৯ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১:২১

স্মার্টকার্ড বিতরণে অব্যবস্থাপনা ভোগান্তি চরমে

নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি, জনবল সংকটও ব্যাপক

স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র (স্মার্টকার্ড) সংগ্রহে মঙ্গলবার রাজধানীর বিজয়নগর ঢাকা সরকারি বধির হাইস্কুল ক্যাম্পে যান ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কর্মচারী মো. দুলাল। প্রায় দেড় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টোকেন সংগ্রহ করেন। চোখের আইরিশ ও হাতের দশ আঙুলের ছাপ দেয়ার পর আরও দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার পর তাকে জানানো হল আপনার কার্ডটি ছাপা (নট ফাউন্ড) হয়নি।

এমন খবরে হতাশ ও ক্ষুব্ধ মো. দুলালকে দেখা গেল চারদিকে ছোটাছুটি করতে। দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডাও হল এক দফা। শেষ পর্যন্ত জানা গেল, তার কার্ডে উপজেলার নাম ভুল। কবে পাওয়া যাবে কার্ড তা জানা গেল না। একই দশা নয়াপল্টন কালভার্ট এলাকার বাসিন্দা মো. তাজুল ইসলামের। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তাদের মতো আরও অনেকে স্মার্টকার্ড নিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। এ ধরনের ভুক্তভোগীরা প্রতিদিন থানা, জেলা ও নির্বাচন অফিস এবং জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগে গিয়ে ভিড় করছেন।

ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, পর্যাপ্ত প্রচারণা না থাকায় অনেকে জানতেই পারছেন না কোথায় কার্ড দেয়া হচ্ছে। জানলেও অনেকে আবার দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর কারণে অফিস থাকায় নির্ধারিত দিনে সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। প্রতিটি কেন্দ্রেই জনবলের তুলনায় লোকজনের উপস্থিতি অনেক বেশি হওয়ায় কার্ড পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে।

ইসির একাধিক কর্মকর্তা এসব ভোগান্তির কথা স্বীকার করে বলেন, নির্বাচন কমিশন ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের অব্যবস্থাপনা

ও অদক্ষতার কারণে নাগরিকদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। স্মার্টকার্ড বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে নেই পর্যাপ্ত জনবল, নেই যন্ত্রপাতি। প্রায় নয় বছর আগে কেনা ২০০৮ সালের ল্যাপটপ দিয়ে চলছে এ কাজ। প্রতিটি কেন্দ্রে গড়ে মাত্র তিনটি টিম কাজ করছে। এ ছাড়া প্রচার কম হওয়ায় কেন্দ্রগুলোতে নির্ধারিত ভোটার এলাকার বাইরের মানুষও ভিড় জমাচ্ছেন। এতে চাপ বাড়ছে।

সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন বিদায়ী কমিশন পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই গত অক্টোবরে তড়িঘড়ি করে স্মার্টকার্ড বিতরণ শুরু করে। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর কার্ড বিতরণ প্রক্রিয়ায় তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ্ যুগান্তরকে বলেন, কিছু কার্ডে তথ্যগত ত্রুটি থাকায় সেগুলো ছাপা হয়নি। এগুলো কবে বিতরণ করা হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এ ছাড়া যারা নির্দিষ্ট সময়ে কার্ড সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছেন, তারা ক্যাম্প চলাবস্থায় সংগ্রহ করতে পারবেন। ওই সময়ে সংগ্রহ না করলে পরে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগে চোখের আইরিশ ও দশ আঙুলের ছাপ দিয়ে থানা অফিস থেকে স্মার্টকার্ড সংগ্রহ করতে পারবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সার্বিকভাবে জনবল সংকট রয়েছে, তবে ক্যাম্পে জনবল সংকট নেই। ল্যাপটপগুলো পুরনো, এটা সত্যি। নতুন ল্যাপটপ কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

