন, কী করে বেঁচে আছেন জানেন না। এটা জানেন ধোঁয়ায় তিনি জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিলেন। জ্ঞান ফিরলে দেখেন তিনি অ্যাম্বুলেন্সে। হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছেন। মন থেকে কিছুতেই তিনি আগুনের সেইসব ভয়াবহ দৃশ্য মুছে ফেলতে পারছেন না। উধাও হয়ে গেছে তার রাতের স্বস্তির ঘুম।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/780831