১৮ জানুয়ারি ২০২২, মঙ্গলবার, ৩:২১

রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও কিছু কথা

-ড. মো. নূরুল আমিন
চাকরি জীবনের দু’টি স্মৃতি আমার মনে প্রচণ্ড দাগ কেটেছিল। ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে প্রায় একই সময়ে আমি তৎকালীন পাকিস্তান অবজার্ভারে একজন সহসম্পাদক এবং কায়েদে আজম কলেজের (বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) বাণিজ্য বিভাগে একজন অধ্যাপক হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছিলাম। অধ্যাপনার চাকরির মাস চারেক পরেই ১৯৬৯ স্যালের ডিগ্রী-পরীক্ষা ছিল এবং তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে আমার ইনভিজিলেশন ডিউটি পড়েছিল। যে হলে আমার ডিউটি পড়েছিল সে হলে জগন্নাথ কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মতিন স্যারের ডিউটিও পড়েছিল। মতিন স্যার অত্যন্ত প্রবীণ শিক্ষক আর আমি ছিলাম সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া একজন তরুণ শিক্ষক। পরীক্ষা শুরু হওয়ার সাথে সাথে পরীক্ষার্থীরা উত্তরপত্র লিখায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মাঝের সারিতে কয়েকটি ছেলে কথাবার্তায় মশগুল ছিল। একজনকে দেখা গেল বই খুলে উত্তরপত্র লিখতে।

মতিন স্যার নিজে না সামলিয়ে আমাকেই বললেন, ইয়ংম্যান, তুমি যাও এবং সামলাও। আমি গেলাম এবং জিজ্ঞাসা করলাম, নকল করছ কেন? বইটা এবং উত্তরপত্র কেড়ে নিলাম। ছেলেটি নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিল, স্যার খাতাটা ফেরৎ দিন, আমি নকল করছি না, বই দেখে আসলটা লিখছি। তার জবাব শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম। ছেলেটি ছিল ছাত্রলীগের জগন্নাথ কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক। বিষয়টি প্রিন্সিপাল পর্যন্ত গড়িয়ে ছিল। শিষ্টাচার ও অপরাধবোধ মনে হচ্ছিল সে দিন লজ্জায় পালিয়ে গিয়েছিল। আজকের রাজনৈতিক অঙ্গনের দুরবস্থা দেখে কথাটি আমার প্রায় মনে পড়ে। শিক্ষাঙ্গনে আমরা কি মানুষ তৈরী করছি না গরু?

আরেকটি ঘটনা। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ের। তখন সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। অবজারভারের সিনিয়র সহসম্পাদক নূরুজ্জামানসহ মুসলিম লীগ নেতা খাজা খয়েরউদ্দিনের বাসায় গিয়েছিলাম তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করার জন্য। সারাদেশে নৈরাজ্য চলছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কথায় কথায় আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিব এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিষয়টিও আমাদের আলোচনায় উঠে এসেছিল। খাজা সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এ মামলা সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন কিনা, উত্তরে তিনি বলেছিলেন যে, শেখ মুজিব পুরো বিষয়টিই তাকে বলেছিলেন। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা ও আওয়ামী লীগপন্থী কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের কয়েকজন আমলা প্রথমত এর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে এবং পরে শেখ মুজিবকে তাদের এই পরিকল্পনার অংশীদার বানায়, শেখ মুজিব ছাত্রনেতাদের হাতে অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন এবং খাজা খয়েরউদ্দিনের বর্ণনামতে, একদিন তিনি তার বাসায় গিয়ে তাকে ছাদে নিয়ে সম্পূর্ণ বৃত্তান্ত বলেছিলেন এবং তার পরামর্শ চেয়েছিলেন। এ আলোচনাকালে পিডিপির সহ-সভাপতি আব্দুর রহিমও উপস্থিত ছিলেন। আমরা খয়ের উদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, কাজে সম্পৃক্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলেন না কেন? তার জবাব ছিল “দেখ, আমরা রাজনীতিবিদ, আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা এমন কোন কাজ করতে পারি না যাতে আমাদের একজন ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনীতিবিদের ফাঁসি হয়।” তার সাথে আমাদের অনেক কথা হয়েছে কিন্তু তার এই কথাটি আমি কখনও ভুলতে পারি না। রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগ ও মুসলিম লীগের মধ্যে সম্পর্ক ছিল অহিনকুল সম্পর্ক। কিন্তু এই সম্পর্ক ব্যক্তি জীবনের সম্পর্কের ওপর কখনও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। রাজনৈতিক শিষ্টাচারের এটি একটি উদাহরণ।

