১২ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ৯:১৯

চলতে ফিরতে দেখা

বাংলাদেশ কি ভারতের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করবে?

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে ইন্ডিয়ার মিডিয়ায় বিরাট শোরগোল পড়ে গেছে। তারা বলতে চাইছেন, সম্ভবত ৭-৮ এপ্রিল শেখ হাসিনার এ সফর অনুষ্ঠিত হবে। আর এ সফরকালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ‘বিরাট প্রতিরক্ষা চুক্তি’ সম্পাদিত হবে। এ রকম চুক্তির কথা কয়েক মাস আগেও খুব একটা শোনা যায়নি। গোপনে কী হচ্ছিল, সেটা অবশ্য আমরা কেউই জানি না। কাউকে জানানোর কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। কিন্তু বাংলাদেশ চীন থেকে দু’টি সাবমেরিন কেনার পর ভারত সরকার যেন একেবারে নড়েচড়ে বসেছে। বাংলাদেশের সমরাস্ত্রভাণ্ডার প্রধানত চীনভিত্তিক। এটা শুধু নতুন নয়, স্বাধীনতার কিছুকাল পর থেকেই এ ব্যবস্থা চালু আছে। সুতরাং বাংলাদেশের চীন থেকে সাবমেরিন কেনার বিষয়টির মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু ভারতে এ নিয়ে তুমুল সমালোচনা চলছে। তাদের প্রশ্ন, কেন সাবমেরিন কিনল বাংলাদেশ? আর ঢাকার বিশেষজ্ঞ মহলের এখন আলোচ্য বিষয়, কেন ভারতের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করতে যাবে বাংলাদেশ? ইতোমধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে সমালোচনা জোরদার হয়ে উঠেছে। বিএনপি বলেছে, ভারতের কথামতো, সম্ভাব্য এ সামরিক চুক্তি হবে বিপর্যয়কর এবং এর ফলে দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌম ক্ষুণœ হবে। তাদের আশঙ্কা, এই চুক্তি হলে সিকিম দখলের আগে ভারতের সঙ্গে ওই দেশের যে সম্পর্ক ছিল এবং পরবর্তীকালে ভুটান যেভাবে ভারতের অনুগামী দেশে পরিণত হয়েছে, বাংলাদেশের পরিণতি তেমনই হতে বাধ্য। জামায়াতও একই ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করেছে যে, সম্ভাব্য এ চুক্তি কেন, কার স্বার্থে করা হচ্ছে। অন্য কিছু রাজনৈতিক দলও এই উদ্যোগের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে।

তাদের বক্তব্য হলো, এ ধরনের চুক্তি দেশের জনগণ বা প্রতিরক্ষাবাহিনী, কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। দেশের দায়িত্বশীল সংবাদপত্রগুলো এই সম্ভাব্য চুক্তির কঠোর সমালোচনা শুরু করেছে। সাধারণত কোনো একটি দেশ যখন যুদ্ধাবস্থায় থাকে, যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তখন অন্য কোনো দেশের সঙ্গে সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ১৯৭১-এ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ লাগার আগে আগে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে এ রকম একটি সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল। আমাদের দেশে এখন সে রকম কোনো পরিস্থিতি নেই। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেন এ ধরনের চুক্তি করতে যাবে? রাজনৈতিক মহল ও মিডিয়ায় এ নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও ভারতের প্রস্তাবিত এ রকম চুক্তিতে সরকার আদৌ স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে কি না এ বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত কিছুই বলা হয়নি।