মঙ্গলবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন বিজয়নগরের ঢাকা সরকারি বধির হাইস্কুল ক্যাম্পে গিয়ে ভোগান্তির নানা চিত্র চোখে পড়ল। নয়াপল্টন এলাকার পুরুষ ভোটারদের কার্ড বিতরণ চলছিল এ কেন্দ্রে। ওই এলাকার ভোটার সংখ্যা প্রায় চার হাজার। সকাল থেকে দুটি লাইনে কার্ড বিতরণ চলছিল। কার্ড না পেয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে দেখা গেল কয়েকজনকে। ক্যাম্পের রেজিস্টারে দেখা গেল, বেলা ১টা পর্যন্ত ৪০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের কার্ড ছাপা হয়নি। এই ৪০ জনকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কার্ড না পাওয়ার কথাটি শুনতে হয়েছে। আগের দিন সোমবার ৬৫ জনের কার্ড নট ফাউন্ড হয়। ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, গড়ে ২-৩ শতাংশ ভোটারের কার্ড নট ফাউন্ড পাওয়া যাচ্ছে। তাদের ভুল সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত কার্ড দেয়া সম্ভব হবে না।

ভোগান্তির বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার একটি থানার নির্বাচন কর্মকর্তা বলেন, ক্যাম্পগুলোতে জনবল সংকট রয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে গড়ে তিনটি টিমে পাঁচটি চোখের আইরিশ নেয়ার মেশিন, পাঁচটি ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও পাঁচটি ল্যাপটপ রয়েছে। এ ছাড়া ল্যাপটপগুলো পুরনো হওয়ায় সেগুলোর গতি কম। কখনও কখনও কাজও করে না। এক প্রকার জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে এসব ল্যাপটপ। তিনি বলেন, ডাটা অ্যান্ট্রি অপারেটরদের নামে টাকা বরাদ্দ নেই। প্রতিটি ওয়ার্ডে মাইকিংয়ের জন্য মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এটি একেবারেই অপ্রতুল। এসব কারণে কার্ড বিতরণে সময় বেশি লাগে, মানুষের কষ্ট হয়। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, মানুষের সচেতনতার অভাবেও সমস্যা হচ্ছে। নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে অনেকেই ক্যাম্পে ভিড় জমান। এ কারণেও লাইন বড় হয়। তাদের কার্ড চেক করতে অনেক সময় অপচয় হয়।

যারা ব্যস্ততার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে স্মার্টকার্ড সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন তারা আর সহজে স্মাটকার্ড নিতে পারছেন না। পরের দিন স্মার্টকার্ড নিতে গেলেই ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, থানা নির্বাচন অফিসে যোগাযোগ করতে। জানা গেছে, যারা নির্ধারিত সময়ে কার্ড নেননি তাদের অপেক্ষা করতে হতে পারে ছয় মাস পর্যন্ত। অভিযোগ রয়েছে, কার্ড বিতরণের সঙ্গে যেসব অপারেটর জড়িত তাদের অনেকেই সঠিক তথ্য দিতে পারেন না। এমনকি কার্ড সংগ্রহ করার সময় কারও কোনো সমস্যা হলে কোথায় গেলে সমাধান পাওয়া যাবে এ বিষয়েও তারা কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারছেন না। কারও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দিয়ে সার্ভারে ঢুকতে না পারলেই তাকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে এমন অভিযোগও রয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিভাগের আঞ্চলিক কর্মকর্তা মো. শাহআলম বলেন, যারা কার্ড সংগ্রহ করতে পারেননি, তাদের কার্ড আমাদের কাছে রয়েছে। থানা অফিসে চোখের আইরিশ ও আঙুলের ছাপ নেয়ার যন্ত্র না থাকায় এনআইডিতে যেতে হবে। সেখান থেকে চোখের আইরিশ ও আঙুলের ছাপ দেয়ার পর থানা অফিসে যোগাযোগ করে কার্ড নিতে পারবেন।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/03/09/107329