১২ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ১০:০৯

ভ্যাট ফাঁকির মচ্ছব

গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় হচ্ছে ভ্যাট। কিন্তু সেই ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে কি? বিশেষ করে হোটেল-রেস্তরাঁ, মিষ্টির দোকানে ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার মচ্ছব চলছে। গোটাকয়েক প্রতিষ্ঠান ভ্যাট দিলেও বেশিরভাগ হোটেল, রেস্তরাঁ রয়ে গেছে ফাঁকির তালিকায়। সরকারের রাজস্ব কর্মকর্তারা টার্গেট পূরণের জন্য প্রতিনিয়ত দায়ের করছে মামলা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে করা হচ্ছে জরিমানাও। তবুও আদায় করা যাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত ভ্যাট। আবার অনেক সময় ভোক্তা বা ক্রেতার কাছ থেকে ভ্যাট নিয়ে জমা দেয়া হচ্ছে না সরকারি কোষাগারে-এমন অভিযোগও অহরহ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর বেশিরভাগ হোটেল, রেস্তরাঁ ভোক্তাদের কাছ থেকে হিসাবনিকাশ করে ভ্যাট আদায় করে।

ভ্যাট ফাঁকির তালিকায় অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, ধানমন্ডির মতো আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠা হোটেল-রেস্তরাঁগুলো রয়েছে প্রথম সারিতে। এগুলোর বেশির ভাগেরই ব্যবসার অনুমোদন নেই। আবাসিক এলাকার মধ্যে এসব হোটেল-রেস্তরাঁ চলছে নির্বিঘ্নে। অন্যদিকে রাজধানীর বড় বড় শপিংমলের আশেপাশে গড়ে ওঠা হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোতে ক্রেতা ও ভোক্তাদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করা হলেও সরকারি কোষাগারে তা জমা দেয়ার কোনো বালাই নেই।

এছাড়াও রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর, কাওরানবাজার, ফার্মগেট, গ্রীন রোড, পান্থপথ, নিউমার্কেট, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, খিলগাঁও, বাসাবো, মালিবাগ, রামপুরা, বনশ্রী, বাড্ডা, বসুন্ধরা, শ্যামলী, কল্যাণপুর, মতিঝিল, পুরান ঢাকা, কাকরাইল, পল্টন, বিজয়নগরসহ আরো কিছু এলাকার হোটেল-রেস্তরাঁয়ও ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে।
কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনার সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা পূর্ব বিভাগে নিবন্ধনকৃত হোটেল ৭২টি, রেস্তরাঁ ২৮৮টি। এছাড়া ঢাকা দক্ষিণে হোটেল ৬০০টি, রেস্তরাঁ ২৬১৮টি, ঢাকা উত্তরে রেস্তরাঁ ৭৯২টি, হোটেল ২৩০টি, ঢাকা পশ্চিমে হোটেল ৯৮টি, রেস্তরাঁ ৪৮৯টি (মোহাম্মদপুর বিভাগ) এবং নিবন্ধনের বাইরে ছোট-বড় আরো হাজারখানেক হোটেল-রেস্তরাঁ আছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এনবিআরের (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) নিবন্ধনকৃত হোটেল- রেস্তরাঁর কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আর চলমান অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। এর জন্য প্রতিনিয়ত মামলা, জরিমানা করা হচ্ছে। আবার কিছু কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে অনেকেই ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে আদায় করা যাচ্ছে না বড় অঙ্কের রাজস্ব।

সরজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বড় রেস্তরাঁ ছাড়া ছোট ও মাঝারি রেস্তরাঁগুলোতে ইসিআরে (ইলেকট্রনিক ক্যাশ রিডার) বিল নেয়া হয় না। অধিকাংশ দোকানে তাদের নিজস্ব প্যাডে বিল কাটা হচ্ছে। যেখানে কোনো ভ্যাট নেয়া হয় না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বছরের কিছু নির্দিষ্ট সময়ে তাদের বিক্রিতে মন্দাভাব থাকে। এছাড়া, রাজনৈতিক হয়রানি, চাঁদাবাজিসহ নানা সমস্যার মধ্যে তাদের ব্যবসা করতে হয়। পুলিশকে খুশি করা, স্থানীয় প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা, কর্মচারীকে মাসিক হারে টাকা দেয়া, স্থানীয় মাস্তান, দলীয় নেতাকর্মী, রাজস্ব কর্মকর্তা, এমনকি ক্রেতার গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিতে হয়। আর দোকানে আসা ক্রেতারা সবসময় ভ্যাট দিতে রাজিও হন না। আবার যেসব প্রতিষ্ঠানে ভ্যাট নেয়া হয় তারা জানান, ব্যবসায় বিনিয়োগের সকল খরচ মিটিয়ে ভ্যাটের পুরো টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয় না। রাজধানীর বেশক’জন হোটেল, রেস্তরাঁ মালিক জানান, যদি হয়রানি, চাঁদাবাজি বন্ধ করা যায় তবে ভ্যাটের পুরো টাকাই সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া সম্ভব।

মিরপুর-১১ নম্বরের ‘এক্সপ্রেস ক্যাফে’ নামে একটি অত্যাধুনিক চাইনিজ রেস্তরাঁ। কিন্তু এই রেস্তরাঁয় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো ইসিআর ব্যবহার করা হয় না। প্রতিষ্ঠানের মালিক খায়রুল কবির জানান, আরো কিছুদিন সময় লাগবে। তবে এখন আমরা এনবিআরের সঙ্গে একটা প্যাকেজ সিস্টেমে আছি। মাসে ৫ হাজার ১০ হাজার করে টাকা দিয়ে দেই। হিসাবনিকাশ কিভাবে করেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা আমাদের খাতায় সব কিছুর হিসাব রাখি। এই রেস্তরাঁয় আল-আমিন নামের এক ক্রেতার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, আমার কাছে কোনো ভ্যাট রাখা হয় নি। ধানমন্ডির আল বাইক রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার শহীদ হোসেন বলেন, আমরা আমাদের খাবারের সঙ্গে ভ্যাট যোগ করে দিয়েছি। তাই ক্রেতার কাছ থেকে আর বাড়তি কোনো ভ্যাট নিতে হয় না। অনেক ক্রেতা আছে যারা ভ্যাট দিতে চায় না। তাই আমরা আগে থেকেই খাবারের সঙ্গে ভ্যাট যোগ করে দেই। পরে ভ্যাটের টাকা আমরা এনবিআরের কাছে জমা দিয়ে দেই। ক্রেতার কাছ থেকে ভ্যাট নিয়ে ফাঁকি দেন কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা ক্রেতার কাছ থেকে যেমন ভ্যাট নেই হিসাবনিকাশ করে আবার তা জমা দিয়ে দেই।

ধানমন্ডির টেক আউট রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার মো. আব্বাস উদ্দিন জানান, আমরা ক্রেতার কাছ থেকে ভ্যাট নেই। কিন্তু এই টাকা কোথায় কি করা হয় তা আমরা জানি না। সেটা আমাদের দোকানের মালিকই জানে। মালিকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন মালিক এখন দেশের বাইরে আছেন। ফিরতে অনেক দেরি হবে। একই রেস্টুরেন্টে এক ক্রেতা ইসলামিক ইউনিভার্সিটির ফাহিম শাহরিয়ার বলেন, আমরা তো ভ্যাট দিয়ে খাবার খাই। আগে অনেক রেস্টুরেন্টে ভ্যাট দেয়া লাগতো না। এখন প্রায় সব ভালো রেস্টুরেন্টে আমাদের কাছ থেকে ভ্যাট নেয়। ধানমন্ডির রানা কাবাব অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ক্যাশিয়ার কাজী নজরুল ইসলাম ভ্যাট সম্পর্কে কিছুই বলতে পারছেন না। ইসিআর ব্যবহার করেন কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলেও তিনি কিছু জানেন না বলে জানান।

