১০ মার্চ ২০১৭, শুক্রবার, ১১:২৪

টিআইবির প্রতিবেদন: বিদেশে কর্মসংস্থান

দালালদের খপ্পরে বিদেশগামীরা

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে জনশক্তি পাঠানোর প্রক্রিয়াটা দালালনির্ভর। তবে তাদের দৌরাত্ম্য যে কতটা প্রকট, তা বেরিয়ে এসেছে এক গবেষণায়। এতে দেখা গেছে, ভিসা কেনাবেচা আর ধাপে ধাপে দালালদের কারণে ৩ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হচ্ছে বিদেশগামীদের।

বিষয়গুলো দেখভাল করার কথা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু উল্টো সেখানেও ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগ পেয়েছেন গবেষকেরা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত এই গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুর এবং মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশে যাওয়া বিদেশগামী পুরুষদের ৯০ শতাংশই দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার হচ্ছেন। আর ভিসা বা চাহিদাপত্র কিনতে শুধু ২০১৬ সালেই ৫ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে ‘শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়ায় সুশাসন: সমস্যা ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ২০১৬ সালের মে থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ, সাক্ষাৎকার, শ্রম অভিবাসনসংক্রান্ত আইন ও নীতিমালা পর্যালোচনা, সরকারি-বেসরকারি তথ্য ও দলিল পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়।

সরকারি হিসাবে, বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি বাড়ছে। বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন ৮০ থেকে ৮৫ লাখ প্রবাসী। ২০১৬ সালে ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। গত আট বছরের মধ্যে এই সংখ্যা সর্বোচ্চ। বিদেশে কর্মী যাওয়ার হার এখনো ঊর্ধ্বমুখী। এ বছরের প্রথম দুই মাসেই ১ লাখ ৬৬ হাজার ৪৭২ জন কর্মী বিদেশে গেছেন, যা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ। তবে কর্মী বেশি গেলেও এই খাতের দুর্নীতি, অনিয়ম বন্ধ হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, বিদেশে লোক যাওয়া বাড়লেও প্রবাসী আয় কমছেই। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ শতাংশ প্রবাসী আয় কমেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা প্রবাসী আয় এসেছে।

ধাপে ধাপে ভিসা কেনাবেচা
বিদেশে দীর্ঘদিন ধরে আছে এমন একটি চক্র নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে ভিসা কিনে উচ্চমূল্যে বাংলাদেশে বিক্রি করে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অন্তত সাতবার এই ভিসা কেনাবেচা হয়। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রথম পর্যায়ে গন্তব্য দেশে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে এমন বাংলাদেশি চক্র এই ভিসা কেনে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। সেখান থেকে কখনো বিদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি, কখনো বড় বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর হাত ধরে সেটি বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে আসে। এরপর প্রথমে ঢাকার এবং পরে গ্রামের দালালেরা সেই ভিসা বিক্রি করে। ধাপে ধাপে এই দালালদের কারণে সৌদি আরবে ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় কেনা একটা ভিসার জন্য ৫ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। ফলে সরকার সৌদি আরবে যাওয়ার খরচ ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করলেও সেই টাকায় কেউ যেতে পারেন না।

একইভাবে বাহরাইন ও ওমানে যাওয়ার জন্য আড়াই থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা, কাতারে সাড়ে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা এবং সিঙ্গাপুর যেতে ৬ থেকে ৮ লাখ টাকা লাগে।

বিএমইটি ও মন্ত্রণালয়ে ঘুষ
ভিসা কেনাবেচার পর দূতাবাসে সত্যায়ন, ছাড়পত্র, আঙুলের ছাপ দেওয়া, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পুলিশি যাচাইসহ পদে পদে ঘুষ দিতে হয়। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। গত আট বছরের মধ্যে এই সংখ্যা সর্বোচ্চ। বিদেশ যাওয়া এই কর্মীদের ছাড়পত্র দিয়েছে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)। অভিযোগ আছে, বিএমইটির বহির্গমন শাখা থেকে ছাড়পত্র দিতে ঘুষ-বাণিজ্য চলে। বিশেষ করে বাজার বন্ধ থাকার পরও গত বছর ঘুষ-বাণিজ্যের মাধ্যমে অন্তত ৪০ হাজার লোককে পেশাদার কর্মী হিসেবে মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে ২০ হাজার লোক গেছেন মালদ্বীপে।

টিআইবির প্রতিবেদনে বিএমইটিতে ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। মালয়েশিয়ায় পেশায় অদক্ষ কর্মী পাঠানোর নামে বিএমইটির কর্মকর্তারা প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিয়েছেন বলে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ ছাড়া গত বছর বিদেশে যাওয়া ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জনকে বহির্গমন ছাড়পত্রের অনুমোদন দিতে ১০০ থেকে ২০০ টাকার ঘুষ-বাণিজ্য হয়েছে। থানা থেকে পুলিশি ছাড়পত্র নেওয়ার সময়ও ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে বিদেশগামীদের।

