১৪ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:৪১

বেপরোয়া সার্ভিস চার্জে বাড়ছে ব্যবসাব্যয়: ঋণ আবেদন ফির সীমা বেঁধে দিলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক

 

হাসান (ছদ্ম নাম) নামে এক গ্রাহক তার টিনশেড বাড়িসহ জায়গা বন্ধক রেখে ওয়ান ব্যাংক বনশ্রী শাখা থেকে মাস চারেক আগে ৩ লাখ টাকা ঋণ নেন। ঋণ নেয়ার আবেদনের পর কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে ব্যাংক কর্মকর্তা ৮০০ টাকা নেন। পরে ঋণ মঞ্জুরির পর তা বিতরণের সময় তিন লাখ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা কর্তন করে ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা দেয়া হয়। ৫ হাজার টাকা কম দেয়ার কারণ হিসেবে ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, কাগজপত্র যাচাই-বাছাই ও আবেদন ফি বাবদ এ অর্থ নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ৩ লাখ টাকা ঋণ পেতে হাসান সাহেবের ব্যয় হয় ৫ হাজার ৮০০ টাকা।
হাসান সাহেবের মতো ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন নামে বেপরোয়া সার্ভিস চার্জ নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে এ ধরনের হাজারো অভিযোগ আসে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও সময়ে সময়ে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করে দেয়া হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ব্যাংকগুলো তাদের কাজ ঠিকই অব্যাহত রাখে। ফলে নিরুপায় গ্রাহক অনেক ক্ষেত্রেই এটাকেই নিয়তি মেনে নেন। বেপরোয়া সার্ভিস চার্জ আদায় করায় গ্রাহকের ব্যবসাব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়তি করারোপে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। এর ওপর বাড়তি সার্ভিস চার্জের নামে পণ্যের উৎপাদনব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দেশীয় উৎপাদিত পণ্য অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশী পণ্যের সাথে মূল্যের প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এতে তাদের মুনাফা কমে যাচ্ছে। কারো আয়-ব্যয় সমান সমান থাকছে। তবে বেশির ভাগেরই নিট লোকসান হচ্ছে। ফলে লোকসান সমন্বয় করতে গিয়ে মূলধন কমে যাচ্ছে। অনেকেই টিকতে না পেরে ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছেন।
একজন শিল্পোদ্যোক্তা জানিয়েছেন, সার্ভিস চার্জের নামে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে বেপরোয় অর্থ কেটে নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। ব্যবসা-বাণিজ্যের এই দুরবস্থার মাঝে এমনিতেই ব্যবসায়ীদের নাভিশ্বাস, এর ওপর ব্যাংকের বাড়তি সার্ভিস চার্জে অনেকেই দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংক নিজস্ব সফটওয়্যার তৈরি করেছে। নিয়মিত কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা এক দিন পার হতেই গ্রাহকের ঘাড়ে বাড়তি সার্ভিস চার্জ যুক্ত হচ্ছে। এর ফলে ঋণ পরিশোধ আরো কষ্টকর হয়ে পড়ছে।
এর বাইরে ব্যাংকের হিসাব খোলা, বন্ধ করা, পরিচালন, অনলাইন চার্জ, এসএমএস ব্যাংকিং চার্জ, কার্ড ফি, চেক বই ফি, হিসাব বিবরণী পাঠানোর খরচ, ঋণ সমন্বয় ফিসহ নানা রকমের চার্জ পরিশোধ করতে হয় গ্রাহকের। শুধু তা-ই নয়, নির্ধারিত মেয়াদ পূর্তির আগেই মাসিক সঞ্চয়ের হিসাব বন্ধ করতে গেলেও গ্রাহকের প্রাপ্যটুকু দেয়া হয় না। ব্যক্তিপর্যায়ের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও নানা ধরনের সার্ভিস চার্জ আদায় করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি এ ধরনের অভিযোগ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বেশি আসছে। ব্যাংকগুলোর শিডিউল অব চার্জেস পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ঋণের আবেদন গ্রহণ থেকে শুরু করে ঋণমঞ্জুরি পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে গ্রাহকের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ও হারে চার্জ বা ফি বা কমিশন আদায় করছে। ফলে ঋণের প্রকৃত ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা এ খাতের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক সার্কুলার জারি করা হয়েছে। সার্কুলারে ঋণ আবেদন ফিসহ বিভিন্ন খাতে চার্জের সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। সার্কুলারে বলা হয়েছে, কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ঋণ আবেদন ফি হিসেবে কোনোক্রমেই ২০০ টাকার বেশি আদায় করা যাবে না। ডকুমেন্ট ফি, সিআইবি চার্জ, স্ট্যাম্প চার্জ এবং আইনি ও জামানত মূল্যায়ন ফি প্রকৃত ব্যয়ের ভিত্তিতে নির্ধারিত করতে হবে। কটেজ ও মাইক্রো খাতে প্রদত্ত ঋণ মেয়াদপূর্তির আগে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে আরলি সেটেলমেন্ট ফি আদায় করা যাবে না। এর অতিরিক্ত কোনো চার্জ বা ফি বা কমিশন এসব খাতে প্রদত্ত ঋণ হিসাব থেকে আদায় করা যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এ বিষয়ে কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
www.dailynayadiganta.com/detail/news/203456