১৪ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:৩৬

মালিবাগ রেলগেটে গার্ডার পড়ে একজন নিহত, আহত ২: নিরাপত্তা ছাড়াই উড়ালসড়ক নির্মাণ

 

পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ছাড়াই রাজধানীতে উড়ালসড়কের মতো বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়কের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান একদিকে জাতীয় নির্মাণ বিধিমালা মানছে না, অন্যদিকে বিধি মানাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো একধরনের নির্লিপ্ত। সময়মতো এই প্রকল্প শেষ হচ্ছে না, এর খরচও বেড়েছে শতকোটি টাকার ওপরে।
গত রোববার রাত সোয়া দুইটায় মালিবাগে উড়ালসড়কের যে গার্ডারটি পড়ে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, সেটির ওজন ছিল প্রায় ৯৮ টন। দিনের বেলায় জনবহুল ওই স্থানে এটি পড়লে হতাহতের ঘটনা আরও অনেক বেশি ঘটত বলে পথচারী ও দোকানিরা প্রথম আলোর কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে দুর্ঘটনার বিষয়টি নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ কয়েকজন মন্ত্রী এ সময় বলেছেন, সতর্কতার সঙ্গে কাজ করলে এমনটি হতো না। নির্মাণপ্রতিষ্ঠান ঠিকভাবে কাজ করছে কি না, সেটিও দেখতে বলেন তাঁরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক বিধি দূরে থাক, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ১৯৯৩ সালে প্রণীত জাতীয় নির্মাণবিধি (ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড) মানা হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের নির্মাণবিধি আমেরিকান সোসাইটি অব টেস্টিং ম্যাটেরিয়াল (এএসটিএম) এবং ব্রিটেনের বিএস (ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড) বিধিতেও নির্মাণপদ্ধতির মূল বিষয় হচ্ছে নিরাপত্তাব্যবস্থা।
সরেজমিনে দেখা যায়, নির্মাণাধীন মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়ক (ফ্লাইওভার) নির্মাণের ক্ষেত্রে দেশি বা আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করা হয়নি। বছরের পর বছর খোলা স্থানেই এই বিশাল নির্মাণযজ্ঞ চলেছে।
বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে, নিয়ম না মানার কারণে বারবারই দুর্ঘটনা ঘটছে এবং মানুষ মারা যাচ্ছে। গত বছরের মার্চ মাসে মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়ক নির্মাণকাজের সময় রডের আঘাতে একজন শ্রমিক মারা যান।
২০০০ সালে মিরপুর রোডের সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় পদচারী-সেতুর (ফুটওভারব্রিজ) গার্ডার পড়ে মারা যান মাগুরা টেক্সটাইলসের একজন কর্মকর্তা। একই বছর নতুনবাজারে আমেরিকান দূতাবাসের সামনে পদচারী-সেতু ভেঙে তিনজন মারা যান। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে উড়ালসড়কের গার্ডার ভেঙে মোট ১২ জন মারা যান।
জানতে চাইলে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় নির্মাণবিধিতে (ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড) বলা আছে, নির্মাণকাজে নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকতেই হবে। নিরাপত্তাব্যবস্থার কথা নির্মাণকাজের চুক্তিপত্রেও লেখা থাকে। কিন্তু সাধারণত সেগুলো মানা হয় না।
দেশের বড় বড় অবকাঠামো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, নিয়ম অনুযায়ী উড়ালসড়কের গার্ডারের স্কেপ হোল্ডিং থাকতে হয়, যাতে সেটি কোনো লোকের ওপর না পড়ে। এখানে একদিকে শ্রমিকদের নিরাপত্তা, অন্যদিকে আশপাশের লোকজন ও পথচারীর নিরাপত্তা জড়িত। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা মানা হয় না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এখন যেভাবে রাস্তাঘাটে নির্মাণকাজ হয়, তা-ও নিয়ন্ত্রণহীন ও নিরাপত্তাহীনভাবে হচ্ছে, যা নির্মাণ প্রক্রিয়ার মধ্যেই পড়ে না। তাঁর মতে, যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে, সেগুলোকে অনেকটা আমন্ত্রণ জানিয়েই ঘটানো হচ্ছে। খোলা জায়গায় খোলাখুলিভাবে এত বিশাল কাজ পৃথিবীর কোথাও হয় বলে মনে হয় না।
বুয়েটের ওই অধ্যাপক বলেন, শ্রমিকেরা নিরাপদ পোশাক বা হেলমেট পরেন না। যখন যে সংস্থার ইচ্ছা, সে নির্মাণকাজ করছে। এ ধরনের বড় কাজ কারা করতে পারে, তারা নিয়মকানুন মানে কি না, তাদের লোকজন প্রশিক্ষিত কি না—এসব বিষয় দেখা হচ্ছে না।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপত্তা বজায় রেখেই ফ্লাইওভারের কাজ হয়েছে। তিনি বলেন, কোথাও কোনো অবহেলা ছিল না।
