৩ মার্চ ২০২৪, রবিবার, ৪:০৩

ভবনজুড়ে রেস্তোরাঁ, অনিয়মে ভরা

ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের কেয়ারি ক্রিসেন্ট ভবনের জরুরি নির্গমন সিঁড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার সমকাল

রাজধানীর ধানমন্ডিতে জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড মোড়ে ১২ তলা ‘কেয়ারি ক্রিসেন্ট ভবনে’ রেস্তোরাঁ আছে ১৬টি। ভবনের পেছনে জরুরি নির্গমন সিঁড়িতে রাখা রেস্তোরাঁর মালপত্র। সপ্তম তলায় ঘুটঘুটে অন্ধকার সিঁড়ি বন্ধ হয়েছে এতে। আগুন লাগলে ওপর থেকে নামার উপায় নেই। ষষ্ঠ ও পঞ্চম তলার সিঁড়িতে আটটি গ্যাস সিলিন্ডার রাখা।

গতকাল শনিবার দুপুরে কেয়ারি ক্রিসেন্ট ভবনে গিয়ে দেখা যায় এই চিত্র। বেইলি রোডের আগুনে ৪৬ প্রাণ গেলেও বাণিজ্যিক ভবনে রেস্তোরাঁর মালিকদের টনক নড়েনি। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) বলেছে, বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডের সময় সিঁড়িতে রাখা গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে, প্রাণহানি বেড়েছে।

বেইলি রোড ছাড়াও রাজধানীর মিরপুর, ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান, খিলগাঁও, পুরান ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোড ও ধানমন্ডিতে আবাসিক ভবনে নিয়ম না মেনে গড়ে উঠেছে হাজারো খাবারের দোকান। বাণিজ্যিক ভবনে অফিস করার অনুমতি থাকলেও রেস্তোরাঁ বানাতে আলাদা অনুমতি লাগে। কিন্তু সেই অনুমতির তোয়াক্কা করছেন না অধিকাংশ ভবন মালিক। ভবনে ভবনে বানিয়ে ফেলছেন ‘ফুড কোর্ট’। ‘ব্যাঙের ছাতা’র মতো গড়ে উঠেছে রেস্তোরাঁ, কফিশপ; যেগুলোর রান্নাঘরে গ্যাস সিলিন্ডার রাখার জায়গা নেই। ঝুঁকি নিয়ে সেসব রাখা হয়েছে সিঁড়িতে কিংবা যত্রতত্র।

ধানমন্ডি সাতমসজিদ রোডের দু’পাশের বহুতল ভবনগুলোর তলায় তলায় রয়েছে রেস্তোরাঁ। কোনো কোনো ভবনে রেস্তোরাঁ ৩০টি পর্যন্ত। অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা নেই; থাকলেও নামমাত্র। ধানমন্ডি ১৫ নম্বরের গাউছিয়া টুইট পিক ভবনে রেস্তোরাঁ ১৪টি। ভবনটির তিনতলা পর্যন্ত ব্যাংক ও শোরুম। চতুর্থ থেকে ১১ তলা পর্যন্ত রেস্তোরাঁ। কোনো কোনো তলায় তিনটি পর্যন্ত রেস্তোরাঁ রয়েছে।

ভবনটির নকশা করেছেন স্থপতি মোস্তফা খালিদ পলাশ। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, গাউছিয়া টুইন পিকে অগ্নিনিরাপত্তা নড়বড়ে। ‘নিজের নিরাপত্তার জন্য ভবনটি ব্যবহার করবেন না’– এমন আবেদন জানিয়ে গত শুক্রবার মধ্যরাতে তিনি লিখেছেন, ‘ভবনটি নিয়ে সত্যি উৎকণ্ঠায় থাকি। নকশা এবং অনুমোদন বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে হলেও এর ব্যবহারে বড় রকমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে একে সমূহ অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁ ভবনে রূপান্তর করা হয়েছে। স্থপতি হিসেবে শেষ যে ক্ষমতাটুকু রাজউক দিয়েছে, অকুপেন্সি সার্টিফিকেটের জন্য রিপোর্ট স্বাক্ষর করার, তার তোয়াক্কাও করা হয়নি। অকুপেন্সি সার্টিফিকেট না নিয়েই চলছে দেদার ব্যবসা।’

মোস্তফা খালিদ পলাশ জানান, ভবনটি ব্যবহারে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। তাই স্থপতি হিসেবে প্রতিবেদন এবং এজ বিল্ট ড্রইং না দিয়ে জমির মালিক ও ডেভেলপারকে বারবার সতর্ক করেছেন। ডেভেলপারের ভাষ্য, তাদের ফায়ার লাইসেন্স আছে; কিন্তু তা তারা দেখান না। জমির মালিক বলেন, ভাড়া হয় না তাই আর কী করা! এতে কাজ না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকার ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন মাস্টারকে বিষয়টি জানিয়েছেন বলে জানান মোস্তফা খালিদ পলাশ।

এই স্থপতি বলেন, ‘ভবনের অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থার অবনতি হয়েছে। ফায়ার ডোর খুলে ফেলা হয়েছে। ফায়ার স্টেয়ারকে স্টোররুমে রূপান্তর করা হয়েছে। যত্রতত্র রাখা হয় গ্যাস সিলিন্ডার।’ ফেসবুকে তাঁর স্ট্যাটাসের পর গতকাল সকালে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা ভবনটি পরিদর্শন করেন। এর আগেই জরুরি নির্গমন সিঁড়ি থেকে মালপত্র ও সিলিন্ডার সরানো হয় বলে জানা গেছে।

