৯ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১:১৮

আমিন বাজার ল্যান্ডফিল ডিএনসিসির ‘ক্যান্সার’

অদক্ষ ব্যবস্থাপনায় নষ্ট হয়ে গেছে আমিন বাজার ল্যান্ডফিলের বর্জ্য শোধন সক্ষমতা। ফলে ল্যান্ডফিলে ড্যাম্পিং করা বর্জ্য থেকে সৃষ্ট লিচেট (তরল বর্জ্য) শোধন করা যাচ্ছে না। অপরিশোধিত লিচেট এর আশপাশের ডোবা-নালা, নিচু জমি এবং পাশ দিয়ে প্রবাহিত তুরাগ নদীতে মিশছে। মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে পানি ও পরিবেশ। এর আশপাশের কৃষিজমির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। আশপাশের বাসিন্দারা আক্রান্ত হচ্ছেন নানা রোগ-ব্যাধিতে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) কর্তৃপক্ষ অবগত থাকলেও রহস্যজনক কারণে নির্বিকার রয়েছেন।

মেয়র আনিসুল হক ডিএনসিসির দায়িত্ব গ্রহণের পর আবর্জনা সংগ্রহে জোরালো ভূমিকা পালন করছেন। এতে করে বর্জ্য সংগ্রহ বেড়ে যায়। বর্তমানে প্রায় আড়াই হাজার টন বর্জ্য প্রতিদিন আমিন বাজার ল্যান্ডফিলে ফেলা হচ্ছে। ফলে এটির অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। বলা চলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ডিএনসিসির ঈর্ষণীয় সাফল্য ক্যান্সারের মতো কুরে কুরে খাচ্ছে আমিন বাজার ল্যান্ডফিল। আধুনিক এই প্ল্যান্টটির করুণ অবস্থার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই অনেকাংশে দায়ী। কেননা সৃষ্ট সমস্যার সমাধানে তারা কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে মেয়রকে অবগত না করে সমস্যা গোপন রাখার প্রচেষ্টায় রত।

জানা যায়, সাভারের বনগ্রাম ইউনিয়নের বলিয়ারপুর গ্রামে ল্যান্ডফিলের লিচেট ট্রিটমেন্ট পন্ড ও প্ল্যান্ট স্থাপনের অল্প সময় পরই এটি নষ্ট হয়ে যায়। অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত লিচেট ট্রিটমেন্ট সিস্টেমটি দীর্ঘ সময়ে সক্রিয় করার উদ্যোগ না নিয়ে বরং ডিএনসিসির কর্তাব্যক্তিরা তা বর্জ্যরে নিচে চাপা দিয়েছে। সলিড লিচেটের উৎকট গন্ধ আশপাশের পরিবেশকেই শুধু বিষিয়ে তুলছে না, করে তুলেছে স্যাঁতসেঁতে। ডিএনসিসির গাড়ি চালকরা ময়লা নিয়ে এখন আর ভেতরে ঢুকতে চান না। তারা গাড়ির ময়লা ল্যান্ডফিলের আশপাশে ব্যক্তিগত কৃষিজমি ও খালি জমিতে ফেলছেন। গত দুই বছরে আশপাশের প্রায় ২০ একর ব্যক্তিগত জমি ভরাট হয়ে গেছে। ডিএনসিসি প্রভাবশালী সরকারি সংস্থা হওয়ায় এলাকাবাসীর প্রতিবাদও তাদের কান পর্যন্ত পৌঁছে না।

সূত্র মতে, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) বিভক্তির পর ডিএনসিসিতে ল্যান্ডফিল ব্যবস্থাপনা করার মতো দক্ষ লোক ছিল না। যারা দায়িত্ব পেয়েছেন, তারা দক্ষ না হওয়ায় এর সঠিক ব্যবস্থাপনা হয়নি।

জানা যায়, ১৫৬ বিঘা জমির ওপর ২০০৫ সালে আমিন বাজার ল্যান্ডফিলের নির্মাণকাজ শুরু করে ডিসিসি। ২০০৭ সাল থেকে আবর্জনা ফেলা শুরু হয়। জাপানি বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় নির্মিত এই প্ল্যান্টের মেয়াদকাল নির্ধারণ করা হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। দেশে প্রথম নির্মিত রাজধানীর মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলের পরে এটি নির্মিত হয় অত্যাধুনিক উপায়ে। মাতুয়াইলেরটি পরিবেশবান্ধব উপায়ে পরিচালিত হওয়ায় এখনও পর্যন্ত কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়নি, কিন্তু পরে অত্যাধুনিক মানের করে নির্মিত আমিন বাজার ল্যান্ডফিল অকেজো হয়ে পড়েছে।

