১১ মার্চ ২০১৭, শনিবার, ৭:৫০

নগরজুড়ে ভোগান্তি

রাজধানীতে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই চলছে উন্নয়ন কাজ। বিভিন্ন ধরনের নির্মাণ কাজে নিরাপত্তা ও সাধারণ পথচারীদের দুর্ভোগ লাঘবে কোনো উদ্যোগই দৃশ্যমান হয় না। এ কারণে রাজধানীর প্রায় অংশেই সাধারণ নাগরিকদের ভোগান্তি এখন নিত্যদিনের চিত্র। নগরবিদরা বলছেন, নগরীর মধ্যে কোনো উন্নয়ন কাজ করতে হলে তার নির্ধারিত নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এসব কাজের দায়িত্বপ্রাপ্তরা কোনো নিয়মনীতি না মেনে তাদের মনগড়াভাবে কাজ করে থাকে।

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, নগরীর ভেতরে কোনো উন্নয়ন কাজ করতে হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই কিছু নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে। বেঁধে দেয়া সময়ের ভেতর কাজ শেষ করতে হবে। জনগণের দুর্ভোগ যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নির্মাণাধীন এলাকায় সাইনবোর্ড লাগাতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ফিতা টানিয়ে রাখতে হবে। রাতে কাজ করতে হলে ওয়ার্নিং সাইন, বাতি জ্বালাতে হবে। যাতায়াতের বিঘ্ন যাতে না হয় সেজন্য রাস্তার উপর অতিরিক্ত নির্মাণ সামগ্রী ফেলে রাখা যাবে না। কাজের প্রয়োজন অনুযায়ী সরঞ্জামাদি আনতে হবে। যখন তখন রাস্তা বন্ধ করা যাবে না।

বিশেষ করে কর্মদিবসে। প্রয়োজন হলে কিছু জায়গায় যানবাহন চলাচলের জন্য ডাইভারশন তৈরি করতে হবে। পথচারীদের দুর্ঘটনা এড়াতে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ধুলাবালুর জন্য নিয়মিত পানি ছিটাতে হবে। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, নগরীর ভেতর কাজের জন্য আমরা একটা নির্দিষ্ট সময় ও কাজ করার ক্ষেত্রে কিছু নিয়মনীতি দিয়ে দেই। শহরের ভেতর কাজ করতে হলে একটু সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। মানুষের চলাচলে যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ যারা কাজ করবে তারাই ব্যবস্থা নিবে। তবে নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে যত সময় নিয়ে কাজ করা যাবে কাজের স্থায়িত্ব ততই ভালো হবে। কিন্তু ব্যস্ততম শহরে এতো বেশি সময় নিয়ে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। সরজমিন মিরপুর, কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়া গিয়ে দেখা যায়, এখানো মেট্রোরেলের মূল কাজ শুরু হয়নি। কিন্তু প্রধান সড়কের দুই পাশে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে রাস্তা অনেক সরু হয়ে গেছে। রাস্তা খুঁড়ে সেখানে বিভিন্ন সার্ভিস লাইন বসানো হচ্ছে। এ কাজের কারণে ড্রেন ও ফুটপাথের কোনো অস্তিত্ব নেই। রাস্তা সরু হয়ে যাওয়ার কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট লেগে থাকে পৃষ্ঠা ৫ কলাম ৪।

পায়ে হাঁটা পথচারীদের হাঁটার কোনো উপায় নাই। ধুলাবালুতে ধূসর হয়ে আছে এলাকা। স্থানীয় ব্যবসায়ী, পথচারীরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছেন ধুলাবালুর কারণে। বিকল্প বাসের এক যাত্রী অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, এ ধরনের উন্নয়ন কাজের কোনো দরকার নাই। আমি এই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে থাকি। প্রতিদিন সকালে আমাকে এই রাস্তা দিয়ে অফিসে যেতে হয়। কিন্তু কিছুদিন ধরে মেট্রোরেলের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই এই রাস্তার মধ্যে চরম ভোগান্তি শুরু হয়েছে। একদিকে যেমন যানজটের কারণে সময় নষ্ট হয় ওপরদিকে ধুলাবালুর কারণে সর্দি কাশি লেগেই আছে। জাহানারা বেগম নামের এক পথচারী বলেন, আমার বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যেতে এখন অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। মাস্ক ছাড়া রাস্তায় বের হওয়া যায় না। রাস্তার এপার থেকে ওপারে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। জানি না এই দুর্ভোগ কবে শেষ হবে। ওই রুটে বাসের চালক রবিউল ইসলাম জানান, আগে কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া এলাকায় কোনো যানজট থাকতো না। কিন্তু এখন মেট্রোরেলের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে অনেক সময় নষ্ট হয় এখানে। রাস্তার মধ্যে নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখার কারণে রাস্তা অনেক সরু হয়ে গেছে। সিএনজিচালক আশরাফ বলেন, মেট্রোরেলের কাজের জন্য রাস্তা ছোট হয়ে গেছে। মিরপুরের ট্রিপ এখন আমরা খুব কম নেই। আর নিলেও সময় নষ্ট হওয়ার জন্য একটু বেশি ভাড়া নেই। নামপ্রকাশ না করে মেট্রোরেল প্রকল্পের এক শ্রমিক বলেন, এখনো মূল কাজ শুরু হয়নি। সতর্কতা ছাড়া মূল কাজ শুরু হলে ভোগান্তি আরো বাড়বে।

