১৪ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:৩১

প্রশ্নবিদ্ধ বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থা

 

বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেখানে নেই শিক্ষার মান, নেই যোগ্যতার সঠিক পরিমাপও। বেশির ভাগ মেডিকেল কলেজ প্রকারান্তরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আইন কমিশনের গবেষণায় উঠে এসেছে এসব চিত্র। এসব মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রেও কোনো নিয়মকানুন মানা হচ্ছে না বলে কমিশনের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এক বছর ধরে মাঠ পর্যায়ে পরিচালিত গবেষণা কার্যক্রমের আলোকে আইন কমিশন এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। প্রতিবেদনে দেশের চিকিৎসাখাতের দুরবস্থার পেছনে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও চিকিৎসকদের অর্থ উপার্জনকেও দায়ী করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মানবসেবার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ নয়, শুধুমাত্র অভিভাবকের চাপে অথবা অর্থ উপার্জনের উপায় বিবেচনায় চিকিৎসক হওয়ার জন্যই মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রথা প্রচলিত রয়েছে। কমিশনের গবেষণায় দেশের মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থা, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসার অবস্থা, চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস, নার্সিং সার্ভিস, ব্লাড ব্যাংক, জরুরি বিভাগ, ওষুধ ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসকদের নিরাপত্তা, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার সমস্যাগুলো উল্লেখ করে স্বাস্থ্য সেবার করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
গবেষণায় বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সংক্রান্ত সমস্যা তুলে ধরে বলা হয়, কম মেধার শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ায় সামগ্রিকভাবে শিক্ষার মান খারাপ হয়। নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বিপরীতে রোগীসহ অন্তত ৫টি শয্যা থাকা আবশ্যক, কিন্তু বেশির ভাগ বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পর্যাপ্ত শয্যা নেই। কিংবা শয্যা থাকলেও রোগী নেই, ফলে ছাত্রছাত্রীদের যথাযথভাবে হাতে কলমে শিক্ষা দেয়ার সুযোগ নেই। ডাক্তার ও নার্স এর সংখ্যা অপ্রতুল। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কোনো নীতিমালা ব্যতিরেকে নিজেদের খুশিমত অধ্যাপক, শিক্ষক ও ডাক্তার নিয়োগ দেয়। অধ্যাপক, অন্যান্য শিক্ষক ও ডাক্তারগণের মান মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। মৃতদেহের অভাবে শিক্ষার্থীদের অ্যানাটমি শিক্ষা যথাযথ হয় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো পড়াবার উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব, অথচ উক্ত মৌলিক বিষয়গুলোতে যথেষ্ট জ্ঞান ছাড়াই মেডিসিন, সার্জারি ইত্যাদি ব্যবহারিক বিষয়গুলোতে প্রকৃত শিক্ষা অর্জন সম্ভব নয়, দেশে ৭২টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ। কিন্তু মেডিকেল শিক্ষার মান করুণ, কারণ-পর্যাপ্তও উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, নার্স, শয্যা ও রোগীর অভাব।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামপ্রতিক বছরগুলোতে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রবণতা ভর্তি প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তবে গত বছর এই অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। পূর্ববর্তী বছরগুলোতে বিশেষ করে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর পরীক্ষার পাস নম্বর কমিয়ে কিংবা ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন সহজ করে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রাপ্তি নিশ্চিত করাও দুরবস্থার কারণ। উল্লিখিত সমস্যা সমাধানে অর্ধশত সুপারিশ করেছে আইন কমিশন। এর মধ্যে মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যবস্থা করা, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বিপরীতে রোগীসহ কমপক্ষে ৫টি শয্যা নিশ্চিত করা, বিদেশি ছাত্র কোটায় দেশি ছাত্র ভর্তি করার প্রচলিত প্রথা সম্পূণরূপে বন্ধ, প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রকৃত মেধা যাচাইয়ের জন্য উন্নত দেশসমূহের ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি নিরীক্ষা করে আরো কার্যকর কৌশল অবলম্বন ও পরীক্ষার পাস নম্বরকে অতি সহজলভ্য করার প্রবণতা পরিহার করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি কলেজগুলোর মধ্যে শিক্ষা ব্যয়ের বিরাজমান অস্বাভাবিক ব্যবধান কমিয়ে অযোগ্য শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ সংকুচিত করতে হবে।
সমপ্রতি এক মতবিনিয়ম সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর সাবেক ভিসি নজরুল ইসলাম ঢালাওভাবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অনুমোদনের সমালোচনা করেন। স্বাস্থ্যশিক্ষায় গুণগত মান চাইলে দেশের ৭৫ শতাংশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ বন্ধ করে দিতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। আবার কিছু সরকারি মেডিকেল কলেজেও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। তিনি বলেন, এখন বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ২০ থেকে ২২ লাখ টাকা দিতে হয়। এটা কি কোনো মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো? কে দিয়েছে এসব অনুমোদন? যারা দিয়েছেন, তারা তো চিকিৎসা নিতে যাবেন সিঙ্গাপুরে। তিনি বলেন, আমরা ডাক্তার বলে যাদের তৈরি করছি, তাদের কাছে কি আমরা চিকিৎসা নিতে তৈরি?’ আবার এমন সরকারি মেডিকেল কলেজও আছে, যেখানে একটি আলমারি নিয়ে অ্যানাটমি বিভাগ। তাই শুধু ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে নয়, সব বিষয় নিয়েই আলোচনা করতে হবে।
