৪ মার্চ ২০২৪, সোমবার, ৭:০৮

বিইআরসির এলপি গ্যাস মূল্য মানছে না কেউ

বাড়তি অর্থই দিতে হচ্ছে ভোক্তাদের

তরলিকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) নতুন মূল্য প্রতি মাসেই ঘোষণা করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। কিন্তু বিইআরসির ঘোষিত এ মূল্য কেউ মানছে না। বাড়তি মূল্যই পরিশোধ করতে হচ্ছে ভোক্তাদের। গত মাসের শুরুতে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ৪১ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৭৪ টাকা করা হয়েছিল। কিন্তু বাজারে কোনো কোম্পানির গ্যাসই এ দামে পাওয়া যায়নি। সর্বনি¤œ ১ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এমনি পরিস্থিতিতে গতকাল আবারো ৮ টাকা বাড়িয়ে দাম ১ হাজার ৪৮২ টাকা পুনর্নির্ধারণ করেছে বিইআরসি। নতুন এ দর গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকেই কার্যকর হয়েছে।

গতকাল রোববার বিইআরসি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন এ দর ঘোষণা করা হয়। বিইআরসির চেয়ারম্যান মো: নূরুল আমিন এই ঘোষণা করেন।

গতকাল রামপুরা, বনশ্রী ও এর আশপাশে কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজারে কোনো কোম্পানির ১২ কেজি এলপি সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ৬০০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। বনশ্রী এফ ব্লকের ৫ নং রোডের এক বিক্রেতা জানান, বেক্সিমকো ছাড়া ওমেরা, ওরিয়নসহ তার কাছে থাকা বিভিন্ন কোম্পানির ১২ কেজি সিলিন্ডার বিক্রি করছেন ১ হাজার ৬০০ টাকা। আর বেক্সিমকো ১২ কেজি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ টাকা। অপর দিকে মেরাদিয়া মধ্যপাড়ার এক বিক্রেতা জানান, বসুন্ধরার এলপি গ্যাসের সরবরাহ অনেক দিন যাবৎ বন্ধ। বেক্সিমকো ১২ কেজি সিলিন্ডার ১ হাজার ৭০০ টাকা, আর অন্য কোম্পানিগুলোর ১২ কেজি বোতল বিক্রি করতে হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ টাকা। বিইআরসির বেঁধে দেয়া দামের বিষয়ে ওই বিক্রেতা জানান, তাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তাই বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে।

এ দিকে গত দুই মাস যাবত এলপি গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এতে ভোক্তারা পড়েছেন বিপাকে। এক দিকে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ ২০০৯ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে। এর পর থেকে যে নতুন গ্রাহক আসছেন তাদের এলপি গ্যাসের ওপরই নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য এলাকায় যেসব নতুন বাড়ি হচ্ছে ওইসব বাড়ির বাসিন্দা ও ভাড়াটিয়ারা এলপি গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। এক দিকে প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়ছে সেই সাথে গত দুই মাস যাবৎ টানা গৃহস্থালীতে ব্যবহৃত অতি প্রয়োজনীয় এ এলপি গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ না থাকায় গ্রাহকদের দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। কিন্তু এ বিষয়ে যেন কারো কিছু করার নেই।

জানা গেছে, বিইআরসি ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে প্রতি মাসে এলপিজির দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে। এলপিজি তৈরির মূল উপাদান প্রোপেন ও বিউটেন বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। প্রতি মাসে এলপিজির এ দুই উপাদানের মূল্য প্রকাশ করে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান আরামকো। এটি সৌদি কার্গো মূল্য (সিপি) নামে পরিচিত। এই সৌদি সিপিকে ভিত্তিমূল্য ধরে দেশে এলপিজির দাম সমন্বয় করে বিইআরসি।

বিইআরসির নতুন দর অনুযায়ী, বেসরকারি এলপিজির মূল্য সংযোজন করসহ (মূসক/ভ্যাটসহ) দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কেজি প্রায় ১২৩ টাকা ৫২ পয়সা, যা গত মাসে ছিল ১২২ টাকা ৮৬ পয়সা। এই হিসাবে বিভিন্ন আকারের এলপিজি সিলিন্ডারের দাম নির্ধারিত হবে।

