১৩ মার্চ ২০১৭, সোমবার, ৯:২৬

নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্তের ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া সরকার

মামলার সকল পর্যায়েই পক্ষে রায় পেয়েছেন মামলার বাদী। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাময়িক বরখাস্তের বিধান অকার্যকর বলে ঘোষণা করা হয়েছে এই রায়ে। কিন্তু মামলায় জিতেও রাজশাহীর নির্বাচিত মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল আজও দায়িত্ব ফিরে পাননি। কারণ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্তের ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সরকারি পক্ষ।

মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বনাম সরকার পক্ষের মামলার রায়ে মন্ত্রণালয়ের বিধান অকার্যকর হওয়ায় ইতঃপূর্বে বরখাস্তকৃত জনপ্রতিনিধিরা স্ব স্ব পদে ফিরতে পারবেন বলেও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এতে বিব্রত হয়ে পড়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সরকার কর্তৃক সাময়িক বরখাস্তকৃত শতাধিক জনপ্রতিনিধি এখন তাদের স্ব স্ব পদে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন।

উচ্চ আদালতের রায় : মোহাম্মদ মোসাদেক হোসেন বনাম বাংলাদেশ সরকারের মধ্যকার রিট পিটিশনের প্রেক্ষিতে গত ১০ মার্চ ২০১৬ হাইকোর্ট যে আদেশ দেন তার বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ আপিল করে। আপিল আদালত সরকারের আপিল খারিজ করে দিয়ে হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন। হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়, ২০০৯ সালের স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইনের ১২(১) ধারার বলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সাময়িক বরখাস্ত সংক্রান্ত যে বিতর্কিত অর্ডার ইস্যু করে তা আইনগত কর্তৃত্ব ছাড়াই করা হয়, ফলে এর কোনো আইনগত কার্যকারিতা নেই। হাইকোর্টের এই আদেশে সরকারকে এ সংক্রান্ত বিধি-বিধান সংশোধন করার জন্য বলা হয়। এছাড়া নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলরদের বরখাস্ত করার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য বিধি তৈরির জন্যও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।

স্থানীয় সরকারের সেই বিধান : স্থানীয় সরকারের সেই বিতর্কিত বিধানে বলা হয়েছে, কোনো সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বা কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় চার্জশিট বা অভিযোগপত্র গৃহীত হলে সরকার লিখিত আদেশের মাধ্যমে ওই মেয়র বা কাউন্সিলরকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারবে। স্থানীয় সরকারের অন্যান্য স্তর যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভার ক্ষেত্রেও আইনে একই রকম বিধান রাখা হয়েছে। স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইনের ৩৪(১) ধারা, স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) আইনের ১৩খ(১) ধারা এবং স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইনের ৩১(১) ধারায়ও বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় আদালতে চার্জশিট গৃহীত হলে বা আদালত কোনো ফৌজদারি অপরাধ আমলে নিলে সরকার লিখিত আদেশের মাধ্যমে ওই জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারবে।

বর্তমান সরকারের আমলে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত অনেক জনপ্রতিনিধি বিভিন্ন মামলায় চার্জশিটভুক্ত হওয়ায় তাদের একের পর এক সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জনপ্রতিনিধি পদ ফিরেও পেয়েছেন। ফলে স্থানীয় সরকার আইনের ওইসব ধারার কার্যকারিতা থাকছে না। সর্বশেষ গত ৫ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের সাময়িক বরখাস্তের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখেছেন। বিএনপির এই নেতা মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৫ সালের ৭ মে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। এরপর তিনি হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। শুনানি শেষে হাইকোর্ট একই বছরের ২৮ মে এক রায়ে বুলবুলের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ স্থগিত করেন। রিটের পূর্ণাঙ্গ শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ১০ মার্চ হাইকোর্ট স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন এবং বুলবুলকে মেয়র পদে পুনর্বহালের নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল বিভাগে আবেদন করলে চেম্বার জজ হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন। গত ৫ মার্চ আপিল বিভাগ সরকারের আবেদন খারিজ করে দেন। এখন বুলবুলের মেয়র পদ ফিরে পেতে আর কোনো আইনগত বাধা নেই বলে তার আইনজীবীরা জানান। তবে সরকার ইচ্ছা করলে রিভিউ আবেদন করতে পারে। সেক্ষেত্রে বুলবুলের মেয়র পদ ফিরে পেতে আরো কিছুদিন সময় লাগতে পারে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় মামলার রায় সংক্রান্ত কাগজপত্র এখনও হাতে পায়নি। পাওয়ার পর আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে সূত্র জানায়।

