১৫ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১২:০৩

বিদেশগামীদের দক্ষতার সনদ মিলছে টাকায়


বিদেশে চাকরি প্রার্থীদের কাছে টাকায় বিক্রি হচ্ছে ‘দক্ষতার’ সার্টিফিকেট বা সনদ। কোনো ধরনের ট্রেনিং ছাড়া অভিজ্ঞতাহীন কর্মীরা মাত্র তিন-চার হাজার টাকা দিয়ে যে সনদ সংগ্রহ করছেন তা নিয়ে বিদেশে যেতে পারলেও সেখানে গিয়ে তারা মুখোমুখি হচ্ছেন কঠিন বাস্তবতার। নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বাধ্য হয়েই নির্ধারিত কাজ থেকে সরিয়ে কম বেতনে নিম্নমানের কাজে তাদের লাগিয়ে দিচ্ছেন। এতে নষ্ট হচ্ছে দেশের সুনাম। আর কাক্সিক্ষত বেতন না পেয়ে স্বপ্ন ভঙ্গ হচ্ছে অসংখ্য তরুণের।
গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার কয়েকটি দেশে আকর্ষণীয় বেতনে লোক নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে দেশের অনেক রিক্রুটিং এজেন্সি। ৩০-৪০ হাজার টাকা মাসিক বেতন পাওয়ার আশায় এই শ্রমিকেরা ছয়-সাত লাখ টাকা দিয়ে এসব দেশে যাচ্ছেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে অদক্ষ কর্মী হওয়ায় তারা সেখানে গিয়ে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন। কাজ না জানায় তাদের দেশের ফেরত পাঠানোসহ পদাবনতির মতো ঘটনা ঘটছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিদেশগামী শ্রমিকদের তিন দিনের ট্রেনিং বাধ্যতামূলক করলেও বেশির ভাগ কর্মীকে ট্রেনিং না দিয়েই বিদেশে পাঠানো হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তির পর উপস্থিত দেখিয়ে একেকটি সার্টিফিকেট তিন থেকে চার হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই সিন্ডিকেটের সাথে টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের (টিটিসি) কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকেরা তাদের মনোনীত মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে এসব সার্টিফিকেট সংগ্রহ করছেন। এসব অনিয়ম মনিটরের জন্য মন্ত্রণালয়ের একটি টাস্কফোর্স থাকলেও তারা অনেকটাই নিষ্ক্রিয়।
এ দিকে ট্রেনিংয়ের নামে সার্টিফিকেট বাণিজ্য শুরু হওয়ায় বিদেশগামী শ্রমিকেরা বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমানোর পর ভাষা, ওই দেশের আইন কানুনসহ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার অকালে প্রাণও হারাচ্ছেন।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশগামীদের ট্রেনিং দেয়ার নামে যারা সার্টিফিকেট বাণিজ্যের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন, তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। নতুবা বিদেশে বাংলাদেশী শ্রমিকদের পদে পদে হয়রানি ও ভোগান্তি পোহাতে হবে। তবে শ্রমিকদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে, তারা ট্রেনিং চলার সময় অমনোযোগী থাকেন এবং সার্টিফিকেট পাওয়ার অপেক্ষায় শুধু সময় ক্ষেপণ করেন।
গতকাল ঢাকার ফকিরাপুলের একটি রিক্রুটিং এজেন্সির সামনে এ প্রতিবেদক ওমানগামী কয়েকজন শ্রমিকের সাথে কথা বলছিলেন। এ সময় মধ্যস্বত্বভোগী একজনের মোবাইল নম্বরে একটি ফোন আসে। অন্য প্রান্ত থেকে তাকে বলা হয়, চার-পাঁচজন শ্রমিকের বহির্গমন ছাড়পত্র করানোর জন্য তিন দিনের ট্রেনিং সার্টিফিকেট প্রয়োজন। কিন্তু তারা ট্রেনিংয়ে উপস্থিত থাকতে পারবেন না। গ্রাম থেকে এসে সরাসরি ফ্লাইটে উঠে যাবেন। একেকজনের ট্রেনিং সার্টিফিকেট ফি কত? এমন প্রশ্নের উত্তরে তখন ওই মধ্যস্বত্বভোগী তাকে অকপটে বলেন, সরকারিভাবে নিয়ম অনুযায়ী ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি হতে গেলে খরচ পড়বে মাত্র ১২০ টাকা। কিন্তু ঘরে বসেই তিন দিনের ট্রেনিং সার্টিফিকেট নিতে হলে কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার টাকা থেকে চার হাজার টাকা দিতে হবে। এর মধ্যে আমারও কমিশন আছে। ফোনে তাকে তিনি আরো বলেন, অর্ডার দিলে পাঁচ দিনের মধ্যে আপনি ট্রেনিং সার্টিফিকেট হাতে পাবেন।