তাহলে দুর্ঘটনা কীভাবে ঘটল জানতে চাইলে আতাউর রহমান বলেন, একটি গার্ডার ওঠাতে গিয়ে আরেকটি গার্ডারের অংশ কাটা হয়েছিল। কাটার কারণে পড়ার কথা নয়। তারপরও পড়ে গেছে। তিনি বলেন, উপস্থিত সবার নজর ছিল ওপরের দিকে। নিচে কারও থাকার কথা নয়। কিন্তু কীভাবে লোক ঢুকে গেছে, তা কেউ দেখেনি। তিনি বলেন, এই উড়ালসড়কে প্রায় ৩ হাজার গার্ডার লাগানো হয়েছে। আর কোনোটা তো পড়েনি।
নিরাপত্তাবেষ্টনী নেই অন্যত্রও
এই উড়ালসড়ক ছাড়া আরও কয়েকটি নির্মাণকাজে খোলা জায়গায় নিরাপত্তাবেষ্টনী রাখা হয়নি। গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, মৌচাক থেকে মালিবাগ পর্যন্ত ঢাকা ওয়াসা পাইপলাইন বসাচ্ছে, সেখানে নিরাপত্তাবেষ্টনী নেই। মগবাজার, মৌচাক, মালিবাগ এলাকায় ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডিপিডিসি) কেব্ল লাইন স্থাপন করছে; কিন্তু রাখা হয়নি নিরাপত্তাব্যবস্থা। আগারগাঁও থেকে শেওড়াপাড়া ও কাজীপাড়া এলাকায় মেট্রোরেলের জন্য রাস্তা করতে বিশাল গর্ত খোঁড়া হয়েছে। সেখানে খোলা গর্তে পড়ে প্রায়ই পথচারী আহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাবেষ্টনী রাখতে হবে। পাশে যে সংস্থা পাইপলাইন করবে, তাদেরও উচিত নিরাপত্তাবেষ্টনী দিয়ে সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান করা। কিন্তু মৌচাকে যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে ওয়াসা তত্ত্বাবধান করেছে কি না, সেটি দেখা দরকার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার জন্য সিটি করপোরেশন নির্মাণকারীদের নোটিশ করতে পারে। তা-ও করা হয় না।
যোগাযোগ করা হলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসিসির) মেয়র সাঈদ খোকন গতকাল রাতে বলেন, ‘পুরোপুরি নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকলে তো এমন দুর্ঘটনা ঘটত না। নির্মাণে গাফিলতি অবশ্যই আছে। তবে আমরা এ বিষয়ে যে তদন্ত কমিটি করেছি, প্রতিবেদন পেলে পুরো বিষয়টি স্পষ্ট হবে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ কুদরতউল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, সিটি করপোরেশন রাস্তায় নির্মাণকাজে সমস্যা হলে সাধারণত দেখার চেষ্টা করে। তবে যে এলাকায় উড়ালসড়কটি হচ্ছে সেখানকার রাস্তা, অবকাঠামো সবই প্রকল্পকারীদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
সময়মতো শেষ হচ্ছে না, খরচ বেড়েছে শতকোটি
২০১২ সালে এই উড়ালসড়কের কাজ শুরু হয়। প্রায় ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের তিনটি অংশের দুটি ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে চালু করার কথা ছিল। বাকি অংশ চালু হওয়ার কথা ছিল গত ডিসেম্বরে। গত বছরের ৩০ জুন উড়ালসড়কের সাতরাস্তা-হলি ফ্যামিলি (২ দশমিক ১১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য) অংশ উদ্বোধন করা হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর চালু হয় বাংলামোটর-মৌচাক অভিমুখী একটি অংশ। কাজ চলছে মৌচাকের দিক থেকে বাংলামোটর, মালিবাগ থেকে মৌচাক এবং শান্তিনগর ও রাজারবাগ অংশে। আগামী জুনের মধ্যে এটা চালু হবে বলা হলেও তা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। শুরুতে এই ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৭৬০ কোটি টাকা। কিন্তু খরচ ১০০ কোটি টাকার বেশি বেড়েছে।
মানুষের মধ্যে আতঙ্ক
গতকাল নগরীর সর্বত্রই ছিল উড়ালসড়কের গার্ডার পড়ে মানুষ মারা যাওয়ার আলোচনা। ছিল আতঙ্ক। দুপুর ১২টার দিকে উড়ালসড়কের শান্তিনগর, রাজারবাগ, মৌচাক এলাকা ঘুরে সাধারণ মানুষের মুখে শোনা যায় নানা অভিযোগ। শান্তিনগরে উড়ালসড়ক অংশ নেমে গেছে বাজারের কাছে। রাস্তার একপাশে একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করছিলেন ২০ বছর বয়সী রবিউল। মালিবাগের দুর্ঘটনাস্থল দেখেছেন। শান্তিনগরে নির্মাণকাজ দেখছেন অনেক দিন। তিনি বলেন, ‘এইখানেও গাদার (গার্ডার) বসানোর সময় মনে অইত এই বুজি পইড়া যায়। পড়তে পড়তে পড়ত না, আল্লায় বাঁচাইত।’
রাজারবাগে এক রিকশাচালক উড়ালসড়কের বেরিয়ে থাকা খোলা রড দেখিয়ে বললেন, ‘কতবার যে খোঁচা খাইছি।’
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে উড়ালসড়কের শান্তিনগর এবং এরপর রাজারবাগ অংশে আবার গিয়ে দেখা যায়, দুপাশ বেশ পরিষ্কার। কোথাও কোনো ব্লক, স্ল্যাব পড়ে নেই। যেন সেখানে কিছুই ঘটেনি। কেউ মারা যায়নি, কাটা পড়েনি কারও পা।
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1107538/%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A6%87-%E0%A6%89%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%B8%E0%A7%9C%E0%A6%95-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A3