উল্লেখ্য, বিভিন্ন পর্যায়ের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পর শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরই মধ্যে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে পদ ফিরে পেয়েছেন ৪০ জনের বেশি জনপ্রতিনিধি, যাদের প্রায় সবাই বিএনপি ও জোটের নেতা বা সমর্থক। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, রাজনৈতিক স্বার্থেই বিএনপি ও তার মিত্রদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতে না দেয়ার জন্যই আইনে এমন বিধান রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে বিএনপি ও তার মিত্র দলের নেতাকর্মীদের ক্ষেত্রেই বিধানটি প্রয়োগ করা হচ্ছে। জানা গেছে, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের ৪১ জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ এ পর্যন্ত স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। এ সময়ে বিভিন্ন জেলায় শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তাদের মধ্যে আছেন দিনাজপুরের ১১ জন, ঁচঁপাইনবাবগঞ্জের ৯ জন, কক্সবাজারের পাঁচজন, সাতক্ষীরার আটজন, বগুড়ার ২০ জন, চাঁদপুরের চারজন, হবিগঞ্জের চারজন, রাজশাহীর দু’জন, সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীসহ ৯ জন, ধোবাউড়া উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ময়মনসিংহের দু’জন, শরীয়তপুরের পৌর মেয়র, কিশোরগঞ্জের তিনজন, নড়াইলের একজন ও নারায়ণগঞ্জের দু’জন। তাদের মধ্যে শরীয়তপুরের পৌর মেয়র আবদুর রব মুন্সী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি একটি দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে পড়ায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ১১ জন হলেন জামায়াতের। বাকি সবাই বিএনপির বলে জানা গেছে। রাজশাহীর বুলবুলকে মেয়র পদে পুনর্বহাল করতে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া আদেশের পর জনপ্রতিনিধিদের সাময়িক বরখাস্তের বিধানটি কার্যকারিতা হারাবে বলেই মনে করেন আইনজ্ঞ ও বিশিষ্টজনরা। এ পর্যন্ত সাময়িক বরখাস্ত হওয়া সব জনপ্রতিনিধি স্বপদে ফিরবেন বলে তাদের অভিমত।

বাধা স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা : মামলায় জিতে কিংবা উচ্চ আদালতের আদেশ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বরখাস্তকৃত জনপ্রতিনিধিরা চেয়ারে বসে যাচ্ছেন। সেসব স্থানে স্থানীয়ভাবে তেমন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয় না বলে সমস্যা হয় না। কিন্তু রাজশাহীর ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার দলীয় এক প্রভাবশালী নেতা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ঐ নেতা তার এক আত্মীয়কে মেয়রের দায়িত্বে বসিয়ে রেখে কর্পোরেশন শাসন করছেন। ফলে মামলার রায় যাই হোক না কেন- মন্ত্রণালয়ে কলকাঠি নেড়ে ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ মেয়রের মেয়াদ যতটা সম্ভব টিকিয়ে রাখতে উঠেপড়ে লেগেছেন বলে অভিযোগ করছেন মামলার বিজয়ী পক্ষ।

রাজশাহীর একজন বিশিষ্ট আইনজীবী এডভোকেট এনামূল হক মনে করেন, ‘মোসাদ্দেক হোসেন বনাম সরকার মামলা’র রায় একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এর ফলে জননির্বাচিত প্রতিনিধিগণ মন্ত্রণালয়ের চিঠির বলে পদবঞ্চিত হওয়ার কবল থেকে সুরক্ষা পাবেন। তিনি উল্লেখ করেন, হাইকোর্টের আদেশের বিষয়ে মন্ত্রণালয় রিভিউ পিটিশন করবে বলে যে কথা শোনা যাচ্ছে সেটা তারা করতে পারেন। তবে কেবল সময় ক্ষেপণের জন্যই তা করা হবে। কেননা, যে আপিল বিভাগ সরকারের আর্জি খারিজ করে দিয়েছেন তাদের কাছেই বিষয়টি পুনরায় উত্থাপিত হবে। বিষয়টিতে কেবল কারো জীবন-মরণ প্রশ্ন জড়িত থাকলে সেক্ষেত্রে রিভিউয়ের কথা আসতে পারে।

http://www.dailysangram.com/post/275403