বেশ কয়েক দফা সময় পরিবর্তনের পর শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত ভারত সফরে রাজি হয়েছেন। পত্রপত্রিকার রিপোর্টে যেটুকু দেখা যায়, তা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভারতের প্রস্তাবিত এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করার ব্যাপারে সরকারের অনীহা রয়েছে। এর সঙ্গত কারণও আছে। ভারতীয় সংবাদপত্র কুয়োরা লিখেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা চুক্তি এমন হওয়া উচিত যাতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে অবাধে ভারতীয় সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম পরিবহন করা যায়। তার ফলে ওই সাত রাজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ওই সাতটি রাজ্যে স্বাধীনতার জন্য প্রায় ৫০ বছর ধরে সেখানকার বিভিন্ন স্বাধীনতাকামী গ্রুপ ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের অভিযোগ হচ্ছে, এই সব গ্রুপ বিদেশী শক্তির মদদে এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, যা ভারত সরকারের জন্য একটি অব্যাহত হুমকি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ ধরনের সামরিক চুক্তি হলে খুব সঙ্গতভাবেই ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে তার সেনাবাহিনী ও সামরিক সাজসরঞ্জাম ওই রাজ্যগুলোতে নিয়ে যেতে পারবে। এতে খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিঘিœত হবে। কেননা ওই সাত রাজ্যের স্বাধীনতাকামীরা যখন দেখতে পাবেন যে, তাদের ওপর হামলা চালানোর জন্য বাংলাদেশ ভারতকে এই ধরনের সামরিক সুবিধা দিচ্ছে, তখন তারা বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে এই সেনা ও সরঞ্জাম বহরে হামলা চালানোর চেষ্টা চালাতে পারে। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, এই চুক্তি সম্পাদনের জন্য ভারত শেখ হাসিনা সরকারের সামনে নানা মুলা ঝুলিয়ে দেবে এবং চাপ প্রয়োগের কৌশল অবলম্বন করবে।

এটা শুধু অনুমানভিত্তিক নয়। ভারত এ ধরনের চুক্তি সম্পাদনের জন্য তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে নানা ধরনের চাপ প্রয়োগের কৌশল আগেও গ্রহণ করেছে। তাদের এই চাপ প্রয়োগের কৌশল নেপাল ও ভুটানে সফল হয়েছে। এটা তো মাত্র অল্প কিছু দিন আগের ঘটনা যে, ভারতীয় ষড়যন্ত্রে নেপালে কে পি শর্মা ওলি সরকারের পতন ঘটেছে। ভারত নেপালের সংবিধান সংশোধনের জন্য ভারতীয় বংশো™ভূত মাধেসিদের দিয়ে আন্দোলন শুরু করে এবং নেপালে সব ধরনের পণ্য সরবরাহ প্রায় চার মাস ধরে বন্ধ করে রাখে। ফলে নেপালের মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হন। তখন প্রধানমন্ত্রী ওলি চীনমুখী নীতি গ্রহণ করেন। এরই পরিণতিতে ভারত নেপালে ওলি সরকারের পতন ঘটায়। একই ঘটনা ঘটেছিল ভুটানেও। ভুটানের থিনলে সরকার চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলে ভারত সে সরকারেরও পতন ঘটায়। আর ভারত গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার নির্বাচনে এমনই প্রভাব বিস্তার করে যে, সেখানকার লৌহমানব খ্যাত রাজাপাকশের সরকারের পতন ঘটে যায়। রাজাপাকশেও চীনমুখী নীতির জন্য পরিচিত।

ভারত তিব্বতের ধর্মগুরু দালাই লামাকে প্রবাসী সরকারপ্রধান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এবং তাকে আশ্রয় দিয়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত করে রেখেছে। এটা চীনের জন্য দীর্ঘকালীন উদ্বেগের বিষয়। ভারত এটা ভালো করেই জানে এবং সে কারণেই জোরেশোরে দালাই লামাকে নিয়ে প্রচারণা চালায়। তা ছাড়া চীনের সঙ্গে ভারতের রয়েছে দীর্ঘকালীন সীমান্ত বিরোধ। যদি এই বিরোধ আরো বিস্তার লাভ করে, তাহলে বাংলাদেশের সাথে সম্পাদিত সম্ভাব্য সামরিক চুক্তির মাধ্যমে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো রক্ষার জন্য বাংলাদেশের ভূমি যথেচ্ছ ব্যবহার করবে, যা চীনের জন্য বিরক্তির কারণ হবে।

