১০ মার্চ ২০১৭, শুক্রবার, ১১:৫৪

নাব্যতা সংকটে ২৮ রুটে নৌযান চলাচল বন্ধ

দক্ষিণাঞ্চলে ১৪শ’ কিমি নৌপথ বেহাল

দক্ষিণাঞ্চলের ৩ হাজার কিলোমিটার নৌপথ মরণফাঁদে রূপ নিয়েছে। ১৪শ’ কিলোমিটার নৌপথ নাব্যতা হারিয়ে এখন নৌযান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নাব্যতা সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে এ অঞ্চলের ২৮টি নৌ-রুট। বর্তমানে নাব্যতা সংকটের কারণে মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুট। নেই বয়া ও বিকন বাতি। সরু চ্যানেলগুলো দিয়ে যাত্রীবাহী ডাবল ডেকার নৌযান যাতায়াতে হিমশিম খাচ্ছে। একই চ্যানেলে বেপরোয়া গতিতে পণ্যবাহী কার্গো ও বালুবাহী বাল্কহেড ক্যারিয়ার চলার কারণেই বেশিরভাগ দুঘর্টনা ঘটছে।

দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্নস্থানে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম নৌপথ। বিভাগের ৬টি জেলা ও ৪০টি উপজেলার কয়েক কোটি মানুষকে নৌপথে যাতায়াত করতে হয়। নৌ-রুট রয়েছে ৮৮টি। এরমধ্যে শীত ও শুষ্ক মৌসুমে ২৮টি রুটে লঞ্চ চলাচল করতে পারে না। ৪৩টি রুটে ডাবল ডেকার লঞ্চ চলাচল করে। বাকি অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে চলাচল করে এমএল টাইপের একতলা লঞ্চ। বিআইডব্লিউটিএ’র হিসেবে প্রতিদিন গড়ে দেড় লক্ষাধিক লোক এসব রুটে যাতায়াত করে। প্রতি বছর শুকনো মৌসুমে ১৪শ’ কিলোমিটার নৌপথই থাকে চলাচলের অনুপযোগী। নাব্যতা সংকটের কারণে এবারো ৫টি নদীর প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকায় নৌ-চলাচল বলতে গেলে বন্ধ হয়ে গেছে। সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুট।

বিআইডব্লিউটিএ জানায়, এমএল টাইপের লঞ্চ চলাচলের জন্য ৮/৯ ফুট পানি প্রয়োজন। ডাবল ডেকার লঞ্চের জন্য প্রয়োজন ১৪/১৫ ফুট পানি। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে দক্ষিণাঞ্চলের কীর্তনখোলা, লোহালিয়া, বিষখালী, পায়রা, নিশিন্দা, ইলিশা, কালাবদর, তেঁতুলিয়া, গণেষপুরা, সন্ধ্যা, সুগন্ধা, আড়িয়াল খাঁ, ঝুনাহার, ধানসিঁড়ি ও পালরদী নদীর পানি কমে গেছে, জেগে উঠেছে চর। বরিশাল-ঢাকা রুটের ভাষানচর ও চরনাইন্দা, লালখারাবাদ, মেঘনার মিয়ারচর, ঘটকের চরসহ মেহেন্দিগঞ্জের কয়েকটি চ্যানেলের অবস্থা খুবই নাজুক। বরিশাল-ভোলা রুটের সাহেবেরহাট ও লাহারহাট পয়েন্টে নাব্যতা কমে যাওয়ায় দুধল, দাঁড়িয়াল, বাকেরগঞ্জ, চরামদ্দি, বলাইকাঠী, চন্দ্রমোহন, বুখাইনগর, মেহেন্দিগঞ্জ রুটের লঞ্চ চলাচল বন্ধ হতে চলেছে। বাউফল ও লালমোহনসহ কয়েকটি রুটে নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকা-বরিশাল রুট কিংবা বরিশাল-চট্টগ্রাম রুটে চলাচলকারী নৌযানের জন্য কোনো বিকল্প চ্যানেল নেই।

ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী ‘কীর্তনখোলা-২’ লঞ্চটি গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে বরিশাল আসার পথে ডুবোচরে আটকা পড়ে। ঐ লঞ্চের যাত্রী প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদাকে স্পিডবোট পাঠিয়ে আটকেপড়া লঞ্চ থেকে নিয়ে আসা হয়। আগেরদিন একই এলাকায় আটকা পড়ে ‘এমভি ফারহান’। ২১ ফেব্রুয়ারি যাত্রী নিয়ে বরিশাল থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে চরে আটকা পড়ে বিআইডব্লিউটিসির স্টিমার ‘পিএস মাহসুদ’। কয়েক ঘন্টা পর উদ্ধার পেলেও তার তলদেশে ব্যাপক ক্ষতি হয়। যাত্রী পরিবহনে অক্ষম হয়ে পড়ায় মাহসুদ মেরামতের জন্য ডর্কইয়ার্ডে রয়েছে।

‘কীর্তনখোলা-২’ লঞ্চের মাস্টার নূরুল ইসলাম জানান, এক দশক আগেও ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুট ছিল যাতায়াতের জন্য নিরাপদ। কিন্ত এখন খুবই বিপদজ্জনক রুট এটি। মেঘনার মিয়ার চরের নাব্যতা সংকট মোকাবেলায় গত জানুয়ারি মাসে ড্রেজিং করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজে আসছে না। নদীতে পানি না থাকায় লালখারাবাদ ও চরমোনাই’র রাজাপুর পয়েন্টে একই অবস্থা। আড়িয়াল খাঁ নদের মুখ সরু হয়ে যাওয়ায় বিপদ বেড়েছে। ‘সুন্দরবন-১০’ লঞ্চের মাস্টার মজিবর রহমান জানান, আগে দুইটি ডাবল ডেকার লঞ্চ পাশাপাশি চলাচল করতে পারতো। এখন একটি লঞ্চ চলাই মুশকিল। নদীর প্রস্থ কমেছে, সাথে গভীরতাও। ‘পারাবত-১০’ লঞ্চের মাস্টার শামীম আহমেদ জানান- লঞ্চে আকার আগের চেয়ে অনেক বড় হয়েছে, নদীর গভীরতা ও প্রস্থ বৃদ্ধির পরিবর্তে কমেছে। যে কারণে নৌযান চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

নৌযান চালকরা সকলেই রাতের অন্ধকারে পণ্যবাহী কার্গো, ট্যাংকার ও বালুবাহী বাল্কহেড চলাচলে দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে জানান। তাদের মতে- রাতে মালবাহী এসব নৌযান চলাচল বন্ধ নিশ্চিত করার পাশাপাশি ঢাকা-বরিশাল নৌরুটে দীর্ঘ খনন ছাড়া এ রুট টিকিয়ে রাখা মুশকিল। একইসাথে তারা প্রয়োজনীয় বয়া-বিকন বাতি যুক্ত করার দাবি জানান।

বিআইডব্লিউটিএ নৌ-নিরাপত্তা বিভাগের উপ-পরিচালক আজমল হুদা মিঠু জানান, প্রতিবছরই কোথাও না কোথাও ড্রেজিং করা হচ্ছে। লঞ্চ-মালিকরা নির্দিষ্ট কিছু স্থানের কথা উল্লেখ করে নদী খননের দাবি জানিয়েছেন। আমরা তা প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ করেছি। কিছু এলাকা ড্রেজিং করা হয়েছে, কিছু এলাকায় চলমান রয়েছে। তবে দীর্ঘমেয়াদী খননের বিষয়টি সরকারের নীতি নির্ধারণী ব্যাপার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিএ’র এক শীর্ষ কর্মকর্তা ‘ইত্তেফাক’কে জানান, শুধু দক্ষিণাঞ্চলের ১৪শ’ কিলোমিটার নয়, সারাদেশের ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গত ১ মার্চ বরিশাল সফরকালে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে জানান, নৌপথ পুনরুদ্ধারে সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংক থেকে আমরা তিন হাজার দু’শ’ কোটি টাকা পেয়েছি। এ টাকা দিয়ে দেশের নৌপথকে ঢেলে সাজানো হবে।

http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/last-page/2017/03/10/181273.html