১৫ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১২:১৯

চালক প্রশিক্ষণের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর সোহাগ হোসেন ২০ বছর ধরে ট্রাক চালান। আগে ছিলেন হেলপার। ওস্তাদ (ট্রাকচালক) তাঁর ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি ট্রাক চালনার সব কায়দাকানুন শেখান তাঁকে।
শুধু সোহাগ নন, দেশের তিন লাখের বেশি বাস ও ট্রাকচালকের সবাই ওস্তাদের কাছ থেকে চালনা শিখেছেন। তবে এ শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক নয় বলে খুঁটিনাটি অনেক বিষয় তাঁদের অজানা। ফলে সড়কে-মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। জনসচেতনতা এবং চালকদের অবকাশের অভাবও দুর্ঘটনার কারণ।
পুলিশের এফআইআর অনুযায়ী প্রতিবছর তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এ কারণে বছরে ২৩ হাজার লোক মারা যায় বলে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাস-ট্রাকের চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত দেশে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ থাকলে দুর্ঘটনা কম হতো। ড্রাইভিং পেশাকে ব্র্যান্ডিং করা গেলে শিক্ষিত চালক পাওয়া যেত।
সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বুয়েট, পুলিশ, বিআরটিএসহ ছয়টি সংস্থা যৌথভাবে একটি প্রকল্প তৈরি করছে। এর আওতায় সড়কে বসানো হবে স্পিড ক্যামেরা রাডার।
সারা দেশে চালক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করার উদ্যোগও নিয়েছে সরকার। এসব কেন্দ্রে প্রতিবছর ৫০ হাজার লোক গাড়ি (বাস, ট্রাক প্রভৃতি) চালনার প্রশিক্ষণ পাবেন।
চালকের অজ্ঞতা ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাও দুর্ঘটনার কারণ
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। চালক ওভারস্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে। এ অবস্থায় ব্রেক কষলেই দুর্ঘটনা ঘটবে, গাড়িটি উল্টে যাবে। এ কথা বললেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি গাড়ির জন্য খুবই ঝুঁকির বিষয়। পুরোদমে বৃষ্টি হলে সমস্যা নেই। চালকরা এসব বিষয় জানে না, ফলে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, ধরা যাক, একটি বাস মহাসড়কে চলছে। সেটিকে আরেকটি বাস ওভারটেক করল। সঙ্গে সঙ্গে পেছনে পড়া চালক মরিয়া হয়ে ওঠে, ওই বাসটিকে পেছনে ফেলার জন্য। এটা চালকদের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। ওভারটেক করে গেলেই তারা মনে করে হেরে গেছে। এটিও সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ।
অধ্যাপক মোয়াজ্জেম বলেন, গাড়ির ওভারস্পিডের কারণেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। যেখানে ৬০ কিলোমিটার বেগে চালানোর কথা সেখানে ১০০ কিলোমিটার বেগেও চালানো হয়। আমাদের দেশে সড়কের বাঁকগুলো এত স্পিডের জন্য তৈরি নয়। ফলে গাড়ি খাদে পড়ে। স্পিড মেনটেইন করতে গিয়ে প্রতি এক মিনিটে একটি গাড়িকে ওভারটেক করতে হয়। সে সময় দুর্ঘটনা ঘটে। পথচারীরা নিয়ম মানে না, সাইকেল, রিকশাও নিয়ম মানে না। তাদের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশ বাস পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহর মতে, শুধু চালক নয়, গাড়িও দুর্ঘটনার কারণ। হাইওয়েতে হাট-বাজার বসানো হয়, ধান শুকানো হয়, গরু-ছাগল চড়ছে। চলছে নসিমন, করিমন, ভটভটি। তিনি বলেন, ৮০ কিলোমিটার বেগে বাস-ট্রাক চলে আর নসিমন-করিমন চলে ২০-৩০ কিলোমিটার বেগে। ওগুলোর ব্রেকও ঠিকমতো কাজ করে না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুষ মারা যাচ্ছে।
বৈধ চালকের ঘাটতি
অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, দেশে মোটরসাইকেলসহ ৩০ লাখ নিবন্ধিত গাড়ি রয়েছে। এসব চালানোর জন্য ৩০ লাখ বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী চালক থাকার কথা। কিন্তু রয়েছে ১৭ লাখ বৈধ লাইসেন্স। বাকি ১৩ লাখ চালকের হয় লাইসেন্স নেই অথবা ভুয়া লাইসেন্স রয়েছে।
