১২ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ১০:৩০

ই-টেন্ডারেও প্রভাব আর দৌরাত্ম্য

সরকার ই-টেন্ডার পদ্ধতি চালু করলেও এর কাঙ্ক্ষিত সুফল পাচ্ছেন না অনেক সাধারণ ঠিকাদার। কাজের অভিজ্ঞতা সার্টিফিকেট (সিমিলার ওয়ার্ক) ও আর্থিক সচ্ছলতা সনদপত্রসহ (ব্যাংক লিকুইডিটি) নির্বাহী প্রকৌশলীদের নানা শর্ত জুড়ে দেওয়ার কারণে অনেক সাধারণ ঠিকাদার ই-টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। আর এর সুযোগ নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য ঠিকাদাররা।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ই-টেন্ডার চালু হওয়ায় সাধারণ ঠিকাদাররা অনলাইনের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব ও টেন্ডারবাজিমুক্ত হয়ে ঘরে বসেই ছোট-বড় সব ধরনের দরপত্রে অংশ নিতে পারছেন। কিন্তু ঠিকাদাররা ই-টেন্ডারে এখনো অভ্যস্ত না হওয়ায় তাদের কিছুটা হলেও বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। টেন্ডারবাজদের প্রকাশ্য দৌরাত্ম্য না থাকলেও কোনো কোনো এলাকায় তাদের আন্ডারগ্রাউন্ড দৌরাত্ম্য আছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সূক্ষ্মভাবে টেন্ডারবাজি হচ্ছে। বুঝা যাবে না। কোনো কাজে কে কে টেন্ডার দাখিল করেছে জানার পর সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে টেন্ডারে ভুল তথ্য দিতে চাপ প্রয়োগ করা হয় যাতে যাচাই বাছাইকালে ওই টেন্ডার বাতিল হয়। কয়েকজন ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নিজ এলাকার বাইরের ঠিকাদার এসে কাজ তোলা কঠিন। নির্মাণ সামগ্রী কাজের সাইটে নেওয়ার পর চাঁদাবাজরা টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে কাজ ভেঙে দেয়। নির্মাণ শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখানো হয়। গত বছর সিন্ডিকেটের বাইরে টেন্ডার দাখিল করায় একজন মুক্তিযোদ্ধা ঠিকাদারকে পিটিয়ে হাত পা ভেঙে দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল।’

ইত্তেফাকের খুলনা অফিস জানায়, খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি), গণপূর্ত অধিদপ্তর (পিডব্লিউডি), স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় (এলজিইডি), শিক্ষা অধিদপ্তর (ফ্যাসিলিটিজ), সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) ও পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ (পাউবো) বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে ই-টেন্ডারের মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করা শুরু হয়েছে। এতে দরপত্রের সিডিউল বিক্রি ও জমাদানের সময় প্রভাবশালী ঠিকাদার ও রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের টেন্ডারবাজি বন্ধ হয়ে গেছে। তবে ঠিকাদারী কাজের অভিজ্ঞতা সার্টিফিকেট (সিমিলার ওয়ার্ক) ও আর্থিক সচ্ছলতা সনদপত্রসহ (ব্যাংক লিকুইডিটি) নির্বাহী প্রকৌশলীদের নানান শর্ত জুড়ে দেওয়ার কারণে অধিকাংশ সাধারণ ঠিকাদার ই-টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। আর এর সুযোগ নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য ঠিকাদাররা। তাছাড়া প্রায় সময় সাইবার ক্যাফেতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়ায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনেক ঠিকাদার দরপত্রে অংশ নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

কেসিসি’র ঠিকাদার শেখ আরিফ হোসেন আরো জানান, সম্প্রতি কেসিসিতে দেড় কোটি টাকার একটি দরপত্র আহ্বান করা হয়। ই-টেন্ডারের মাধ্যমে ১২টি সিডিউল বিক্রি হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আটটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিতে পারলেও বাকি চারটি প্রতিষ্ঠান সাইবার ক্যাফেতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়ায় অংশ নিতে পারেনি। ই-টেন্ডারে এ ধরনের ঘটনা প্রায়শই ঘটছে। এতে ঠিকাদাররা নানা বিড়ম্বনাসহ দরপত্রে অংশগ্রহণের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন।

সূত্র জানায়, কেসিসিতে মূলত এক লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকার কাজ বেশি হয়ে থাকে। আগে একজন সাধারণ ঠিকাদার লাখপ্রতি একশ টাকা দিয়ে দরপত্রের সিডিউল কিনতেন। বর্তমানে সেই সিউিউল তাদের এক হাজার টাকা করে কিনতে হচ্ছে। এতে সাধারণ ঠিকাদাররা দরপত্রের সিডিউল কেনার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন। অপরদিকে প্রভাবশালী ঠিকাদাররা এক হাজার টাকা দিয়ে সেই সিডিউল কিনছেন। বর্তমানে কেসিসিতে প্রায় ১৪শ ঠিকাদার রয়েছেন। এরমধ্যে মাত্র ১০/১২ জন ঠিকাদার কাজ করতে পারছেন।

