১০ মার্চ ২০১৭, শুক্রবার, ১১:১৩

মাউশিকে তদন্তের নির্দেশ

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২২ ধরনের দুর্নীতি

দেশে বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ ও জাল সনদে চাকরি দেয়াসহ ২২ ধরনের অনিয়ম চিহ্নিত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অধিকাংশ অভিযোগই অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির বিরুদ্ধে। ঢাকার খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অজপাড়াগাঁয়ের প্রতিষ্ঠানও আছে এ তালিকায়। এমন ৭৩টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরকে (মাউশি) তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমদ যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন অভিযোগ আমাদের কাছে আসে। যদিও সব অভিযোগ সঠিক হয় না। শত্রুতাবশত হয়রানির উদ্দেশেও কেউ কেউ অভিযোগ করে থাকেন। তবে যেসব অভিযোগ সঠিক মনে হয়েছে এমন কিছু আমলে নিয়ে তদন্তের জন্য মাউশিকে দেয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

মাউশি পরিচালক অধ্যাপক এলিয়াছ হোসেন এ ব্যাপারে যুগান্তরকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে বেশ কিছু অভিযোগ আমাদের কাছে তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। আমরা এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছি। শিগগিরই তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।’

মাউশিতে পাঠানো ৭৩টি অভিযোগের একটি রাজধানীর মিরপুর বাংলা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিদায়ী অধ্যক্ষ বদর উদ্দিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে। এতে বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১১ সালের ২২ জুন এই শিক্ষক বরখাস্ত হন। এরপরও তিনি অবৈধভাবে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। একই সঙ্গে ৫০ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগপত্রে দাবি করা হয়। সম্প্রতি এ ব্যাপারে আলাপকালে ওই অধ্যক্ষ যুগান্তরকে বলেন, তার বিরুদ্ধে শত্রুতাবশত কিছু ব্যক্তি অভিযোগ করেছে। অভিযোগগুলোর কোনো ভিত্তি নেই।

এদিকে অভিযোগের ব্যাপারে বৃহস্পতিবার খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, স্কুল প্রশাসনে বর্তমানে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। গভর্নিং বডির সাবেক সদস্য মো. শাহেদ জানান, বিদায়ী এই অধ্যক্ষ দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠানটিতে ছিলেন। তার দায়িত্বগ্রহণ ও পালনকাল নিয়ে প্রশ্ন আছে। যে কারণে প্রায় ৫ মাস ধরে গভর্নিং বডির অনুমোদন বন্ধ রাখে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। এমনকি এখনও স্কুলে কোনো কমিটি নেই। এ অবস্থায় স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ইস্যু বন্ধ হয়ে যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে সিনিয়র সহকারী প্রধান শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি জারি হয়। কিন্তু এই ভারপ্রাপ্ত প্রধানের বিরুদ্ধেও অবৈধভাবে নিয়োগ লাভের অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা হয়। অধ্যক্ষ পদ নিয়ে জটিলতার কারণে বর্তমানে স্কুল খাত থেকে বেতনভোগী প্রায় ২০০ শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন ৫ মাস ধরে বন্ধ আছে। এমপিওভুক্তরাও স্কুল খাত থেকে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না।

মন্ত্রণালয়ের অভিযোগের তালিকায় রাজধানীর খিলগাঁও মডেল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের নামও আছে। তার বিরুদ্ধে প্রায় কোটি টাকা আত্মসাৎ, সনদ জালিয়াতি- এমনকি একজন শিক্ষিকার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে বিয়ের অভিযোগ আনা হয়েছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজে অবৈধভাবে শিক্ষক নিয়োগ এবং কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগ করা হয়েছে। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের দু’জন শীর্ষ পর্যায়ের শিক্ষকের বিরুদ্ধে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধভাবে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। রাজধানীর মতিঝিল মডেল হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও নানা অনিয়মের অভিযোগ জমা পড়েছে। এতে অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থার আর্জি আছে। এরমধ্যে কয়েকটির অভিযোগ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর কাজ করছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে চৌধুরী মুফাদ আহমদ বলেন, আমরা প্রতিষ্ঠান দেখি না, অভিযোগ দেখি। অভিযোগ যার বিরুদ্ধেই হোক তদন্তে প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ কেউ প্রত্যাশা করে না।

রাজধানীর ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে এবারের এইচসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণে অতিরিক্ত ফি, মাসিক বেতন, কোচিং ফিসহ নানা খাতে বাড়তি অর্থ নেয়ার অভিযোগও আছে। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ মো. মাকসুদউদ্দিন বলেন, যে টাকা বোর্ড নির্ধারিত, তাই রশিদে নিয়েছি। এমনকি শতকের ঘর পূরণে ৪ টাকা কম পড়লে তাও নেয়া হয়নি। আমাদের শত্রুর কোনো অভাব নেই। তারা এ অভিযোগ করতে পারে। তবে কারা কেন করল জানি না। মাউশি চাইলে অভিযোগ তদন্ত করে দেখতে পারে।

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজের ‘স’ আদ্যক্ষরের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে বন্ধ ঘোষিত দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি থেকে বিএড ডিগ্রির সনদ কিনে সহকারী প্রধান শিক্ষক হওয়ার অভিযোগ আছে। এ অভিযোগ তদন্ত করছে মাউশি। এ ব্যাপারে ওই শিক্ষক যুগান্তরকে বলেন, তিনি সনদ কেনেননি। স্কুল থেকে অনুমতি নিয়ে পড়ালেখা করেই ডিগ্রি পেয়েছেন। তিনি দাবি করেন, শুধু তিনিই নন, আরও শতাধিক শিক্ষক দারুল ইহসান থেকে ডিগ্রি নিয়েছেন।

রাজধানীর আনন্দময়ী স্কুলের সভাপতির বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়ানোর অভিযোগ খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তদন্তের নির্দেশনা গেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। অভিযোগের মধ্যে আরও আছে, রাজধানীর উত্তরা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে অবৈধভাবে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেয়া। তেজগাঁও মডেল হাই স্কুলের সহকারী শিক্ষক কাজী একেএম শাহজাহানকে প্রধান শিক্ষক কর্তৃক বিধিবহির্ভূতভাবে পদাবনতি করা। গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার রামনগর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ভুয়া শাখা খুলে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ দেন। ময়মনসিংহের সিংরাইর উচ্চ বিদ্যালয়ের বরখাস্তকৃত প্রধান শিক্ষক আক্তার হোসেন অবৈধভাবে সিল-প্যাড ব্যবহার করে বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করে বিদ্যালয় পরিচালনায় বিঘœ সৃষ্টি করছেন। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার আশরাফগঞ্জ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকসহ মাঠের একাংশ বাঁশের বেড়া দিয়ে আটকে রেখেছেন স্থানীয় বিএনপির এক নেতা। দিনাজপুরের চিরিরবন্দর আমবাড়ি হাই স্কুলের ছাত্রবাসের জায়গায় ব্যবস্যা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কামালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি কর্তৃক অবৈধভাবে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে। রাজশাহী জেলার চারঘাট উপজেলার বালুদিয়াড় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মেয়াদ উত্তীর্ণ ম্যানেজিং কমিটি গ্রন্থাগারিক নিয়োগ ও উপবৃত্তি প্রদানে অনিয়মের অভিযোগ করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার কালিকাকেড় আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক মার্কেট নির্মাণ ও বরাদ্দ বাবদ লাখ লাখ টাকা স্কুলের তহবিলে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/03/10/107591