মনিটরিংয়ের উদ্যোগ
সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট, পুলিশ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, হাইওয়ে পুলিশ, বিআরটিএ এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটি গবেষণা করে সরকারকে একটি প্রস্তাব দেবে। প্রস্তাবে সড়কে-মহাসড়কে স্পিড ক্যামেরা রাডার বসানোর কথা থাকবে বলে জানা গেছে। এ ক্যামেরা দিয়ে গাড়ির গতি মাপা হবে, সীমা অতিক্রান্ত হলে জরিমানা করা হবে।
অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, বুয়েট ও বিআরটিএ মিলে সারা দেশে চালক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলবে। এসব কেন্দ্রে প্রতিবছর ৫০ হাজার প্রশিক্ষিত চালক তৈরি করা হবে। অষ্টম শ্রেণি পাস যুবকরা এ সুযোগ পাবে। যারা গাড়ি চালাচ্ছে তারাও ইচ্ছা করলে প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। গাড়ি চালনা শেখানোর পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে।
পেশাকে ব্র্যান্ডিং করতে হবে
একজন বাস বা ট্রাকচালক মাসে ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা উপার্জন করেন। এর পরও কেন এ পেশায় শিক্ষিতরা আসছেন না জানতে চাইলে বুয়েটের শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, গাড়ি চালনা পেশার ব্র্যান্ডিং নেই। চালকদের সম্মানও করা হয় না। ফলে যুবকরা বেকার থাকলেও এ পেশায় আসতে চায় না। অথচ শিক্ষিতদেরই এ পেশায় আসা উচিত। গাড়ি চালনার জন্য পর্যাপ্ত কারিগরি জ্ঞান থাকা দরকার। প্রশিক্ষণ শুধু দিলেই হবে না, প্রশিক্ষণ নেওয়ার যোগ্যতাও থাকতে হবে।
গাড়ির মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চালক নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা শুধু দেখেন হেভি লাইসেন্স আছে কি না। অন্য যোগ্যতা তেমন দেখেন না। একটি বাস কম্পানির মালিক বলেন, ‘আমার বাসটি চালানোর যোগ্যতা তার আছে কি না সেটিই দেখা হয়। শিক্ষিত লোক ড্রাইভিং পেশায় আসে না। পাব কোথায়?’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নিয়োগ দেওয়ার পর যদি কোথাও অ্যাক্সিডেন্ট করে তাহলে ডেকে কারণ জানা হয়। যদি চালকের দোষ পাওয়া যায় তাহলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ’ তিনি বলেন, মাইক্রোবাসের জন্য অনেক লোক মারা যাচ্ছে। ওগুলো হাইওয়েতে পাগলের মতো ছোটে। ওভারটেক করা যাবে কি যাবে না সেটা না ভেবেই মাইক্রোর চালকরা ওভারটেক করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে।
উভয়সংকটে পুলিশ
সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাইওয়েতে নসিমন-করিমন-ভটভটি চলতে পারবে না। কিন্তু এসব বন্ধ করলে মানুষ পুলিশের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মহাসড়কে নসিমন-করিমন-রিকশা না চললে যারা শর্ট ডিস্টেন্সে যাবে তারা যান পায় না। ফলে তারা পুলিশের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। পুলিশকে পড়তে হয় বেকায়দায়। এ বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘সার্ভিস লেন হলে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। ’
ট্রাকচালকদের বিশ্রাম নেই
ট্রাকচালক সোহাগ বলেন, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া যেতে হলেও ট্রাকচালকদের বিশ্রামের কোনো সুযোগ নেই। মহাসড়কে ট্রাক থামিয়ে বিশ্রাম নেওয়া যায় না। এ কারণে মানসিক অস্থিরতা দেখা দেয়। সারা রাত ট্রাক চালালে ঘুম আসাই স্বাভাবিক। অনেক সময় চালক ঘুমিয়ে পড়ে, এ ফাঁকে দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, হঠাৎ দেখা যায়, দ্রুতগতির মাইক্রোবাস ওভারটেক করতে চাপ দিচ্ছে। তখন স্পিড কমানো যায় না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে যায়।

 

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/03/15/474561