৩ মার্চ ২০২৪, রবিবার, ৪:০০

ভবনের সিঁড়ি থেকে রুম পর্যন্ত ছিল নিথর দেহের ছড়াছড়ি

রাজধানীর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজে’ ভবনজুড়ে যেখানে মানুষের আনাগোনা আর হইহুল্লোড়ে মুখর থাকত দিন-রাত। সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল মানুষের নিথর দেহ। ভবনের দুইতলা থেকে সাততলার রুফটপ পর্যন্ত একই চিত্র। এছাড়া ভবনের সিঁড়িতেও পড়েছিল মানুষের নিথর দেহ। শুরু থেকে অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতিগ্রস্ত বহুতল ভবন উদ্ধার অভিযান চালানো একাধিক ফায়ার ফাইটারের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।

সেদিনকার ভয়াবহ স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন তারা। বলেন, আমরাও তো মানুষ, আমাদেরও তো সন্তান পরিবার আছে। মানুষের নিথর দেহ এত ভারী কাঁধে না তুললে বুঝা যাবে না। তারপরও দায়িত্ব পালন করতে হয়।

এ সময় ক্ষোভপ্রকাশ করে তারা বলেন, আমাদের নির্দেশনা মেনে ভবন নির্মাণ অথবা ফায়ার ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করলে এমন অনেক মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হতে হবে না।

ভবন সার্চ করা এক ফায়ার কর্মকর্তা বলেন, ভবনের ছাদের রুফটপ থেকে তিন জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর পর সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখা যায়, সিঁড়িতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে অনেকের মরদেহ। এর মধ্যে একজন পুড়ে গেছেন। এছাড়া বিভিন্ন রুমে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে নিথর দেহ। কারোর হাতে মোবাইল ফোন রয়েছে। সেখানে কলও আসছে। কিন্তু নিজের অবস্থায় জানাতে পারেনি। তার আগেই মারা যান।

আগুন লাগে ৯টা ৫০ মিনিটে। ফায়ার সার্ভিস সিদ্দিকবাজার ফায়ার স্টেশন থেকে দুটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য বের হয়। একটু পরেই ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তর সেন্ট্রাল কন্ট্রোল রুমে সাহায্য চেয়ে আরও ইউনিট পাঠাতে বলে উদ্ধারকারী দল। পরে ফায়ার সার্ভিসের টার্ন টেবল ল্যাডার (টিটিএল–৫৬) গাড়ি নিয়ে বের হন সিদ্দিকবাজার স্টেশন অফিসার শহিদুল ইসলাম সুমন। এই অফিসার ফায়ার ফায়টার সোহাগ চন্দ্র কর্মকারকে সঙ্গে নিয়ে টিটিএল থেকে পানি ছুড়ে আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনেন। এর আগেই অন্য ফায়ার ফায়টাররাও নিচ থেকে ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করেছিল।

শহিদুল ইসলাম সুমন সমকালকে বলেন, আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনার পরেই ভবনের ছাদে আটকা পড়াদের উদ্ধারে অভিযান শুরু করি। এ সময় প্রথমে ফায়ার ফাইটার সোহাগকে ছাদে নামিয়ে দেওয়া হয়। তিনি প্রথমে দুজনকে টিটিএলে উঠিয়ে দেন। ছাদের ওপরে একটি গ্লাসের রুম ভেঙে বাকিদের উদ্ধার করা হয়। এ সময় সেখানে আটকা পড়া মানুষদের একটি কথায় বলা হয়, ‘ফায়ার ফাইটাররা বেঁচে থাকতে, আপনাদের কারোর কিছুই হবে। সবাইকে উদ্ধার করা হবে।’ আটকা পড়া এক নারী বলছিলেন, আমরা হয়তো মরেই যেতাম আজকে। আল্লাহ আমাদের জীবন বাঁচাতে আপনাদের পাঠিয়েছেন। আপনাদের কথা ভুলবার না। বাকি জীবন আপনাদের জন্য দোয়া করেই যাব।

