১৩ মার্চ ২০১৭, সোমবার, ৯:২২

দেশপ্রেমের চশমা

কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ভালোবাসা থেরাপি ব্যবহার করুন

মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার

কিশোর অপরাধের ব্যাপকতা আশংকাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। রাজধানীসহ সারা দেশের বড় বড় শহরে ছড়িয়ে পড়েছে কিশোর অপরাধীদের অসংখ্য গ্রুপ। এদের বয়স ১৩ থেকে শুরু করে ২০-এর মধ্যে। যে বয়সে স্কুলে লেখাপড়া এবং মাঠে খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা, সে বয়সে এসব কিশোর বিপথগামী হয়ে সন্ত্রাস ও অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। গড়ে তুলেছে এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন। এরা ইভটিজিং, মাদক সেবন থেকে শুরু করে খুন-খারাবির মতো অপরাধেও জড়িয়ে পড়েছে। রাজধানীর এমন কোনো এলাকা নেই যে এলাকায় এসব কিশোর অপরাধীর দৌরাত্ম্য নেই। ইতিমধ্যে প্রিন্ট ও ইলেকট্রুনিক গণমাধ্যম এদের পরিচিতি ও অপরাধকর্ম তুলে ধরেছে। আকর্ষণীয় নামধারী বিভিন্ন গ্রুপের এ কিশোর গ্যাংস্টারদের আবার বড় অপরাধী ও এলাকার রাজনৈতিক ক্যাডারদের সঙ্গেও লিয়াজোঁ রয়েছে। উপর থেকে প্রশ্রয় না পেলে এদের পক্ষে বেশিদিন টিকে থাকা সম্ভব হতো না। এদের অনেকেই নামি-দামি স্কুলের ছাত্র। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া না করে, বা এক্ষেত্রে কম মনোযোগী হয়ে এরা অপরাধমূলক কাজে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে।

কিশোর গ্যাং গ্রুপগুলোর কর্মতৎপরতা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এরা ছোট ছোট এলাকায় বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করে। এদের এলাকার পরিধির মতো গ্রুপের সদস্য সংখ্যাও সীমিত। যেমন- রাজধানীর কেবল উত্তরা এলাকায়ই রয়েছে প্রায় ৩০টি কিশোর গ্যাং গ্রুপ। এ থেকে অনুমান করা যায় একেকটি গ্রুপের এলাকা কত বড় হতে পারে। সাধারণত এদের প্রাথমিক কাজ হল মোটরসাইকেলে মহড়া দেয়া। স্কুলগামী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা। অনেক ক্ষেত্রে ছোটখাটো ছিনতাই করা। মাদক সেবন করা। মাদক, চোরাচালান এবং অনেক ক্ষেত্রে অস্ত্র চোরাচালন ও বিক্রয়ের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করা। গার্লস ¯ু‹লের আশপাশে এবং রাস্তার মোড়ে মোড়ে আড্ডা মারা। সিগারেটসহ অন্য নানারকম নেশা করা। এসব কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে এরা নিজ এলাকায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং অন্য এলাকার কাউকে নিজ এলাকায় এসে মাতব্বরি করতে দেয় না। এরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। ফেসবুকে এদের প্রায় প্রত্যেকে সক্রিয়। সেখানে বিভিন্ন রকম স্ট্যাটাস দিয়ে এদের মধ্যে হিরোগিরি ফলানোর একটা প্রবণতা রয়েছে। আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে সাধারণত এদের শাস্তি হয় না। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হওয়ায় এরা দ্রুত ছাড়া পেয়ে যায়। একই এলাকার বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে এরা খুন-খারাবির মতো ঘটনায়ও জড়িত হয়ে পড়েছে। গত জানুয়ারি মাসে রাজধানীর উত্তরার ‘ডিসকো বয়েজ’ এবং ‘নাইন স্টার’ গ্রুপের দ্বন্দ্বে আদনান নিহত হলে গ্যাং গ্রুপগুলোর অপতৎপরতা নতুন করে আইনশৃংখলা বাহিনী ও সুশীলসমাজের নজরে আসে।