ভারতীয় পত্রিকা কুয়োরা আরো বলেছে যে, বাংলাদেশের সমতল ভূমির ওপর দিয়ে ওই চুক্তির মাধ্যমে যথেচ্ছ পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থাও রাখতে হবে। কারণ, সঙ্কীর্ণ শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে যেতে এক দিনের বেশি সময় লাগে আর সে পথ অতি দুর্গম। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে এই চুক্তি হলে অতি দ্রুত এই পথ অতিক্রম করা যাবে। ভারতীয় মিডিয়া রিপোর্ট করেছে, দিল্লি ঢাকার সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদি প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে চায়। কিন্তু ঢাকা এখনো এত দীর্ঘকালীন চুক্তির ব্যাপারে আগ্রহী নয়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করতে পারে। এতে কোনো বাঁধাধরা সময় থাকবে না এবং তা হবে কম আনুষ্ঠানিক। ওয়াকিবহাল সূত্র বলেছে, ভারত আরো একটি কারণে এই প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে চায়। আর সেই কারণটি হলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ চীন। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর অফিসারদের চীন ধারাবাহিকভাবে প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, চীন থেকে বাংলাদেশের সাবমেরিন ক্রয়ের ফলে ভারতের উদ্বেগ। সেখানকার সমরকৌশলরিদেরা প্রশ্ন করছেন যে, বাংলাদেশের তিন দিকেই ঘিরে রয়েছে ভারত। তা ছাড়া মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধও আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে মীমাংসা হয়ে গেছে। তারপরও বাংলাদেশ কেন সাবমেরিন কিনবে? তা-ও আবার চীন থেকে!

ভারতের আশঙ্কা, চীন দিল্লির প্রতিবেশীদের প্রভাবিত করে ভারতকে একঘরে করার চেষ্টা করছে। গত বছরের শেষে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর বাংলাদেশ সফরে ভারতের এ ধারণা আরো জোরালো হয়। বাংলাদেশী কূটনীতিকেরা বলছেন, ভারতের সমরাস্ত্র মানসম্মত নয়। তার সাম্প্রতিক প্রমাণ মিয়ানমার ও নেপাল। সেখানে ওগুলো কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। বাংলাদেশ, ভারতের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সামরিক চুক্তিতে যেতে চায় না, এটিও তার একটি কারণ। অপর দিকে চীনা সমরাস্ত্র উন্নতমানের, সস্তা এবং সহজে বহন ও ব্যবহারযোগ্য। যেহেতু বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের সঙ্গে সামরিক চুক্তির ব্যাপারে প্রবল বিরোধিতা রয়েছে, সে জন্য শেখ হাসিনা সম্ভবত সেনাবাহিনীকে এমন একটা অবস্থার দিকে ঠেলে দেবেন না। বরং তিনি সংশ্লিষ্টদের মতামতকে মূল্য দেবেন। আওয়ামী লীগ সরকারগুলো বরাবরই ভারত-বন্ধু। শেখ হাসিনা সরকারও এর ব্যতিক্রম নয়। তিনি ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সে দেশে ফেরত পাঠিয়েছেন। উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে যাওয়ার জন্য করিডোর দিয়েছেন সে দেশকে। ভারত যা কিছু চায়, সব কিছু দিয়েছেন। এবার আসলে ভারতেরই বাংলাদেশকে দেয়ার পালা।

শেখ হাসিনার সম্ভাব্য ভারত সফরকালে এত কিছুর পর তিনি নিশ্চয়ই বাংলাদেশের অনুকূল কিছু ভারতের কাছে চাইবেন। এর মধ্যে থাকবে তিস্তা ও অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা, সীমান্তে বাংলাদেশীদের নির্বিচার হত্যা বন্ধ করা প্রভৃতি বিষয়। তিনি এক দিকে যেমন সেনাবাহিনীকে হতাশ করতে চাইবেন না, অপর দিকে তেমনি নয়াদিল্লিকেও অসন্তুষ্ট করতে চাইবেন না। কারণ ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে আরেকটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সে নির্বাচনে ভারতের সাহায্য তার দরকার। ফলে তার পক্ষে পথ নির্ধারণ খুব সহজ কাজ নয়।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/202765