কেসিসি ঠিকাদার কল্যাণ সমিতির সভাপতি শেখ মনি খোকন বলেন, ই-টেন্ডার সম্পর্কে সাধারণ ঠিকাদারদের বাস্তবসম্মত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে কেসিসির ৮০ ভাগ ঠিকাদার ই-টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। এ কারণে আগামী এক বছরের জন্য ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ই-টেন্ডার না দেওয়ার জন্য ঠিকাদারদের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে গত ২৯ জানুয়ারি কেসিসি ঠিকাদার কল্যাণ সমিতি মেয়রের কাছে লিখিতভাবে আবেদন করেছে।

কেসিসি’র নির্বাহী প্রকৌশলী-৩ মশিউজ্জামান খান বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, গত ১ জানুয়ারি থেকে সব ধরনের দরপত্র ই-টেন্ডারের মাধ্যমে আহ্বান করতে। আমরা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ) এবং সরকারি ক্রয় বিধিমালা অনুযায়ী যে শর্ত দেওয়া আছে সে শর্ত অনুযায়ীই ই-টেন্ডার আহ্বান করছি। এতে নতুন কোনো শর্ত আরোপ করা হচ্ছে না। তবে অধিকাংশ ঠিকাদার এখনো ই-টেন্ডারে অভ্যস্ত হননি। সে কারণে ই-টেন্ডারে অংশগ্রহণ কম হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি কেসিসি ঠিকাদার কল্যাণ সমিতি ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কাজের দরপত্র ই-টেন্ডারের পরিবর্তে আগের নিয়মে রাখার জন্য একটি আবেদন করেছে। আমরা তাদের আবেদনটি বিবেচনার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করব।’ গণপূর্ত বিভাগের ঠিকাদার মামুন হোসেন বলেন, অনলাইনে সিডিউল কেনা ও জমাদান একটি ভালো দিক। এতে তালিকাভুক্ত সকল ঠিকাদার দরপত্রে অংশ নিতে পারেন। কিন্তু লটারির দীর্ঘসূত্রতার কারণে পরবর্তী দরপত্র কার্যক্রমে সাধারণ ঠিকাদারদের অংশ নিতে বেগ পেতে হচ্ছে।

এ ব্যাপারে খুলনা গণপূর্ত বিভাগ-১ (পিডব্লিউডি)-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাকির হোসেন বলেন, বর্তমানে ঠিকাদাররা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়েই ঘরে বসে অনলাইনের মাধ্যমে দরপত্রে অংশ নিতে পারছেন। এতে টেন্ডারবাজির কোনো সমস্যা নেই। ফলে ই-টেন্ডারের সুফল পাচ্ছেন ঠিকাদাররা। নির্বাহী প্রকৌশলীরাও রাজনৈতিক প্রভাব ও টেন্ডারবাজি থেকে মুক্ত থাকতে পারছেন।

ইত্তেফাকের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি বিমল সাহা জানান, টেন্ডারবাজদের প্রকাশ্য দৌরাত্ম্য না থাকলেও কোনো কোনো এলাকায় তাদের আন্ডারগ্রাউন্ড দৌরাত্ম্য আছে। ঝিনাইদহ জেলায় সবচেয়ে বেশি অবকাঠামো উন্নয়ন হয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) মাধ্যমে। এ দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, তারা বর্তমানে শতভাগ ই-টেন্ডার চালু করেছেন। তার দাবি টেন্ডারবাজি নেই। গত অর্থ-বছরে (২০১৫-২০১৬) ই-টেন্ডারের মাধ্যমে ৪১টি টেন্ডার আহ্বান করা হয়। প্রকল্পের সংখ্যা ছিল ২শ ৩৯টি। তবে দাতা সংস্থার দেওয়া ৪টি টেন্ডার ম্যানুয়াল সিস্টেমে করা হয়। ঠিকাদারদের ৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বিল প্রদান করা হয়েছে।

চলতি অর্থবছর (২০১৬-২০১৭) ২০টি আহ্বান করা হয়েছে। প্রকল্প আছে একশ ৪০টি। টাকার পরিমাণ ৭০ কোটি। নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মালেক বলেন, ই-টেন্ডার সিস্টেম চালুর পর ঠিকাদাররা প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে কাজ পাচ্ছেন। প্রাক্কলিত মূল্যের শতকরা ১০ ভাগের বেশি বা শতকরা ১০ ভাগের কম মূল্যে দাখিলকৃত টেন্ডার গ্রহণযোগ্য হবে না। গণপুর্ত বিভাগ গত বছর ১৫টি টেন্ডার ই-টেন্ডারে ও ৪টি টেন্ডার ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে আহ্বান করে। এ বছর ১৯টি ই-টেন্ডার পদ্ধতিতে ও ৩টি ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে আহ্বান করা হয়েছে।

সহকারী প্রকৌশলী মহসিন আলি বলেন, গত বছর প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে শতকরা ২০ থেকে ২৬ ভাগ কম মূল্যে ঠিকাদাররা ইন্টারনেটে টেন্ডার দাখিল করেন। প্রতিযোগিতা হওয়ায় বোঝা যায় টেন্ডারবাজি হয়নি।

http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/first-page/2017/03/12/181752.html