সরকার এসব গ্যাং গ্রুপের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমন করার জন্য যে পলিসি গ্রহণ করেছে তাতে কোনো ফল হচ্ছে না। আইনশৃংখলা বাহিনীর উচ্চপর্যায় থেকে এসব গ্রুপের কার্যক্রম দমন করার জন্য আইনশৃংখলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পুলিশ বাহিনী যে কোনো অ্যাকশন নিচ্ছে না তা নয়; কিন্তু পুলিশি অ্যাকশনে কিশোর অপরাধ কমছে না। বরং দিন দিন এ অপতৎপরতা বাড়ছে এবং তা ক্রমান্বয়ে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ছে। সরকারকে মনে রাখতে হবে, শক্তি দিয়ে বা ভয় দেখিয়ে কিশোরদের এ অপকর্ম থেকে নিষ্ক্রিয় করা যাবে না। এর জন্য সুচিন্তিত স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকারি দলসহ সব রাজনৈতিক দলেরই ভূমিকা আছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি নির্বাচনের সময় নিজ প্রার্থীকে জেতাতে কিশোর বয়সী অপরাধীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করে তাদের সন্ত্রাসকর্মে প্রশ্রয় দেয়, তাহলে নির্বাচনের পর তাদের রাতারাতি ভালো হয়ে যেতে বললে সে উপদেশ কাজ করবে না। এক্ষেত্রে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করে শিশু-কিশোরদের পারিবারিক মায়া-মমতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক্সট্রা কারিকুলাম কার্যক্রম বাড়িয়ে কিশোরদের সেসব কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং সমাজে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের বেশি করে সম্পৃক্ত করতে হবে, যাতে করে তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আকৃষ্ট না হয়। উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল কাজে কিশোরদের সম্পৃক্ত করে তাদের একাডেমিক ব্যস্ততা বৃদ্ধি করতে হবে। পুলিশি অ্যাকশনের পাশাপাশি এসব উদ্যোগ নিলে এক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রহসনের দশম সংসদ নির্বাচনে ভোটারশূন্য ভোট কেন্দ্রে কিশোরদের দিয়ে জালভোট দেয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে উপজেলা থেকে শুরু করে প্রতিটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীরা জয়ী হওয়ার জন্য জালভোট প্রদান এবং অন্যান্য নির্বাচনী অনিয়মের কাজে কিশোরদের ব্যবহার করেছেন। সংবাদপত্রে এসব অন্যায়কারী কিশোরের ছবি ছাপা হয়েছে। এ কিশোররা রাজনৈতিক প্রশ্রয় পেয়ে নির্বাচনের পরও বিভিন্ন রকম দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমূলক কাজে জড়িত হতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতা, কর্মী বা ক্যাডারদের কাছ থেকে প্রশ্রয় পেয়ে কিশোর অপরাধীরা বেশিমাত্রায় অপরাধ করতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। এসব কিশোর অপরাধী সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা ও অবস্থা থেকে অপরাধের অনুকূল পরিবেশ পেয়ে অপরাধমূলক কাজে উৎসাহ পাচ্ছে। কিশোর অপরাধীরা যখন দেখছে, কোনো কিশোর অপরাধী পুলিশের কাছে ধরা পড়ার পর দ্রুত ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে তখন তারা আর থানা পুলিশকে ভয় পাচ্ছে না।

যেহেতু এসব অপরাধীর অধিকাংশই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান সে কারণে এরা দামি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। এদের প্রায় প্রত্যেকের হাতেই থাকে দামি অ্যানড্রয়েড স্মার্ট ফোন। পারিবারিক পরিবেশে ভারতীয় সাটেলাইট সংস্কৃতি, অবাস্তব কর্মকাণ্ড ও পরকীয়াসমৃদ্ধ সিরিয়াল দ্বারা কিশোররা প্রভাবিত হচ্ছে। তারা সন্ত্রাস, পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহ, পরকীয়া, সংঘাত, শত্রুকে খাবারে বিষ প্রয়োগে হত্যা ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। এর পাশাপাশি অনেক কিশোর ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে অপসংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হয়ে পড়ায় সন্ত্রাস, পর্নোগ্রাফি এবং জঙ্গি তৎপরতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে নামি-দামি স্কুলগুলো স্কুলে মোবাইল ফোন সঙ্গে রাখার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এতে স্কুলের বাইরে শিক্ষার্থীরা যে সময় পাচ্ছে সে সময়ে তারা ইন্টারনেটে বেশি সময় দিচ্ছে। ইন্টারনেট থেকে কিশোর শিক্ষার্থীদের দূরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এখন সময় এসেছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীদের বকাঝকা না করে তাদের ইন্টারনেটের ইতিবাচক ব্যবহারের প্রতি মনোযোগী করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এখন চিন্তা করতে হবে যাতে তারা শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেটের গঠনমূলক ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে এবং ইন্টারনেটের নেতিবাচক ব্যবহারের ক্ষতি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সতর্ক করতে পারে।

আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে কিশোর গ্যাং গ্রুপ দমনে পুলিশের তৎপরতা বন্ধ করতে বলছি না। কারণ, পুলিশি তৎপরতার তাৎক্ষণিক উপযোগিতা আছে। এ প্রক্রিয়া কিশোর অপরাধীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত না হতে তাদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করে। এ তৎপরতা চলমান থাকতে পারে। তবে এ প্রসঙ্গে একথাও মনে রাখতে হবে, কেবল পুলিশি অ্যাকশনের সাহায্যে এ অপরাধ দমন করা যাবে না। এর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থার অংশ হিসেবে শিক্ষা ও সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াকে সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবহারের ওপর জোর দিতে পরামর্শ দিচ্ছি। এ প্রক্রিয়ায় পুলিশ বাহিনীও শামিল হতে পারে। ঢাকার যে শতাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপ সদস্যদের নাম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, পুলিশ তাদের শাস্তি না দিয়ে এর পরিবর্তে নিজ আয়ত্তে নিয়ে কয়েক পর্বে ভাগ করে এক বা দু’সপ্তাহব্যাপী ওরিয়েন্টেশন ওয়ার্কশপ করার বিষয়ে ভাবতে পারে। এসব দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচিতে তাদের বাছাইকৃত চলচ্চিত্র দেখিয়ে, সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে আগ্রহ জাগিয়ে এবং মনস্তত্ত্ববিদ, অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানীদের লেখা প্রবন্ধ শুনিয়ে ও পরামর্শ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করে অপরাধকর্মে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করা যায়। বিশেষভাবে নির্বাচিত নাচ-গান, নাটকের মাধ্যমে তাদের একরকম সাংস্কৃতিক থেরাপি দেয়ার কথা ভাবা যায়। এ রকম সংশোধন প্রচেষ্টায় ভালো ফল আসতে পারে এবং এতে অনেক বিপথগামী কিশোর অপরাধ জগৎ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। এদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে, গ্রেফতার করে থানা ও জেলে দিলে অনেক ক্ষেত্রে তারা ছোট সন্ত্রাসী থেকে আরও বড় সন্ত্রাসী হয়ে উঠতে পারে। জেলখানার দূষিত পরিবেশে অন্য পেশাদার সন্ত্রাসীদের সংস্পর্শে এসে তারা আরও বড় সন্ত্রাসকর্মে আকৃষ্ট হতে পারে।

মনে রাখতে হবে, কিশোর অপরাধী গ্যাং গ্রুপের সদস্যদের কেউই অপরাধী হয়ে জন্ম নেয়নি। ওরা তো আমাদেরই সন্তান। এ সমাজেরই সদস্য। পারিবারিক ও সামাজিক বাস্তবতায় আজ হয়তো তারা বিপথগামী হয়ে সন্ত্রাসী হয়ে উঠেছে। এজন্য তাদের দিকে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ না করে যদি সহানুভূতির দৃষ্টি নিয়ে তাকানো যায়, তাহলে তাদের সামাজিক মায়া-মমতার বন্ধনে আবদ্ধ করে আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। আইনশৃংখলা বাহিনীর সম্মানিত সদস্যদের অনুরোধ করব এসব কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসী গ্রুপ সদস্যদের হ্যান্ডল করার ক্ষেত্রে তাদের প্রতি কঠোর ও নিষ্ঠুর আচরণ না করতে। এক্ষেত্রে মানবিক আচরণকারী পুরুষ পুলিশ সদস্য এবং হৃদয়বান নারী পুলিশ সদস্যদের ব্যবহার করুন। তাদেরকে মায়া-মমতা ও ভালোবাসার চোখে এসব কিশোর সন্ত্রাসীর দিকে তাকাতে বলুন। ভালোবাসা থেরাপিস্টের ভূমিকা নিয়ে কিশোর গ্যাং গ্রুপ সদস্যদের পরিকল্পিতভাবে হ্যান্ডেল করতে পারলে অনেক কিশোর সন্ত্রাসীকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

akhtermy@gmail.com

http://www.jugantor.com/window/2017/03/13/108542