৪ মার্চ ২০২৪, সোমবার, ৭:১৫

ফায়ার লাইসেন্স ও গ্যাস সংযোগ অবৈধ ফ্লোরে

আবাসিকের অনুমোদন থাকা ফ্লোর বাণিজ্যিক ব্যবহারের বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা

রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিনকজি কটেজ ভবন ব্যবহারে পদে পদে মিথ্যা তথ্য ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। ভবনটি নকশা অনুযায়ী নির্মাণের কথা বলা হলেও অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। ওপরের তিনটি ফ্লোর আবাসিক ব্যবহারের কথা থাকলেও সেগুলোতেও রেস্টুরেন্ট করা হয়েছে। আবাসিকের অনুমোদন থাকা ভবনটির অষ্টমতলার বাণিজ্যিক ব্যবহার হলেও সেখানে তিতাস গ্যাস তাদের সংযোগ দিয়েছে। একই ফ্লোরে ফায়ার লাইসেন্স দেয় ফায়ার সার্ভিস। কেবল অগ্নিনিরাপত্তাই নয়, নিশ্চিত করা হয়নি ভবন ব্যবহারে রাজউকের সাধারণ নির্দেশনাও। ফায়ার লাইসেন্স গ্রহণেও বিভিন্ন জায়গায় তথ্য গোপন করা হয়েছে। তদারক কর্তৃপক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করেই হয়েছে এসব অনিয়ম।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানিয়েছে, বেজমেন্টসহ গ্রিনকজি কটেজ মূলত একটি নয়তলা ভবন। রাজউক থেকে দ্বিতীয় থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ছয় থেকে আটতলা পর্যন্ত আবাসিক হিসাবে ব্যবহার হওয়ার কথা। এছাড়া নিচতলাও বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে বেজমেন্টে পার্কিংয়ের জায়গা আছে। অথচ ভবনটিতে কোনো আবাসিক ফ্লোর ছিল না। প্রতিটি ফ্লোরই ব্যবহার হয়েছে বাণিজ্যিক হিসাবে। এরপরও আটতলায় একটি বৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে তিতাস।

এ অবস্থার মধ্যেও গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর ২২টি শর্ত দিয়ে ভবনের অষ্টমতলার একটি রেস্টুরেন্টের ফায়ার লাইসেন্স নবায়ন করা হয়েছে। আমব্রোসিয়া রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড মিউজিক ক্যাফেকে এই লাইসেন্স প্রদান করা হয়। অথচ রাজউকের অনুমোদন অনুযায়ী এখানে রেস্টুরেন্টই থাকার কথা নয়। ফায়ার সার্ভিস এখানে শর্তগুলো জুড়ে দিয়ে ৬০ দিনের মধ্যে বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে তাদের দায় সেরেছে। এই সময়ের মধ্যে অগ্নিদুর্ঘটনায় জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতি হলে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে বলেও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট ভবনের ফায়ার লাইসেন্স অনুমোদনে স্বাক্ষর দেওয়া ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর অধীর চন্দ্র হাওলাদার যুগান্তরকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলুন।’

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘মূলত তদবিরের কারণেই ফায়ার সার্ভিস লাইসেন্সটি দিতে বাধ্য হয়েছে। একজন রীতিমতো এজন্য ব্ল্যাকমেইল করেছেন।’

শুক্রবার পুড়ে যাওয়া ভবনটি পরিদর্শনে এসে এ বিষয়ে কথা বলেছিলেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। তখন তিনি বলেন, যে ভবনে আগুন লেগেছে এটাকেও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে।

মানেনি ফায়ার লাইসেন্সের শর্ত : উল্লেখযোগ্য শর্তগুলোর মধ্যে ছিল-ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃক ফায়ার সেফটি প্ল্যান অনুমোদন করা। সে মোতাবেক বাস্তবায়ন করা। ইলেকট্রিক পাম্প, ডিজেল পাম্প ও জকিপাম্প স্থাপন করা। ন্যূনতম ৫০ হাজার গ্যালন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ওয়াটার রিজার্ভার স্থাপন করা। ক্লাস থ্রি হাইড্রেন্ট স্থাপন, এসেম্বিলি পয়েন্ট নির্ধারণ করা। ২০ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে প্রশিক্ষণ ও বছরে ২টি ফায়ার ড্রিল করা। জেনারেটর বা সাবস্টেশন রুমের চারদিকের ৪ ঘণ্টা ফায়ার রেটেড ওয়াল এবং দুই ঘণ্টা ফায়ার রেটেড ডোর স্থাপন করা। প্রয়োজন অনুযায়ী স্মোক ডিটেক্টর, হিট ডিটেক্টর ও ভিম ডিটেক্টর স্থাপন করা। ব্যাটারি অথবা আইপিএস ব্যাকআপ ইমার্জেন্সি লাইট স্থাপন করা। ফায়ার এলার্ম স্থাপন এবং বিভিন্ন সাইন অ্যান্ড ইন্ডিকেশন স্থাপন করা। ভবনটিতে এলপিএস স্থাপন করা ও অগ্নিপ্রতিরোধক ফলস সিলিং স্থাপন করা। ভবনটির যেসব স্থান দিয়ে বৈদ্যুতিক তার প্রবেশ করেছে তা ফায়ার স্টপার দিয়ে বন্ধ করা।

গ্রিনকজি কটেজ ভবন কর্তৃপক্ষ এসব শর্তের কোনো তোয়াক্কাই করেনি। এ কারণেই আগুনে প্রাণহানি বেড়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) এবং তদন্ত কমিটির প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, একটি শর্তও তারা ঠিকভাবে পালন করেনি। প্রতিটি নির্দেশনা উপেক্ষিত হয়েছে। এত ক্ষয়ক্ষতি এসব কারণেই হয়েছে। আমাদের নির্দেশনাগুলো মানলে জীবন ও সম্পদহানি অনেকাংশেই কমিয়ে আনা যেত।

ভবন নির্মাণে নকশার ব্যত্যয় হয়নি বলে দাবি রাজউকের। তবে ব্যবহারে অনিয়মের কথা স্বীকার করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (সচিব) মো. আনিছুর রহমান মিঞা রোববার যুগান্তরকে বলেন, বেইলি রোডের ভবনটি নকশা অনুযায়ী হয়েছে। তবে সমস্যা হয়েছে এর ব্যবহারে। অফিস ও আবাসিকের জন্য নেওয়া অনুমোদনের জায়গাঢও রেস্টুরেন্ট করা হয়েছে।

রাজউক তাহলে ব্যবস্থা নেয়নি কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের আওতায় পাঁচ লাখের বেশি ভবন আছে। আমাদের স্বল্প জনবল দিয়ে এতসংখ্যক ভবনের তদারকি সম্ভব হয় না। মনিটরিংয়ের ঘাটতির সুযোগ নিয়ে অনেকে এই কাজগুলো করছে। এ অবস্থায় রাজউক ছাড়া অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা ভবন ব্যবহারের অনুমোদনের সঙ্গে যুক্ত তাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভবনের ধরন দেখে তাদের অনুমোদন দিতে হবে। তাহলে পরিস্থিতির অনেকাংশে উন্নতি ঘটবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/780818