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশলীরা বলছেন, সমস্যাগুলো দূর করা না গেলে দীর্ঘমেয়াদে ভয়ংকর পরিণতি বরণ করতে হবে। পরিবেশ ও

প্রতিবেশ দূষণের পাশাপাশি ল্যান্ডফিলের সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগানোর সুযোগ নষ্ট হবে। এতে করে এটিকে পরিত্যক্ত বর্জ্য ভাগাড় ঘোষণা করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প থাকবে না।

তারা বলছেন, সমস্যাগুলো দূর করতে পারলে জাপানের মতো ল্যান্ডফিলের বহুমুখী ব্যবহার করে বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি সম্পদ আহরণ করা সম্ভব হবে। এখন দরকার ডিএনসিসির সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বৃত্তাকার সড়কপথ দিয়ে আমিন বাজার ল্যান্ডফিলের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। বৃত্তাকার সড়কের ভেতরের অংশে বর্জ্য সীমাবদ্ধ থাকার কথা। কিন্তু, সেটা মানা হচ্ছে না। প্রতিবাদ সত্ত্বেও আশপাশের বহু ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। ওই এলাকার পরিবেশ ও পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়ছে। বর্জ্যরে কারণে আবাদ করতে পারছেন না জমির মালিকরা। এ প্রসঙ্গে আমিন বাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এটি আশপাশের এলাকার পরিবেশের মারাত্মক দূষণ ঘটাচ্ছে। তুরাগ নদীও দূষিত হয়ে পড়ছে। এলাকাবাসী এর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চায়।

রাজধানীর দু’টি ল্যান্ডফিল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক ডিএনসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড. তারিক বিন ইউসুফ যুগান্তরকে বলেন, মাতুয়াইল এবং আমিন বাজার দু’টি প্রকল্পের ডিজাইন ও ড্রয়িং আমার হাতে করা। প্রকল্প পরিচালকও আমি ছিলাম। এই প্রকল্পের নির্মাণকাজে কোনো ত্রুটি ছিল না। ডিসিসি বিভক্তির পর অদক্ষ লোক দিয়ে এটি পরিচালনা করায় এর লিচেট পন্ড ও লিচেট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নষ্ট হয়ে গেছে। এখন সমস্যার সমাধান না করে সেসব আবর্জনা দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে। এটি এখন ওই এলাকার পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাচ্ছে।

আমিন বাজার ল্যান্ডফিলের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক বর্তমান মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুল্লাহ হারুন যুগান্তরকে বলেন, আমিন বাজার প্রকল্প নির্মাণে কোনো ত্রুটি ছিল না। বিভক্তির পর ব্যবস্থাপনায় দক্ষ লোক না থাকায় এটি পরিত্যক্ত বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।

আমিন বাজার প্রকল্পের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক ও ডিএনসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম শফিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ২০১৪ সাল থেকে আমি আমিন বাজার ল্যান্ডফিলের দায়িত্বে আছি। দায়িত্ব গ্রহণের পর দেখি এটির করুণ অবস্থা। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত আছেন। এরপর একটু একটু করে উন্নতির চেষ্টা করেছি। বর্তমানে এটি আগের চেয়ে কিছুটা ভালো। মেয়রও এলাকা পরিদর্শন করেছেন। আশা করি দ্রুততম সময়ের মধ্যে এর দুর্বলতাগুলো দূর করতে সক্ষম হব। এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর আবদুর রাজ্জাক যুগান্তরকে বলেন, আমিন বাজার প্রকল্পের লিচেট পন্ড ও ট্রিটমেন্ট প্ল্যান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আশা করি দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান হবে। তবে অন্যের জমিতে আবর্জনা ফেলার বিষয়ে কোনো মতামত জানাননি। বলেছেন, বিষয়টি যাচাই করে দেখবেন।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/03/09/107328