শুধু একজন মধ্যস্বত্বভোগী নন, এমন শত শত মধ্যস্বত্বভোগী এখন সার্টিফিকেট বাণিজ্যে লিপ্ত। যদিও সৌদি আরব, ওমান, কাতার, মালয়েশিয়া, জর্ডান, আবুধাবীসহ বিভিন্ন শ্রমবান্ধব দেশে পাঠানোর আগে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় তিন দিনের ট্রেনিং সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। আর এই সুযোগে প্রতিদিন হাজার হাজার কর্মীকে ট্রেনিং দিয়ে বহির্গমন ছাড়পত্র নিতে হচ্ছে। কিন্তু ট্রেনিং করে কর্মীরা লাভবান হচ্ছেন নাকি হয়রানির শিকার হচ্ছেন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার এক কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, সৌদি আরবের এত ভিসা এখন বাংলাদেশে এসেছে যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। তিনি বলেন, কর্মীদের বহির্গমন ছাড়পত্র নিতে এখন তিন দিনের ট্রেনিং সার্টিফিকেট সরকার বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু এই ট্রেনিং সার্টিফিকেট আনতে আমাদের পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। লম্বা সিরিয়াল। কিন্তু ট্রেনিংয়ে কর্মীদের আসলে যা শেখানো হচ্ছে তারা কি তা তিন দিনে সব শিখতে পারছেন? এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার মতে বিদেশে বেশি শ্রমিক যাওয়া দরকার। তাই ট্রেনিং সার্টিফিকেট নেয়ার প্রথা আপাতত তুলে দেয়া যায় কি-না সেটি ভেবে দেখার সময় এসেছে।
এর আগে জার্নালিস্টস ফোরাম অন মাইগ্রেশনের (জেএফএম) সদস্যরা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব বেগম সামছুন নাহারের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি বলেছিলেন, আসলে বিদেশগামীদের তিন দিনের ট্রেনিংয়ে বিভিন্ন দেশের ওপর ভাষা, আইন কানুনসহ নানা বিষয় শেখানো হচ্ছে। এতে শ্রমিকেরা ওই দেশ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাচ্ছেন।
তবে টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে গতকাল ওমানগামী এক কর্মীর তিন দিনের ট্রেনিং সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা প্রসঙ্গে এক রিক্রুটিং এজেন্সি মালিক নয়া দিগন্তকে বলেন, আজকেও আমি ট্রেনিং সার্টিফিকেট সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সংগ্রহ করেছি। সব মিলিয়ে আমার চার হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কর্মীকে আর ট্রেনিং নিতে সেন্টারে যেতে হয়নি। ঘরে বসেই পাওয়া গেছে। আর সার্টিফিকেট জমা দিলেই জনশক্তি ব্যুরো কর্মীর বহির্গমন ছাড়পত্র দিচ্ছে। তিনি বলেন, আসলে ট্রেনিং নেয়ার নিয়ম হচ্ছে একজন কর্মী টিটিসিতে গিয়ে পাসপোর্টের ফটোকপি দিয়ে ভর্তি হবেন। এ ক্ষেত্রে ভর্তি ফি ১২০ টাকা। সপ্তাহের শনি থেকে সোমবার এক শিফট আর মঙ্গল থেকে বৃহস্পতিবার আরেক শিফটে ২ ঘণ্টা করে ক্লাস করানো হয়। এতে প্রত্যেককেই আরবি বই দেয়া হয় আর যে দেশে যাচ্ছেন সে দেশের ভাষা ও আইনকানুন শেখানো হয়। তবে এই ফর্মুলাকে ভোগান্তি মনে করে বেশির ভাগ এজেন্সির মালিক অন্য পন্থায় যাচ্ছেন। তাদের বক্তব্য, চার-পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে যদি ভিসা কিনতে পারি তাহলে চার হাজার টাকা খরচ করে ট্রেনিং সার্টিফিকেট নিলে সমস্যা কোথায়?
উল্লেখ্য, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে বিদেশগামীদের ট্রেনিং করানোর জন্য ৭১টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। এসব কেন্দ্রে মোট ৪৮টি ট্রেডের ওপর ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে গার্মেন্ট, মোবাইল, গাড়ি মেকানিক, কার্পেন্টার, মেশনসহ বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এ ছাড়া পাঁচটি মেরিন ইনস্টিটিউট ও নারায়ণগঞ্জ বন্দরে একটি মেরিন একাডেমি রয়েছে। সেখানেও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

 

www.dailynayadiganta.com/detail/news/203699