১৮ জানুয়ারি ২০২২, মঙ্গলবার, ৩:২৫

ব্যাংক খাতে সতর্ক বার্তা

নীতিমালা কঠোর করল বাংলাদেশ ব্যাংক

বেশি খেলাপি ঋণধারী ব্যাংকগুলোর নীতিসহায়তা দিতে কড়াকড়ি আরোপ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সাথে বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণ থেকেও ব্যাংকগুলোকে বিরত রাখা হচ্ছে। ঢালাওভাবে দুর্বল ব্যাংকগুলো যাতে ঋণ বিতরণ করতে না পারে সে বিষয়ে নীতিমালায় কড়াকড়ি আনা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশের ব্যাংকিং খাতকে সুসংহত রাখতে ব্যাংকগুলোর জন্য সতর্ক বার্তা হিসেবে নীতিমালায় কড়াকড়ি করা হচ্ছে। একই সাথে তদারকি ব্যবস্থায়ও আরো কঠোরতা আনা হবে।

জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে গত দুই বছর যাবৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার নীতিমালা শিথিল করেছিল। বিশেষ করে ঋণ আদায় ও খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে। বলা হয়েছিল কেউ ঋণ পরিশোধ না করলেও তাকে খেলাপি করা যাবে না। একই সাথে দেশের অর্থনীতির অন্তর্নিহিত শক্তি ধরে রাখতে ঢালাওভাবে প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় গেলো বছর লক্ষাধিক কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা শিথিলতাকে দুর্বলভেবে কোনো কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রণোদনার ঋণ অপব্যবহার করার অভিযোগ ওঠে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে এ বিষয়টি উঠে আসে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এক দিকে ঋণ আদায় ছাড়াও ঋণ নিয়মিত করা হয়। এতে খেলাপি ঋণের আধিক্য বেড়ে যায়। বেড়ে যায় আদায় অযোগ্য ঋণ। সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, ১ লাখ ১ হাজার ১৪৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে ৯০ হাজার ৮৪২ কোটি টাকাই আদায় অযোগ্য ঋণে পরিণত হয়েছে, যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৯০ শতাংশ। এর বাইরে আদায় অযোগ্য আরো প্রায় অর্ধলাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে, যা অবলোপন ঋণ হিসেবে ব্যাংকের খাতায় রয়েছে। সেপ্টেম্বরের হিসেবে খেলাপি ঋণের ঘরে যাওয়ার ঠিক আগের স্তরে রয়েছে আর প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ, যা এসএমই ঋণ হিসেবে রয়েছে। চলতি জানুয়ারি থেকে নীতিমালার শিথিলতা তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ নতুন করে খেলাপি ঋণের হিসাবে যুক্ত হতে যাচ্ছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যাংকাররা।

এমনি পরিস্থিতিতে গত দুই বছরের ধকল কাটিয়ে উঠতে দুর্বল ব্যাংকগুলো যাতে ঢালাওভাবে নতুন করে ঋণ বিতরণ করতে না পারে সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে নীতিমালা কড়াকড়ি আরোপ করছে। সীমাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ রয়েছে এমন ২২টি ব্যাংকের নীতিসহায়তা দিতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা, ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য শাখা খোলা ও বৈদেশিক লেনদেন বাড়াতে এডি শাখা খোলার ক্ষেত্রে কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার তিন শতাংশের বেশি হলেই ওই ব্যাংককে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়। আর ঝুঁকিপূর্ণ হলে আন্তর্জাতিকভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মানদণ্ড কমে যায়। আন্তর্জাতিক লেনদেন করতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ব্যয় বেড়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকের মানদণ্ড নির্ণয় করা হয় পাঁচ শতাংশের বেশি খেলাপিঋণধারী ব্যাংকগুলোর। অর্থাৎ পাঁচ শতাংশ বা এর বেশি হলেই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয়। বেশি খেলাপি ঋণধারী ব্যাংকগুলো যাতে ঢালাওভাবে ঋণ বিতরণ করে আরো ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে না দেয় সে বিষয়েই নতুন করে সতর্ক করা হয়েছে। সর্বশেষ গত রোববার এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করে বিদ্যমান নীতিমালা কঠোর করা হয়েছে।

জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হারের চারটি ধাপের ভিত্তিতে বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণের সীমা নির্ধারণের শর্ত ছিল। এখন তা পাঁচটি করা হয়েছে। বৃহৎ ঋণ দেয়ার নীতিমালায় সর্বনি¤œ ধাপ পাঁচ শতাংশ দিয়ে শুরু হতো। এখন তা তিন শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংকের মোট ঋণের তিন শতাংশের কম খেলাপি ঋণ থাকলে ওই ব্যাংক তাদের মোট ঋণের ৫০ শতাংশ বড় অঙ্কের ঋণ দিতে পারবে। আগের সার্কুলারে তিন শতাংশের কমের খেলাপি ঋণের বিষয়টি ছিল না। এর মাধমে বেশি খেলাপি ঋণধারী ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণে কড়াকড়ি করা হয়। আবার কোনো ব্যাংকের তিন শতাংশের বেশি থেকে পাঁচ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ থাকলে ওই ব্যাংক তাদের মোট ঋণের ৪৬ শতাংশ বড় ঋণ দিতে পারবে। আগের সার্কুলার অনুযায়ী মোট ঋণের পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ থাকলে ৫৬ শতাংশ বড় অঙ্কের ঋণ দিতো পারত। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের ক্ষমতা কমলো ১০ শতাংশ। নতুন সার্কুলার অনুযায়ী, পাঁচ শতাংশের বেশি থেকে ১০ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ থাকলে মোট ঋণের ৪২ শতাংশ বড় অঙ্কের ঋণ দিতে পারবে। আগের সার্কুলার অনুযায়ী, পাঁচ শতাংশের বেশি থেকে ১০ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ থাকলে ৫২ শতাংশ বড় অঙ্কের ঋণ দিতে পারত। এ ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণের ক্ষমতা কমলো ১০ শতাংশ। নতুন নিয়মে ১০ শতাংশের বেশি থেকে ১৫ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ থাকলে ৩৮ শতাংশ বড় অঙ্কের ঋণ দিতে পারবে। আগের নিয়মে এ ক্ষেত্রে ৪৮ শতাংশ বড় অঙ্কের ঋণ দেয়া যেত। এ ক্ষেত্রে ঋণ বিতরণের ক্ষমতা কমলো ১০ শতাংশ। নতুন নিয়মে ১৫ শতাংশের বেশি থেকে ২০ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ থাকলে ৩৪ শতাংশ বড় অঙ্কের ঋণ দেয়া যাবে। আগের নিয়মে একই ক্ষেত্রে ৪৪ শতাংশ বড় অঙ্কের ঋণ দেয়া যেত। এ ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের ঋণ দেয়ার ক্ষমতা কমলো ১০ শতাংশ। নতুন নিয়মে ২০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ থাকলে ৩০ শতাংশ বড় অঙ্কের ঋণ দেয়া যাবে। আগের নিয়মে এ ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ বড় অঙ্কের ঋণ দেয়া যেত। এ ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণের ক্ষমতা কমলো ১০ শতাংশ।

শুধু তা-ই নয়, একজন গ্রাহককে বেশি ঋণ দিতেও কড়া কড়ি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, একক গ্রহীতাকে ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারবে না, যেখানে আগে ছিল ৩৫ শতাংশ। এভাবেই ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। একই সাথে তদারকি কার্যক্রমও বাড়ানো হচ্ছে। এসব পদক্ষেপ ব্যাংকগুলোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্কবার্তা বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা।

 

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/637357