১৩ মার্চ ২০১৭, সোমবার, ৯:৩২

ক্রেডিট কার্ডের হিডেন চার্জে পিষ্ট গ্রাহক

ক্রেডিট কার্ডের হিডেন চার্জে (অপ্রদর্শিত চার্জ) পিষ্ট হচ্ছেন গ্রাহকরা। এ সার্ভিসের নামে অস্বাভাবিক হারে সুদ নিচ্ছে দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলো। প্রতিবেশী দেশগুলোয় এ হার ১২-৩০ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে তা সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ। হিডেন চার্জসহ প্রায় ৪০ শতাংশ সুদ কেটে নেয়া হচ্ছে। গত কয়েক বছরে আমানতের সুদহার অর্ধেকে নেমে এলেও ক্রেডিট কার্ডের সুদহার কমেনি। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুস্পষ্ট গাইড লাইন না থাকাতে নিজেদের ইচ্ছামত সুদ আদায় করছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এদিকে ক্রেডিট কার্ডের উচ্চ সুদে নাকাল অনেকেই অভিযোগ করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি এন্ড কাস্টমার সার্ভিসেস বিভাগে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘অপ্রদর্শিত চার্জ’ (হিডেন চার্জ) নামের যাঁতাকলে এর সুদহার আরও বাড়ানো হচ্ছে। ফলে আগামীতে আরও বেশি পিষ্ট হবেন ক্রেডিট কার্ডধারীরা। ইতোমধ্যে কার্ড জমা দিয়ে কেউ কেউ ক্রেডিট কার্ডের লোভনীয় ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এলেও ঋণের জালে জর্জরিত হচ্ছেন অধিকাংশ গ্রাহক। তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে দেশী ব্যাংকগুলোর প্রকাশ্য সুদহার বিশ্বের অন্যান্য দেশের ব্যাংকগুলোর তুলনায় অনেক বেশি নিচ্ছে। এর ওপর রয়েছে ২০ থেকে ৩০ রকমের ‘হিডেন চার্জ’। সব মিলিয়ে গড় সুদহার পড়ছে ৪০ শতাংশের বেশি। এদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ব্যাংকগুলোয় ক্রেডিট কার্ডের বার্ষিক সুদ হচ্ছে ১৮ থেকে ৩০ শতাংশ, মিয়ানমারে ১২ দশমিক ৮৪ থেকে ১৩ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ১৯ দশমিক ৬৮ থেকে ২৪ শতাংশ, চীনে ১৮ দশমিক ৫৫ থেকে ২৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

জানা গেছে, গত কয়েক বছরে আমানতের সুদহার অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিভিন্ন ধরনের ঋণের সুদহার কমেছে। কিন্তু ক্রেডিট কার্ডের সুদহার কমেনি। বরং ক্ষেত্রবিশেষ বেড়েছে। বেড়েছে আনুষঙ্গিক চার্জও। এদিকে কার্ডধারীর সংখ্যা দ্রত বেড়ে ১০ লাখে পৌঁছালেও চড়া সুদের কারণে এ সংখ্যা এখন আর বাড়ছে না, বরং কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, প্রতি মাসে ১৫ থেকে ১৬ হাজার ব্যবহারকারী ক্রেডিট কার্ড জমা দিচ্ছেন ব্যাংকগুলোয়।

এসব ব্যাংকের কর্মকর্তারা লোভনীয় অফার দিয়ে ক্রেডিট কার্ড করছে। নানা সুযোগ সুবিধার কথা বললেও সর্বোচ্চ সুদ হারের কথা উল্লেখ করেন না। আধুনিক ব্যাংকের নামে গ্রাহকদের সুদের দড়ি গলায় ঝুলিয়ে নামে বেনামে হিডেন চার্জ কর্তন করছে ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ করেও কোন সুরহা হয়নি। প্রতি নিয়তই তারা নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, ক্রেডিট কার্ডে ব্যাংকগুলো ইচ্ছেমতো সুদ নিচ্ছে। যা বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বেশি। এ অবস্থায় ক্রেডিট কার্ডের সুদহারের লাগাম টেনে ধরতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুস্পষ্ট নির্দেশনা বা গাইডলাইন থাকা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট কোন গাইড লাইন না থাকাতেই নিজেদের ইচ্ছামত সুদ নিচ্ছে এসব ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশের ওপরে সুদ গ্রহণকারী ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে সিটি ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংক। ব্যাংক দুটির সুদহার যথাক্রমে ৩৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ও ২৮ দশমিক ৫০ থেকে ৩১ দশমিক ৫০ পর্যন্ত। এরপর সর্বাধিক ৩০ শতাংশ হারে সুদ নিচ্ছে ১৩টি ব্যাংক। এগুলোর মধ্যে রয়েছে; ব্যাংক এশিয়া, ইস্টার্ন, এক্সিম, মধুমতি, মার্কেন্টাইল, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ন্যাশনাল ক্রেডিট এন্ড কমার্স (এনসিসিবিএল), এনআরবি, প্রাইম, সাউথইস্ট, স্ট্যান্ডার্ড, ট্রাস্ট ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল (ইউসিবিএল) ব্যাংক। এছাড়া ২৪ শতাংশ হারে সুদ নেয়া ছয়টি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে এবি ব্যাংক, ঢাকা, আইএফআইসি, প্রিমিয়ার, এসআইবিএল ও কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড। তবে ২৭ থেকে ৩০ শতাংশ সুদ নিচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংক, ১৯ দশমিক ২৫ শতাংশ ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, বিসিবিএল ও ডাচ্-বাংলা ১৮ শতাংশ সুদ নিলেও সর্বনিম্ন যমুনা ব্যাংকের সুদহার ১৭ শতাংশ।