২০০৯ সালের ১লা জানুয়ারি সরকার ১১টি ব্যবসা ও সেবার ক্ষেত্রে ইসিআর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে। এগুলোর মধ্যে হোটেল, রেস্তরাঁ, মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে ইসিআর ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা আছে। ভ্যাট আইনে হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোর ক্ষেত্রে ইসিআর মেশিন বাধ্যতামূলক করার পরেও তা মানা হচ্ছে না। ক্রেতাদের ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার (ইসিআর) চালান দেয়া হলেও মেশিন ফিসক্যাল করা থাকে না। লোক দেখানোর জন্য ইসিআর মেশিন রাখা হয়। আবার বেশির ভাগ হোটেল-রেস্তরাঁয় সাদা কাগজে, নিজস্ব প্যাডে খাবারের দাম উল্লেখ পূর্বক বিল দেয়া হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান ক্রেতাদের আস্থায় নিতে কম্পিউটারের বিলের কপিতে ভুয়া বিআইএন ব্যবহার করছেন। এক্ষেত্রে ভ্যাটের পুরো অর্থ নিজের পকেটে ঢুকানো হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলে দাখিলপত্রে শীতাতপহীন হিসেবে নিবন্ধিত। এর ফলে গ্রাহকের কাছ থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দিচ্ছে সাড়ে ৭ শতাংশ। এসব কারসাজির ফলে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত অঙ্কের ভ্যাট আদায় করতে পারছে না সরকার।

কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনারেট ঢাকা দক্ষিণের কমিশনার কাজী মুস্তাফিজুর রহমান মানবজমিনকে জানান, হোটেল-রেস্তরাঁর ভ্যাট দুইটি ক্যাটাগরিতে নেয়া হয়। নিম্নমানের হোটেল-রেস্তরাঁ থেকে সাড়ে সাত শতাংশ (নন এসি) এবং ভালো রেস্তরাঁ (এসি) থেকে পনের শতাংশ ভ্যাট নেয়া হয়। বিক্রি সমান না হওয়ার কারণে অনেক সময় টার্গেট অনুযায়ী ভ্যাট আদায় করা সম্ভব হয় না। তবে বকেয়া ভ্যাট আদায় এবং যারা ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তিনি বলেন, আমরা প্রতিদিনই ৪-৫টা করে মামলা করছি। ভ্যাটের টাকা কোথায় যায় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভ্যাটের পুরো টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয় না। এর ভাগ বিভিন্নভাবে বণ্টন হয়। কারণ ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করতে গেলে নানান প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হয়। ভ্যাট না দেয়ার প্রধান কারণ ঘাটে ঘাটে তাদের টাকা দিতে হয়। ভ্যাটের টাকা পুলিশ, স্থানীয় মাস্তান, দলীয় নেতাকর্মী, স্থানীয় প্রশাসনের পকেটে যায়। এমনকি কিছু অসাধু রাজস্ব কর্মকর্তাদের পকেটেও যায়।

কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনারেট ঢাকা পূর্বের কমিশনার ড. একেএম নুরুজ্জামান বলেন, ঢাকা পূর্ব বিভাগে হোটেল-রেস্তরাঁর সংখ্যা খুবই কম। যে কয়টি আছে তারা মোটামুটি ভ্যাট দিচ্ছে। যাদের বকেয়ার পরিমাণ বেশি তাদের ক্ষেত্রে আমরা মামলা করে টাকা আদায় করছি।

কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট ঢাকা উত্তরের কমিশনার মাসুদ সাদিক হোটেল-রেস্তরাঁয় ভ্যাট ফাঁকির বিষয়ে বলেন, বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাট দিচ্ছে। ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এখনো ভ্যাট দেয়ার মানসিকতা তৈরি হয়নি। আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান চালিয়ে মামলা করছি। ইসিআর ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সবাই করে না। শুধু বড় প্রতিষ্ঠান ইসিআর ব্যবহার করে। সবাইকে ভ্যাটের আওতায় আনতে আরো সময় লাগবে বলে তিনি মনে করেন।

কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট ঢাকা পশ্চিমের কমিশনার ড. মো. সহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা নিয়মিত মনিটরিং করছি। মামলাও করছি। এর পরেও অনেকে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। তবে আমাদের জনবল কম থাকার কারণে সঠিকভাবে কাজ করতে পারছি না। ইসিআর ব্যবহার বাধ্যতামূলক হলেও অনেকেই তা ব্যবহার করছে না। তাই আমাদের এই কাজে ভোক্তাদের সহযোগিতা করতে হবে। খাবার খেয়ে চালান চাইলে ব্যবসায়ীরা আরো সচেতন হবে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=57099