আরেকটি ঘটনা আমার মনে পড়ে এটি দৈনিক শক্তির সম্পাদক জনাব জয়নাল আবেদীনের মুখে শোনা। ১৬ ডিসেম্বরের পর জয়নাল আবেদীনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং তার ওপর চরম নির্যাতন চালানো হয়েছিল। তিনি আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী ছিলেন এবং শেখ মুজিবের রাজনৈতিক আচরণের বিরোধিতা করতেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে ফেরত আসার পর শক্তি সম্পাদক জয়নালের খবর নিয়ে যখন জানতে পারলেন যে তিনি জেলে তখন তিনি স্বউদ্যোগে তাকে জেলখানা থেকে মুক্ত করে বঙ্গভবনে তার কার্যালয়ে হাজির করিয়ে ছিলেন এবং তার শারীরিক ও আর্থিক অবস্থার খবর নিয়েছিলেন। দৈনিক শক্তি তখন বন্ধ ছিল এবং জয়নালের বাড়িঘরও লুটপাট হয়ে তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল। শেখ মুজিব তাৎক্ষণিকভাবে তাকে সহযোগিতা করেছিলেন। সামনে কুরবানির ঈদ ছিল।

তিনি ফরিদপুরের জেলা প্রশাসককে টেলিফোনে নির্দেশ দিয়ে তিনটি বড় গরুর হাটের ইজারা জয়নালের অনুকূলে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। এজন্য তাকে কোন পয়সা দিতে হয়নি। তিনটি হাটে, জয়নালের বর্ণনা মতে তার প্রায় ৯ লাখ টাকা উপার্জন হয়েছিল। একজন কট্টর ভিন্নমতাবলম্বীর প্রতি শেখ মুজিবের এটি ছিল উদারতা ও শিষ্টাচার।

দেশের অন্যতম বৃহত্তম দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপার্সন ও তিন বারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাস ও চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাবার অনুমতি নিয়ে বর্তমানে যা ঘটছে তাকে কিছুতেই শিষ্টাচারের মধ্যে আমি গণ্য করতে পারছি না।
রাজনীতিতে মহানুভবতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। এতে দূরদর্শিতার ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতিফলন পাওয়া যায়। রাজনীতি করতে গেলে অথবা দেশ পরিচালনা করতে হলে বড় মনের দরকার হয়। একটি সংকীর্ণ মন ও মানসিকতা এবং আঠার কোটি মানুষের বিশাল একটি দেশ একসাথে চলতে পারে না।

আমি নিবন্ধের শুরুতে কয়েকটি ঘটনার কথা বলেছিলাম। ষাটের দশক থেকে বর্তমানে আমরা অনেক সমৃদ্ধ। শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সবক্ষেত্রে আমরা ব্যাপক পরিবর্তন ও অগ্রগতি দেখতে পাই। কিন্তু শিক্ষাঙ্গন ও ছাত্র রাজনীতিতে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে ? যেই ছেলেটি বই দেখে পরীক্ষার হলে নকল করে উত্তরপত্র লেখাকে বই দেখে আসল লেখার স্বাধীনতার কথা বলতো তার বা তাদের সন্তানরা শিক্ষাঙ্গনের অবস্থা কি করেছে? দেশবাসী তা প্রত্যক্ষ করছেন। শিক্ষাঙ্গন এখন অস্ত্রধারীদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের আখড়া হয়ে পড়েছে। সরকার নির্লিপ্ত। একবার ভেবে দেখুন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে মুসলিম লীগ, জামায়াত, পিডিপির যেসব নেতা অবহিত ছিলেন তারা যদি আদালতে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতেন তাহলে অবস্থা কোথায় দাঁড়াত? কিন্তু তারা সেই সাক্ষ্য দেননি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা তাদের মধ্যে ছিল না। কিন্তু আজকের আওয়ামী লীগ জামায়াত, বিএনপিসহ প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য যেসব অমানবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে রাজনীতির ইতিহাসে তার নজির খুব কম। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে। সীমান্তে আমাদের মানুষ মারা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রীরা বলেন, সীমান্ত হত্যায় তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। প্রতিবেশীর বাতলানো জঙ্গী লিঙ্ক খুঁজতে আমাদের ছেলেদেরই শুধু নয়, বোরখাপরা মেয়েদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের নামের সাথে আরবি অথবা ইসলামী শব্দের সংশ্লেষ থাকলে তাদের আর রক্ষা নেই। হত্যা, গুম, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অব্যাহতভাবে চলছে। রাষ্ট্রীয় অবিচারের প্রতিবাদে সুপ্রীম কোর্টের আপিলেট ডিভিশনের জ্যেষ্ঠতম বিচারককেও পদত্যাগ করতে হয়। মানুষের মৌলিক ও মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার সকল পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।

যীশু খ্রীষ্টের জন্মের ৩০০ বছরেরও পূর্বে আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করেছিলেন এবং তার হাতে রাজা পুরু পরাজিত হয়ে বন্দী হিসেবে তার সামনে এসেছিলেন। আলেকজান্ডার তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তুমি আমার কাছ থেকে কি ধরনের আচরণ আশা করো? পুরুর সাদাসিধে জবাব ছিল, ‘রাজার মতো।’ বলাবাহুল্য, বন্দী পুরুকে আলেকজান্ডার স্বাভাবিক অবস্থাতেই তার সামনে হাজির করেছিলেন, ডান্ডাবেড়ি বা কয়েদীর পোশাক পরিয়ে নয়। এখন ভাবুন তারা সভ্য ছিলেন না আমরা?

https://dailysangram.com/post/477819