১৫ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১২:১০

৩৩৪ কোটি টাকার প্রকল্পের আকার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২২৯ কোটি টাকা

মগবাজার ফ্লাইওভার মানুষ খেকো ফাঁদ

মালিবাগ-মৌচাক সড়কের যত্রতত্র এবড়ো-খেবড়ো গর্ত। বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে ইট, খোয়া, রডসহ নির্মাণসামগ্রী। পানি নিষ্কাশনের ড্রেনগুলো ভরাট হয়ে গেছে নির্মাণ আবর্জনায়। এ কারণে সামান্য বৃষ্টিতেই সড়কে হাঁটু পানি জমে যায়। অন্যদিকে নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া উঁচু পিলারের ওপর ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ চলছে। অসতর্ক কাজের কারণে ঘটছে হতাহতের ঘটনা। বিকল্প উপায় না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খানাখন্দে ভরা জলাবদ্ধ এ সড়কে চলাচল করছেন রাজধানীবাসী।
এদিকে বর্ষাকাল না আসতেই কয়েক দিন আগে সামান্য বৃষ্টিতে একরকম তলিয়ে যায় মালিবাগ-মৌচাক সড়কের পুরোভাগ। ভাবনার বিষয় জুন-জুলাই ভরা বর্ষাকাল শুরু হলে কী হবে। এখনই মালিবাগ-মৌচাক সড়কের প্রায় এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে বাস মিনিবাসের। প্রাইভেটকার ভুলেও এ পথে যেতে চায় না। রিকশা চলাচল তো আরও বিপজ্জনক। আর সাধারণ পথচারীদের দুর্ভোগের শেষ নেই। অথচ সীমাহীন জনদুর্ভোগ লাঘবে কারও কোনো নজর নেই। নিয়ম থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ফ্লাইওভারের নিচে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অথচ প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে শেষ করা দূরের কথা, উল্টো ধাপে ধাপে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি করে মহলবিশেষ লাভবান হয়েছে। আর দুর্ঘটনার নামে নির্মাণাধীন মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্পটি ‘মানুষ খেকো’ ফাঁদে পরিণত হয়েছে।
বনশ্রীর বাসিন্দা ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা আবদুল আলীম যুগান্তরকে জানান, মালিবাগ-মৌচাক সড়কের ভোগান্তির কারণে বনশ্রী থেকে বাসা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কেননা এ পথ দিয়ে চলতে গিয়ে তিনিসহ তার পরিবারের জীবন দুর্বিষহ হয়ে গেছে। তারা এখন রীতিমতো হাঁফিয়ে উঠেছেন।
এ প্রসঙ্গে স্থপতি ইকবাল হাবিব যুগান্তরকে বলেন, নির্মাণ আইনের কিছু ক্রটি থাকায় কাজের সময় হতাহতের ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হচ্ছে না। এটাকে দুর্ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে, এসব ঘটনাকে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে না দেখলে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বাড়তেই থাকবে। আর নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিষয়টিও তারা গুরুত্ব দেবে না।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্পের পরিচালক সুশান্ত কুমার পাল দাবি করেন, নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বেষ্টনী মেইনটেইন করে কাজ করা হচ্ছে। এর পরও কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। মূলত চলমান সড়কের ওপর এ ধরনের বড় প্রকল্পের কাজ করায় সতর্ক থাকার পরও দুর্ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে একই সুরে কথা বলছে নির্মতা প্রতিষ্ঠান। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সব ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী মেনেই মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ করা হচ্ছে। তার পরও কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ভবিষ্যতে ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হবেন বলে জানান তিনি।
উচ্চ আদালতের নির্দেশ মানছে না দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান : মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের ইস্কাটন অংশে গত বছরের ১৬ মার্চ নির্মাণকাজ চলার সময় লোহার ভারি খণ্ড পড়ে ঘটনাস্থলেই মোহাম্মদ ইমন নামের এক শ্রমিক মারা যান। এ ঘটনায় ২৭ মার্চ একজন আইনজীবী জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট করলে উচ্চ আদালত মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ চলাকালে দুর্ঘটনা এড়াতে সাধারণ জনগণ ও নির্মাণ শ্রমিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন। এ ঘটনায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) প্রধান প্রকৌশলী, ডেপুটি কমিশনার ঢাকা এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে এই নির্দেশনা প্রদান করা হয়। কিন্তু এরপরও মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়াই নির্মাণকাজ করা হচ্ছে। ফলে গত বছরের ১৬ জুন নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের ওপর থেকে নিচে পড়ে গিয়ে সুমন (২২) নামে আরেক শ্রমিক মারা যান। গত রোববার সর্বশেষ নিহতের তালিকায় যুক্ত হয়েছেন মোহাম্মদ স্বপন নামের আরেক শ্রমিক। মালিবাগ রেলগেটে গার্ডার চাপা পড়ে মারা গেছেন ওই শ্রমিক। তিনি পেশায় কাঠমিস্ত্রি। ওইদিন রাতে ফ্লাইওভারের কাজের নিরাপত্তা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন আরও দু’জন।
ধাপে ধাপে বেড়েছে প্রকল্পের সময় ও ব্যয় : ঢাকাবাসীর নির্বিঘœ চলাচল নিশ্চিত করতে এ প্রকল্পটি একনেক অনুমোদন করে ২০১১ সালের ৮ মার্চ। চার লেনবিশিষ্ট ৮ দশমিক ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভারের প্রথম নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৩৪৩ কোটি টাকা। এরপর নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। সর্বশেষ প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি করে করা হয়েছে ১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা।
শুরুতে প্রকল্পের মেয়াদকাল নির্ধারণ করা হয় ২০১১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। যদিও প্রকল্পের কাজ শুরু হয় দেরিতে অর্থাৎ ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এ প্রকল্পের কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সময় ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদকাল নির্ধারণ করা হয়। এরপর প্রথম দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। বর্ধিত সময়েও কাজ শেষ করতে না পারায় পুনরায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে চলতি অর্থাৎ ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রসঙ্গত মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের সাতরাস্তা-মগবাজার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সামনের অংশ চালু হয়েছে গত বছরের ৩০ মার্চ। আর ইস্কাটন-মগবাজার ওয়্যারলেস পর্যন্ত অংশ চালু হয় গত ১৫ সেপ্টেম্বর। বর্তমানে ফ্লাইওভারের মালিবাগ-মৌচাক এবং শান্তিনগর-আরামবাগ অংশের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে।

 

http://www.jugantor.com/last-page/2017/03/15/109108