তবে বিইআরসির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে সেসব বিক্রেতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, ভবিষ্যতেও নেয়া হবে।

একই দেশে তিন রকম গ্যাসের দাম দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। যেমন- যেসব গ্রাহকের বাসায় গ্যাস বিতরণকারী সংস্থা তিতাসের প্রিপেইড মিটার বসানো হয়েছে, তারা যতটুকু গ্যাস ব্যবহার করেন, ততটুকুই বিল দিতে হয়। যাদের বাসায় প্রিপ্রেইড মিটার বসানো হয়নি, তাদেরকে দুই চুলার জন্য ১ হাজার ৮০ টাকা মাসে পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু একই শহরে বাস করে যাদের বাসায় পাইপ লাইনের গ্যাস নেই তাদেরকে সিলিন্ডারের পেছনে ১ হাজার ৬০০ টাকা থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশে গ্যাস বিতরণকারী ৬টি কোম্পানির গ্রাহক সংখ্যা ৩৮ লাখ। ২০০৯ সাল থেকে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। এর ফলে এলপি গ্যাসের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে নতুন গ্রাহকদের। অপর দিকে বেসরকারি হিসেবে দেশে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডারের ব্যবহার বাড়ছে। ২০১৫ সালে যেখানে এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৫৬ লাখ ২০ হাজার। সেখানে ২০২২ সালে ব্যবহারকারী দাঁড়িয়েছেন ৩ কোটি ৯১ লাখে। নিরাপদ ও সাশ্রয়ী হওয়ায় প্রতিনিয়ত ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে এক সময় এলপিজির খালি সিলিন্ডার আমদানি করা হতো। বর্তমানে দেশের ১৪টি কোম্পানি সিলিন্ডার উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। আরও দু’টি কোম্পানি বাজারে আসার অপেক্ষায়। স্থানীয়ভাবে মানসম্মত সিলিন্ডার উৎপাদন করায় আমদানিনির্ভরতা কমেছে। এ খাতে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। বাজারে এলপিজি সিলিন্ডারের চাহিদার বেশির ভাগ স্থানীয় কোম্পানিগুলো জোগান দিচ্ছে।
তবে এ খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ২০১৮ সালে দেশের এলপিজি সিলিন্ডারের চাহিদার ৬১ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সিলিন্ডার থেকে জোগান দিয়েছে, যা ২০২৫ সালে গিয়ে দাঁড়াবে ৩৭ শতাংশে। বর্তমানে ১৪টি কোম্পানির উৎপাদন ক্যাপাসিটি রয়েছে প্রায় এক কোটি ৮ লাখ পিস। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সিলিন্ডার চাহিদার বেশির ভাগ জোগান দেয়ার পরও কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়েছে। এর একমাত্র কারণ হলো সিলিন্ডার আমদানি। সে জন্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে আগামী বাজেটে সিলিন্ডার আমদানিতে শুল্ককর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বেসরকারি এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীদের সংগঠন এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলওএবি)। একই সাথে দেশীয় কোম্পানিকে টিকিয়ে রাখতে সিলিন্ডার উৎপাদনে ব্যবহুত কাঁচামালের শুল্ককর কমানোরও প্রস্তাব করা হয়েছে।

এলওএবির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে দেশে এলপিজি সিলিন্ডারের বাজার ছিল ৫৬ লাখ ২০ হাজার, যা ২০২২ সালে ৩ কোটি ৯১ লাখে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ আট বছরে সিলিন্ডার উৎপাদন বেড়েছে তিন কোটি ৩৪ লাখ ৮০ হাজার। প্রতি বছর চাহিদার সাথে সাথে এলপিজি সিলিন্ডারের উৎপাদন জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। ২০১৬ সালে উৎপাদন হয়েছে ৮৭ লাখ ৩০ হাজার, ২০১৭ সালে এক কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার, ২০১৮ সালে এক কোটি ৯৪ লাখ ১৬ হাজার, ২০১৯ সালে দুই কোটি ৪১ লাখ ৭৭ হাজার ৮০০, ২০২০ সালে তিন কোটি ১৪ লাখ ২১ হাজার ৭৮২ ও ২০২১ সালে তিন কোটি ৪৪ লাখ ৭২ হাজার ৩৫৭টি।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/818640