এদিকে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের জন্য এই এলাকায় চলাচলরত মানুষকেও অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। যেখানে সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি। রাস্তায় খানাখন্দ, পানি, কাদা, জমে থাকে সবসময়। নির্মাণ সামগ্রী ভিম, এঙ্গেল, রড, সাটারিং বোর্ডসহ নানান উপকরণ রাস্তার উপর ফেলে রাখার কারণে রাস্তা সরু হয়ে গেছে। দুই একটি জায়গা ছাড়া কোথাও নিরাপত্তা চিহ্ন বা নির্মাণাধীন এলাকায় ফিতা দিয়ে আটকানো হচ্ছে না। মূল সড়কের উপরে ঢালাই হচ্ছে। নিচে পথচারী ও যানবাহন চলাচল করছে। বেহালদশা আর ডাইভারশন না থাকার কারণে কিছু রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। আশপাশের অনেকেই এখন আর এই এলাকা দিয়ে চলাচল করেন না। আসসামি কসমেটিকসের মো. রাজিব খান বলেন, মগবাজার-মৌচাক এলাকার নাম শুনলে এখন মানুষ ভয় পায়। মানুষ চলাচল না করার কারণে এখানকার সবকটি মার্কেটে বিক্রি নাই বললে চলে। আনারকলি মার্কেট, মৌচাক মার্কেট, ফরচুন মার্কেট, হোসাফ টাওয়ার, কর্নফুলি গার্ডেনসহ সবকটি মার্কেটে এখন ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে।

স্থানীয় আমির হোসেন নামের এক চাকরিজীবী বলেন, উন্নয়ন কাজ হবে। সেটা জনগণের ভালোর জন্যই। কিন্তু এই ফ্লাইওভারের কাজটা এই এলাকার ছাত্র-ছাত্রী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য একটা অভিশাপ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমি বাহিরে দেশেও দেখেছি তারা একটা নিয়মনীতির মধ্যে এসব কাজ করে থাকে। মানুষের যেন কোনো সমস্যা না হয়। জনগণের চলাচলের সব ধরনের সুব্যবস্থা করে দিতে হবে। সিদ্ধেশ্বরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি রামপুরা থেকে কলেজে আসি। আগে ১৫ মিনিটে চলে আসতে পারতাম। কিন্তু ফ্লাইওভারের কাজের খারাপ অবস্থার জন্য এখন আসতে খুব কষ্ট হয়।

মৌচাক এলাকার আরেক ব্যবসায়ী শিপন মিয়া বলেন, দফায় দফায় সময় বাড়ানোর পরও নির্মাণ কাজ শেষ হচ্ছে না। এলোমেলো কাজ করার জন্য প্রতিনিয়তই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। নগরবাসীর উন্নয়নের জন্য যে কাজ করা হচ্ছে সেই কাজ এখন চরম ভোগান্তির হয়ে গেছে। তিনি বলেন, কিছু কিছু রাস্তার এমন অবস্থা মানুষ দেখলে মনে হয় হাওরের মতো। হাঁটু সমান পানি আর কাদা জমে আছে। আবার মৌচাক থেকে মালিবাগ রেলগেট পর্যন্ত রাস্তায় ধান চাষ করা যাবে। এবিষয়ে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা গ্রুপের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হাতেম আলী বলেন, আমরা নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে না পারার কারণে ভোগান্তি একটু বেশি হচ্ছে। আশাকরি আমরা ডিসেম্বরের ভেতরে কাজ শেষ করে হস্তান্তর করতে পারবো। উপরের কাজ চলার কারণে নির্মাণ সামগ্রী নিচে রাখা হয়েছে। কাজ শেষ হলেই তা সরিয়ে নেয়া হবে। তবে আমরা সবসময়ই নিয়মনীতি মেনে কাজ করার চেষ্টা করছি। অখেয়ালবসত কিছু হয়ে থাকলে সেটা দুঃখজনক। এজন্য রাস্তায় চলাচলকারীদের আরো সচেতন হতে হবে।

রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিদেশে এই ধরনের উন্নয়ন কাজের জন্য আলাদা পরিকল্পনা করা হয়। জনগণের দুর্ভোগ এড়ানোর জন্য খুব কম সময়ে কাজ শেষ করা হয়। যানবাহন ও মানুষ চলাচলের জন্য সুন্দর ব্যবস্থা করা হয়। এবং যে সময় পথচারীদের চলাচল কম থাকে সেসময় কাজ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই নিয়মনীতিগুলো মেনে চলা হয় না। ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেলের কাজ শেষ হলে নগর জীবনে অনেক সুফল বয়ে আনবে। তবে কাজ খুব তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, নির্মাণ কাজে নিয়ম না মানার কারণে মানুষের ভোগান্তি হয়। তবে নগরে এ ধরনের উন্নয়ন কাজ চলার সময় নাগরিকদের একটু সহনশীল হতে হবে। কারণ উন্নয়ন কাজ শেষ হলে তা নাগরিক সুবিধাই বাড়াবে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=56909&cat=6