বিএমইটির মহাপরিচালক সেলিম রেজা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশগামীদের হয়রানি বন্ধে ইতিমধ্যে আমরা বিভিন্ন সেবা বিকেন্দ্রীকরণ করছি। কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে বেশি টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠলে সেটিও তদন্ত করা হচ্ছে। আর ভিসা কেনাবেচা বন্ধ করতেও আমরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা করছি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে আছেন এমন বাংলাদেশিরা এই কাজটি করছেন।’ তিনি বিদেশগামীদের কাছ থেকে ১০০ বা ২০০ টাকা নেওয়ার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ব্যুরোতে দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করা হয়।

সাধারণত বিভিন্ন কোম্পানিতে যাঁরা দলীয় ভিসায় কাজ করতে যান, তাঁদের অনুমোদন দেয় প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এখানে একটি চক্র প্রতি ভিসার জন্য ১৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা নেয় বলে অভিযোগ আছে। টিআইবি বলছে, ২০১৬ সালে মন্ত্রণালয় যে ৬১ হাজার ১২২ জন কর্মীর ভিসার অনুমোদন দিয়েছে, তাতে প্রতি ভিসায় ১৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা ঘুষ-বাণিজ্য হয়েছে।

ভিসা কেনাবেচা ছাড়াও দূতাবাসে ভিসা সত্যায়নের ক্ষেত্রেও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ আছে। স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামেও টাকা নেওয়া হয়।

শ্রম অভিবাসন খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গতকাল প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে শ্রম অভিবাসনের প্রক্রিয়াটি জটিল। এখানে দালালদের প্রাধান্য। প্রতিবেশী যেকোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশিদের বিদেশ যেতে বেশি খরচ হয়। সরকারের যথাযথ তদারকির অভাব রয়েছে।’

বাংলাদেশ এবং গন্তব্য দেশ—দুই জায়গাতেই ভিসা কেনাবেচা হওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে সৌদি আরব, বাহরাইন, ওমান, কাতার, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে ভিসা কিনতে ৫ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। হুন্ডি বা অন্য কোনোভাবে এই টাকা সেখানে পাচার হয়েছে।

এই প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) জাবেদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিআইবি আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেছিল। আমরা তাদের সঙ্গে খোলামনে আলোচনা করেছি। তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন এখনো পাইনি। প্রতিবেদন দেখে তাদের সুপারিশগুলো যাচাই-বাছাই করা হবে। এই খাতে সুশাসন আনার জন্য মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সব সময় নিচ্ছে এবং নেবে।’

নারীদের ক্ষেত্রে ঘুষ ছাড়াও যৌন নিপীড়ন
বাংলাদেশ থেকে নারীদের বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত টাকা লাগে না, কিন্তু তাঁদের অনেকের কাছ থেকেও দালালেরা ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা নেওয়া হয়। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে গিয়ে অনেক নারীই যৌন নিপীড়নের শিকার হন। তবে টিআইবি বলছে, এই নির্যাতনের বিষয়ে তারা এখনো কাজ শুরু করতে পারেনি।

বাংলাদেশ থেকে নারী কর্মী যাওয়া শুরু হয়েছে ১৯৯১ সালে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫ লাখ ৯৩ হাজার ১১১ জন নারী বিদেশে গেছেন।

দালাল প্রথা ভাঙা যায়নি
দালাল প্রথা ভাঙতে সরকার তথ্যভান্ডার থেকে কর্মী নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিলেও তা এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি। টিআইবির দুই গবেষক মনজুর-ই-খোদা ও শাহজাদা এম আকরাম বলেন, বাংলাদেশিরা যেকোনো মূল্যে ভিসা ক্রয় করতে চান। সরকারের লাইসেন্স পাওয়া জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বিদেশগামীদের সরাসরি যোগাযোগ নেই বলে দালালেরাই তৃণমূল নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য প্রচার ও প্রকাশে ঘাটতি রয়েছে।

নয় দফা সুপারিশ
সমস্যা সমাধানে টিআইবি আইনের সংস্কার, ওয়ান-স্টপ সার্ভিস সেন্টার চালু, দালালদের জবাবদিহি, দলীয় ভিসা প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের অনুমতির ব্যবস্থা বাতিলসহ নয় দফা সুপারিশ করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজউদ্দিন খান, উপনির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মো. রফিকুল হাসান।

টিআইবির এই প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিবাসীদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করা সংগঠন ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব দ্য রাইটস অব বাংলাদেশি মাইগ্র্যান্টসের (ওয়ারবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিআইবির গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আমরা একমত। দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, মন্ত্রণালয় ও বিএমইটির ঘুষ-বাণিজ্যসহ নানা কারণে বিদেশগামীরা নিপীড়িত হচ্ছেন। দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থে এসবের বিরুদ্ধে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1103674