ডাক্তার-শিক্ষক নেই, রোগীও নেই: দেশে বর্তমানে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ৭২টি এবং ডেন্টাল কলেজ ও ইউনিটের সংখ্যা ২৫টি। এদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলোর মান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। বিভিন্ন সরকারের সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব মেডিকেল কলেজ অনুমোদন পায়। বেশিরভাগ মেডিকেল কলেজের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার মতো শিক্ষক, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি কিছুই নেই। কর্মরত চিকিৎসকদের বেশিরভাগই সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের পাঠদান কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছেন। খণ্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যাও প্রায় সমান। বিশেষ করে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, প্যাথলজি, বায়োকেমিস্ট্রির মতো বেসিক সায়েন্সের বিষয়গুলো পড়ানোর মতো শিক্ষক নেই। হাসপাতালেও নেই রোগী।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)’র উপ-রেজিস্ট্রার ডা. মো. আরমান হোসেন মানবজমিনকে বলেন, আমাদের নীতিমালা ওয়ার্ল্ড স্ট্যান্ডার্স। কারো পক্ষে পুরোপুরি মানা সম্ভব নয়। পরিদর্শনে গেলে কিছু কিছু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উপযুক্ত শিক্ষক পাওয়া যায় না। রয়েছে শিক্ষক সংকট। হাসপাতালের শয্যা অনুপাতে রোগী কম। শিক্ষার উপকরণও কম। আবার কিছু ভালোও আছে। তিনি বলেন, আমাদের চেয়ে ভারত ও পাকিস্তারের মেডিকেলে শিক্ষার্থীরা ভালো করছে। আশির দশকে আমরা ভাল করেছিলাম। এখন পিছিয়ে যাচ্ছি। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, এত মেডিকেল কলেজ কেন অনুমোদন দেয়া। যোগ্য শিক্ষক নেই। এ অবস্থায় প্রোডাক্ট খারাপ হবে। এ থেকে মেডিকেল শিক্ষাকে রক্ষা করতে হবে।
হাতে-কলমে শেখার সুযোগ কম: উচ্চ ব্যয়, অনিয়মিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, রোগী ও স্বজনদের আস্থার অভাব ইত্যাদি কারণে রোগীরা বেসরকারি হাসপাতালমুখী হচ্ছে না। বেশিরভাগ মেডিকেলে মেডিসিন, সার্জারি ও গাইনি রোগের বাইরে অন্য রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। ফলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
শিক্ষক সংকট: বিএমডিসির শর্তানুযায়ী, ৫০ শিক্ষার্থীর জন্য মৌলিক বিজ্ঞানে ১১ জন শিক্ষক থাকতে হবে। একশ্থ শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১৫, দেড়শ্থ শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১৯ ও দুইশ্থ শিক্ষার্থীর বিপরীতে ২৪ জন শিক্ষক থাকতে হবে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সমপ্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপনে নীতিমালা বাস্তবায়নে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। বর্তমানে নিবন্ধিত চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় ৮১ হাজার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র মতে, সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতেই মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয় অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, ফার্মাকোলজি, কমিউনিটি মেডিসিন, মাইক্রোবায়োলজি, প্যাথলজি, বায়োকেমিস্ট্রি ও ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে ভয়াবহ শিক্ষক সঙ্কট চলছে। ৩১টি সরকারি মেডিকেল কলেজে এসব বিষয়ে অনুমোদিত ৫১৬ পদের বিপরীতে ৪২৩ জন শিক্ষক রয়েছেন। তাদের মধ্যে অধ্যাপক আছেন মাত্র ৩৫ জন। সব মেডিকেল কলেজে অধ্যাপকের পদও নেই। এসব বিষয়ে বেসরকারি কোনো মেডিকেল কলেজে কতজন শিক্ষক রয়েছেন, কোন পদে কয়টি শূন্যপদ রয়েছে, সেসবের হিসাব নেই অধিদপ্তরের কাছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা ২০১১ (সংশোধিত) অনুযায়ী, মেডিকেল কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম চালুর অন্তত দুই বছর আগে একটি হাসপাতাল চালু করতে হবে। আড়াইশ্থ শয্যার হাসপাতাল ভবন এবং কলেজের জন্য পৃথক একাডেমিক ভবন থাকলে ৫০ আসনের মেডিকেল কলেজ অনুমোদন দেয়া যাবে। প্রতিটি বিষয়ে ১০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক থাকতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় একাডেমিক ও হাসপাতাল মিলে মোট এক লাখ ২৫ হাজার বর্গফুটের ফ্লোরস্পেস ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো থাকলে মেডিকেল কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম শুরুর অনুমতি পাওয়া যাবে। পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন দুই লাখ বর্গফুট ফ্লোরস্পেসসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ করতে হবে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল শুধু নির্ধারিত প্লট বা জমিতে স্থাপন করা যাবে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সমপ্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, সরকারি নীতিমালার শর্তপূরণ না করে কোনো মেডিকেল কলেজ আর শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারবে না। নীতিমালার শর্তপূরণ না করায় চারটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে।
http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=57385&cat=3/%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A7-%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%B8%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF-%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%A1%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%B2-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AC%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BE