ক্রেডিট কার্ডে ব্যাংকগুলোর অতি উচ্চ সুদের বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংক সংশ্লিষ্ট অযাচিত বিষয়ের নিয়ন্ত্রণকারী বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন ক্রেডিট কার্ডে সুদহার বেশি মনে হলে তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণমূলক নির্দেশনা দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রকাশ্য সুদের পাশাপাশি যদি হিডেন চার্জ নিয়ে তফসিলি ব্যাংকগুলো কোনো অনিয়ম করে, তবে ভুক্তভোগীদের উচিত হবে সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ দেয়া। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও উচিত হবে অভিযোগ অনুযায়ী কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া।

গ্রাহকদের অভিযোগ, ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটা করা মানেই ফাঁদে পা দেয়া। লোন নিয়ে বাজার করলেই দিতে হয় প্রায় দ্বিগুণ। মাত্রাতিরিক্ত সুদের পাশাপাশি ডলারের রেট নিয়েও ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে রয়েছে বেশ অভিযোগ। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে যারা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করেন, তারা ব্যাংকে বিল পরিশোধ করতে গেলে ডলারের বাজার রেটের চেয়ে দেড় থেকে দুই টাকা বেশি দরে পরিশোধ করতে হয়।

দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী এডভোকেট শাহ আলম সরকার। তিনি সুদের এ উচ্চ হারে ক্ষোভ প্রকাশ করে দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, এক পয়সাও লিমিট ক্রস করলে ৪০০ থেকে সাড়ে ৪০০ টাকা ‘ওভার লিমিট ফি’, আবার লাস্ট ডেট ছুটির দিন হলেও ‘লেট পেমেন্ট ফি’সহ নানা রকম হিডেন চার্জ দিতে হয়। নানা অজুহাতে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ সুদহারের এ তালবাহানার ঋণ মরণফাঁদ ছাড়া আর কিছুই নয়। লাস্ট ডেট ছুটির দিন হলেও পরের অফিস ডে’তে লেট পেমেন্ট ফি ছাড়া বিল পরিশোধ করা যায় না- যা সবচেয়ে বড় ধরনের ধোঁকাবাজি। বহু কষ্টে এ থেকে বের হতে পেরেছি। উচ্চ সুদহার থেকে রক্ষা পেতে আমি কার্ডটি এরই মধ্যে ফিরিয়ে দিয়েছি।

তিনি বলেন, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের যথাযথ ও সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা দরকার। তা না হলে গ্রাহকরা এভাবে ঠকতেই থাকবেন। ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের জিম্মি করে নিজেরা মুনাফা করতেই থাকবে।

ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর বিদ্যমান সুদহার বেশি কি না জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। তবে বর্তমানের এ সুদহার মোটেও বেশি নয় এতটুকু বলতে পারি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, সাধারণত ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী বা অন্য পেশাজীবী, যাদের ভালো আয় আছে এবং যারা বৈধ কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন), তারাই ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী একটি ক্রেডিট কার্ডের লিমিট বা টাকা খরচ করার সর্বোচ্চ সীমা পাঁচ লাখ টাকা। গ্রাহকের মাসিক আয়ের ভিত্তিতে এ সীমা নির্ধারিত হয়। ভিসা ও মাস্টার কার্ড প্লাটিনামের বার্ষিক ফি সাড়ে চার হাজার টাকা, গোল্ড কার্ড আড়াই হাজার টাকা এবং ক্লাসিক বা সিলভার কার্ড দেড় হাজার টাকা। ক্রেডিট কার্ডে নগদ টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে আড়াই শতাংশ বা ১৫০ টাকা সার্ভিস চার্জ কাটা হয়। ডলারে অর্থ নিলে তিন শতাংশ বা পাঁচ ডলার চার্জ লাগে। সময়মতো অর্থ পরিশোধ না করলে ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা এবং পাঁচ থেকে ১৫ ডলার জরিমানা কাটে ব্যাংক।

http://www.dailysangram.com/post/275410