গাউছিয়া টুইন পিকের ১২ তলায় রয়েছে শিক্ষাবিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘লুমিনেজ’। প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসন বিভাগের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী মুকেতুন নূর নাহিদ সমকালকে বলেন, ‘ভবন কর্তৃপক্ষকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে চিঠি দিয়ে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু ফল হচ্ছে না। জরুরি নির্গমন সিঁড়িতে মালপত্র রাখা বন্ধ হয়নি।’ এই ভবনের ব্যবস্থাপক মো. সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলা সম্ভব হয়নি। ভবনের নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, তিনি কার্যালয়ে নেই। বিকেলে আবার কার্যালয়ে গেলে জানানো হয়, তিনি ফেরেননি। তাঁর ফোন নম্বর দেননি কার্যালয়ের কর্মচারীরা। লুমিনেজের কর্মকর্তারা জানান, ভবনে ফায়ার অ্যালার্ম, ফায়ার হাইড্রেন্ট রয়েছে; কিন্তু পর্যাপ্ত এক্সটিংগুইশার নেই। অগ্নিনির্বাপণ মহড়া হয় না। লুমিনেজে আইইএলটিএস, জিআরটি, পিআরসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পরীক্ষা হয়। পরীক্ষা কেন্দ্রের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অগ্নিনিরাপত্তার শর্ত থাকে। কিন্তু রেস্তোরাঁর কারণে তা মানা যায় না। ডেভেলপার ও ফ্লোর মালিকরা তা মানতে ইচ্ছুক নন।

জিগাতলার কেয়ারি ক্রিসেন্ট ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠতলার সিঁড়িতে সিলিন্ডার রেখে রেস্তোরাঁর রান্নাঘরে গ্যাস নেওয়া হয়েছে রাবারের সরু পাইপ দিয়ে। পঞ্চম তলার ‘ক্যাপিটাল লাউঞ্জ’ রেস্তোরাঁর মালিক হিমেল আহসান সমকালকে বলেন, ‘আগে আরও বেশি মালপত্র, আবর্জনা ও সিলিন্ডার সিঁড়িতে ছিল। বেইলি রোডের আগুনের পর সেগুলো সরানো হয়েছে।’ তাঁর দাবি, সিঁড়িতে রাখা গ্যাস সিলিন্ডার ক্যাপিটাল লাউঞ্জের নয়; পাশের ‘সাভোরি গ্রিন ক্যাফের’। সাভোরিতে গিয়ে মালিককে পাওয়া যায়নি। তবে কর্মচারীরা জানান, দ্রুতই সব সিলিন্ডার সরিয়ে নেওয়া হবে। সপ্তম তলায় রয়েছে রেস্তোরাঁ ‘ইউফোরিয়া’। এ প্রতিষ্ঠান মালপত্র রেখে বন্ধ করেছে সিঁড়ি। এই রেস্তোরাঁর মালিককেও পাওয়া যায়নি। কেয়ারি ক্রিসেন্ট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সুমন চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিটি রেস্টুরেন্টে বাধ্যতামূলক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখার শর্ত রয়েছে। যারা তা মানছে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে নিরাপত্তা বৃদ্ধির কাজ শুরু হয়েছে।’

সাতমসজিদ রোডের ‘ইম্পেরিয়াল আমিন আহমেদ সেন্টার’ ভবনটি ১৩ তলার। এই ভবনে রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকান রয়েছে অন্তত ২০টি। ভবনের ছাদেও রয়েছে রেস্তোরাঁ, নাম ‘দি ফরেস্ট লাউঞ্জ’। ভবনটির সিঁড়ি দুটি অপরিসর।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) জানিয়েছে, বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের আটটি রেস্তোরাঁর একটিরও অনুমোদন ছিল না। আমিন আহমেদ সেন্টারের কোনো রেস্তোরাঁর অনুমোদনের সনদ দেখা যায়নি। তবে প্রতিটি রেস্তোরাঁ মালিক দাবি করেন, তারা ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছেন। রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী জামিল হোসেন সমকালকে বলেন, ‘কেউ আলাদা সনদ ও ফায়ার সার্টিফিকেট নিয়ে ব্যবসা করে না।’

গতকাল দুপুরে ভবনটির ‘ক্যাফে রিও’তে খেতে আসা মোহাইমিনুল ইসলাম সমকালকে জানান, তিনি প্রায়ই সেখানে আসেন। ঢাকা শহরে পরিবার নিয়ে সময় কাটানোর মতো জায়গা নেই। তাই বাধ্য হয়েই ছুটির দিনে রেস্তোরাঁয় আসেন। তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন আগে এক অনুষ্ঠানে রাতের খাবারের সময় ভীষণ ভিড় ছিল। লিফট পেতে আধাঘণ্টা লাগে। শুক্র ও শনিবার রাতে বিয়েশাদির অনুষ্ঠান থাকে। তখন কয়েক হাজার মানুষ আসে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয় হুড়োহুড়ি করে। ওই সময় দুর্ঘটনা ঘটলে বেইলি রোডের চেয়ে ভয়ংকর অবস্থা হবে।’

https://samakal.com/capital/article/225688