তিনি বলেন, আটকা পড়াদের উদ্ধারে তৃতীয় বার যখন টিটিএল উঠে। আর সেখান থেকে এক নারী ও তার শিশু মেয়েকে উঠানোর চেষ্টা করা হয়। তিনি স্বামীকে রেখে তিনি আসবেন না, কিন্তু সেখানে ছয় জনকে উঠানো হয়ে গেছে বলে তাকে নেওয়াও সম্ভব ছিল না। এ সময় ওই নারী কান্নাকাটি শুরু করেন। বলছিলেন, ‘আমি আজকে এতোই স্বার্থপর হয়ে গেলেম যে, তোমাকে মৃত্যুর মুখে রেখে চলে যেতে হচ্ছে। আর মেয়ে বলছিল, বাবা আঙ্কেলরা তোমাকে নিয়ে আসবে। পরের বারই তার স্বামীকে উদ্ধার করা হয়।’

শহিদুল ইসলাম সুমন আরও বলেন, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার মুহূর্তে এক যুবক বলেন, ‘ধরে নিয়েছিলাম আজকে মারা যাব। কিন্তু আল্লাহ আপনাদের মাধ্যমে বাঁচাল।’ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কেউ কেউ নামাজে দাঁড়িয়ে যান। ছাদে অবস্থান নেওয়া সবাইকে সুস্থভাবেই উদ্ধার করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ছাদের ওপর থেকে নারী ও শিশুসহ সবাইকে উদ্ধারের পর সেখানে সার্চ শুরু করি। সেখানে দেখা যায়, একটি টেবিলে নাস্তা দেওয়া। যেন কাউকে দেওয়ার পরেই এই ঘটনা ঘটে। সব ফেলে রেখে জীবন বাঁচাতে আকুতি জানাতে থাকে তারা। সেদিন টিটিএল ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি বহন করা হয়েছিল। মানুষের আহাজারিতে এমনটিই করা হয়েছে। নামিয়ে আনার সময় অনেকেই আমার নাম-পরিচয় জানতে চায়। কেউ আবার জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করে। বলে ভাই, ‘আপনি ফেরেশতার মতো আমাদের বাঁচিয়েছেন, আরও কত শত আবেগ তাড়িত কথা বলেছিল, সব স্মৃতিতে নেই।

ভবনের কোথায় ছিল এত নিথর দেহ
একটি সূত্রে জানা যায়, ওই ভবনে ‘কাঁচ্চি ভাই’ রেস্টুরেন্টের স্টোর রুম থেকে অধিকাংশ মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সেখানে কার্টন, পানির বোতল, পার্সেল ব্যাগসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের ওপরে পড়েছিল শিশু, নারী ও পুরুষের মরদেহ। পাশেই ছিল অসংখ্য মোবাইল ফোন ও জুতা। ওই রুমে শুধু একটা দরজা ছিল, কোনো জানালা ছিল না। ওই রুমের দৃশ্য এখনও তাড়িয়ে ফিরছে ফায়ার ফাইটারদের। ধারণা করা হচ্ছে, ওই রেস্টুরেন্টের অতিথিরা সবাই নিরাপদ মনে করেই সেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাদের অনুমান ঠিকই ছিল। ওই রুমে আগুন স্পর্শ করেনি। কিন্তু ধোঁয়াতেই তারা প্রাণ হারান। রুমে একটি জানালা থাকলে কেউ মারা যেত না। ভবনের ভেতর দেখে বোঝার উপায় নেই। এখানে এতো মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ভবনের সিঁড়িতে ও লবিতে ছিল গ্যাসের সিলেন্ডার। এতে নিচ থেকে কেউ ওপরে উঠতে পারেনি। এ ছাড়া এসব গ্যাস সিলেন্ডার থেকে গ্যাস লিকেজে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ভবনের সিঁড়ি আর সামনের সাইড থেকে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি।

https://samakal.com/capital/article/225639