৯ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১:১৫

অর্থ এবং পরিকল্পনামন্ত্রীর কাছে অর্থ উপদেষ্টার চিঠি

বেসরকারি বিনিয়োগ কমছে শংকা প্রবৃদ্ধি নিয়েও

বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়া এবং সরকারি অর্থ ব্যয়ে সক্ষমতার অভাবে প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে- এমন আশংকা প্রকাশ করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। পাশাপাশি ব্যাংকের স্প্রেড কমাতে ঋণের সুদের হার হ্রাস করা যেতে পারে বলেও মনে করছেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে দেয়া এক চিঠিতে এসব বিষয় তুলে ধরেছেন অর্থ উপদেষ্টা। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগে বাধা এবং সরকারি অর্থ ব্যয়ে সীমাবদ্ধতার কারণ চিহ্নিত করে তা দূর করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রবাহ গতি পাচ্ছে না। এর সমাধানে দীর্ঘ মেয়াদে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য যে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে, তা বাস্তবায়নে সময় লাগবে। পাশাপাশি রয়েছে গ্যাসের সমস্যা। এলএনজি টার্মিনাল করে গ্যাস আনতেও সময় লাগবে। আর সরকারি অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতার অভাব দীর্ঘদিনের। এটিও সমাধান জরুরি। এছাড়া সুশাসনের অভাবও রয়েছে। তিনি বলেন, ‘ড. মসিউর রহমান যে সমস্যা চিহ্নিত করেছেন আমি তার সঙ্গে একমত পোষণ করি।’

মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক ঋণের সুদসহ আর্থিক খাতের সূচকের পর্যালোচনা করে ড. মসিউর রহমান তার চিঠিতে উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক দশকে সঞ্চয়ের হার বাড়তির দিকে আছে। কিন্তু মানুষের সঞ্চয় প্রবণতা সহজে পরিবর্তন হয় না। এজন্য বিনিয়োগের সুযোগ সমান হারে বাড়ানো দরকার। না হলে মধ্যস্থতা কমে যাওয়ার আশংকা থাকবে। এ অবস্থার সৃষ্টি হলে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যে পার্থক্য বাড়বে। এতে সঞ্চয়ের আর্থিক রূপান্তর এবং বিনিয়োগের গতি দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। বিনিয়োগ না থাকায় এ সময়ে ব্যাংকিং খাতে অলস টাকার পরিমাণ বাড়ছে কিনা সেদিকেও লক্ষ্য রাখা দরকার।

ওই চিঠিতে তিনি আরও বলেন, মধ্যম আয়ের দেশের অবস্থান সুসংহত করা এবং উন্নত দেশে পৌঁছানোর জন্য সামষ্টিক অর্থনীতি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা দরকার। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানিটারি পলিসি (মুদ্রানীতি) অনুযায়ী কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। মূলত ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে শ্লথ গতি এবং সরকারের ব্যয় করার সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা প্রবৃদ্ধি অর্জনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এসব বাধার দিকে নজর দেয়া একান্ত আবশ্যক বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

অর্থ উপদেষ্টার চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘ব্যাংক জমার সুদ কমেছে ৪৫ বেসিস পয়েন্ট এবং ঋণের সুদ কমেছে ২৫ বেসিস পয়েন্ট। অর্থাৎ ব্যাংকের মুনাফা বৃদ্ধি হবে ২০ বেসিস পয়েন্ট। স্প্রেড ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০ বেসিস পয়েন্ট মুনাফা বাড়লে, ব্যাংকের স্পেড কমানোর সুযোগ আছে, যার ফলে জমা-সুদের হার কিছু বাড়াতে পারে অথবা ঋণের সুদ কিছু কমতে পারে। (২০ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত সুদ কম-বেশি হতে পারে)।’

বাজারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা সরবরাহ প্রসঙ্গে ওই চিঠিতে বলা হয়, সরবরাহের ধারা সংকোচনমূলক। বর্তমান সময়ে টাকা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ হওয়ার কথা। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা হয়েছে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১ শতাংশ কম। এ সময়ে সরকারের ঋণ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু প্রকৃত বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম হয়েছে ১ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ সেখানে প্রকৃত ঋণ বৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া অর্থ ও রাজস্ব খাত উভয় সংকোচনমুখী উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, এতে প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

চিঠি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ড. মসিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, মুদ্রানীতির ওপর একটি বিশ্লেষণ করে অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতির তুলনায় আমানতের সুদের হার কমছে সামান্য। কিন্তু সঞ্চয়কারীরা কিছুটা রিটার্ন আশা করেন। সে ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির তুলনায় দীর্ঘমেয়াদি সুদ হার কম হলে এটি সঞ্চয়কারীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি আরও বলেন, প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আর বিনিয়োগের বাধাসহ অন্য বাধাগুলো দূর করা আবশ্যক।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনের অন্যতম উপাদান হচ্ছে বিনিয়োগ বাড়ানো। কিন্তু বেসরকারি খাতে আশানুরূপ বিনিয়োগ হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, শিল্পকারখানা নতুনভাবে স্থাপনে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে শিল্প স্থাপন করে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অভাবে চালু করতে পারছে না। রয়েছে নতুন শিল্প স্থাপনে জমির অভাব। এর সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ হার এবং দুর্বল অবকাঠামো। বিনিয়োগ না থাকায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থানের ওপর। যা প্রবৃদ্ধি অর্জনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

বিনিয়োগের এ মন্দা অবস্থা ছাড়াও উন্নয়নের জন্য সরকারি ব্যয়ের সক্ষমতার অভাব রয়েছে। টাকা খরচ করতে না পারায় বিদেশী অনেক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ফেরত যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি- এ ৭ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৩২ শতাংশ। টাকার অংকে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে মোট এডিপির আকার হচ্ছে ১ লাখ ২৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। ইতিমধ্যেই এডিপি কাটছাঁটের প্রক্রিয়া শুরু করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এছাড়া বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা কমানো হচ্ছে বলেও জানা গেছে। মূলত অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতার অভাবেই প্রতি বছরই এডিপির সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয় করতে পারে না।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/03/09/107325