হাজারীবাগ ট্যানারিতে কাজ করছেন শ্রমিকেরা
৯ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১:০৬

লেজেগোবরে অবস্থা চামড়া শিল্পে

আদালতের নির্দেশ ১৭ বছর ধরে উপেক্ষিত ১৪ বছরেও সম্পন্ন হয়নি ৩ বছরের প্রকল্প উদ্যোক্তারা অনেকটা হালছাড়া

হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সরিয়ে নিতে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ নির্দেশ দিয়েছিলেন ২০০১ সালে। ওই আদেশ বাস্তবায়িত না হওয়ায় ট্যানারি শিল্প অন্যত্র সরিয়ে নিতে ২০০৯ সালের ২৩ জুন হাইকোর্ট ফের সময় নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সরকার পরে আবেদনে ওই সময়সীমা কয়েক দফা বাড়িয়ে ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। নানা কৌশলে আদালতের নির্দেশনা ১৭ বছরেও বাস্তবায়িত না হওয়ায় গত সোমবার এক আদেশে সব ট্যানারি অবিলম্বে বন্ধ করার পাশাপাশি কারখানাগুলোর বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাসহ সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেন আদালত।

২০০১ সালে দেয়া আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কারখানাগুলো সাভারের হরিণধরায় সরিয়ে নিতে ২০০৩ সালে তিন বছর মেয়াদি যে প্রকল্প হাতে নেয়া হয় তার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে এক যুগ আগে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সাতবার। ১৭৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকার প্রকল্পের ব্যয় বাড়তে বাড়তে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকায়। ইতোমধ্যে দীর্ঘ সময় পার হলেও প্রকল্পের অগ্রগতি এখনো হতাশাজনক বলে জানান উপকারভোগিরা। গত মাস পর্যন্ত চামড়া শিল্প নগরীর কাজে অগ্রগতি মাত্র ৫৪ শতাংশ, টাকার অঙ্কে মাত্র ৫৭৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। প্রকল্পের এখনো ৪৯৪ কোটি ৯৩ লাখ খরচ করা হয়নি বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। তবে বেশ কিছু বিল অপরিশোধিত থাকায় প্রকৃত কাজের চেয়ে আর্থিক অগ্রগতি কম দেখা যাচ্ছে বলে জানান প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা।
আইনের ফাঁক খোঁজা হচ্ছে এখনো

একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেেিত ২০০১ সালে ট্যানারি শিল্প হাজারীবাগ থেকে সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। দীর্ঘ দিন ধরে ওই আদেশটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় অন্য এক আবেদনে ২০০৯ সালের ২৩ জুন আবারো ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো অন্যত্র সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সরকারপরে আবেদনে ওই সময়সীমা কয়েক দফা বাড়িয়ে ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেও ট্যানারি স্থানান্তরিত না হওয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠন। ওই মামলার প্রোপটে ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল আদালত অবমাননার রুল জারি করেন হাইকোর্ট। ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল আদালতে হাজির হয়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন শিল্প সচিব।

কোনোভাবেই কাজ না হলে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয় কয়েকটি ট্যানারির বিরুদ্ধে। এ আবেদনের শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১১ আগস্ট ১০ কারখানা মালিকের বিরুদ্ধে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এখনো যেসব ট্যানারি হাজারীবাগে রয়েছে সেগুলোর তালিকা দিতে ১৩ এপ্রিল শিল্প সচিবকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। তার পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প সচিবের পে আদালতে ১৫৫টি ট্যানারির তালিকা দাখিল করা হয়। কারখানা স্থানান্তরে ব্যর্থ মালিকদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানার নির্দেশও দেন হাইকোর্ট। ওই আদেশের বিরুদ্ধে ট্যানারি মালিকেরা আপিল করেন। পরে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ জরিমানার পরিমাণ এক-পঞ্চমাংশ কমিয়ে দৈনিক ১০ হাজার টাকা ধার্য করেন। কিন্তু সে টাকাও তারা জমা না দিলে পুনরায় পরিশোধের সময়সীমা বেঁধে দেন আদালত। এখন তারা আইনের ফাঁক খুঁজছেন, কিভাবে জরিমানার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পেলে এ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করবেন বলেন জানান সংশ্লিষ্টরা।

অতিরিক্ত এক যুগ সময় পার : রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে দুই শতাধিক ট্যানারি সাভারের হরিণধরায় স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ২০০২ সালে। ২০০৩ সালে শুরু হয় তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের কাজ। জমি অধিগ্রহণ, মাটি ভরাট, রাস্তাঘাট তৈরিসহ ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয় নির্ধারিত তিন বছরের মধ্যেই। বাকি ৩০ শতাংশ, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) স্থাপনে বিলম্বই কাল হয়ে দাঁড়ায় পুরো প্রকল্পের জন্য। এরই মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে সাতবার। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বদল হয়েছেন ছয়বার। প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন হয়েছেন নয় বার। কারখানাগুলো হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরের জন্য মালিকদের যে পরিমাণ আর্থিক সামর্থ্য দরকার তাও হারিয়ে ফেলেছেন তারা দীর্ঘ দিন ধুঁকতে ধুঁকতে। সরকারের পক্ষ থেকে কারখানা স্থানান্তরে তীব্র চাপের সাথে আদালতের কঠোর অবস্থান ত্রিমুখী সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে দেশের সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্প উদ্যোক্তাদের।

পানির দরে চামড়া বিক্রি : চামড়া শিল্পে বিপর্যয়ের চিত্র ফুটে ওঠে কাঁচা চামড়ার অস্বাভাবিক দরপতনের মাধ্যমেও। পাঁচ বছর আগে যে গরুর চামড়া তিন থেকে চার হাজার টাকায় বিক্রি হতো তার দাম নামতে নামতে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকায় নেমে এসেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ২০১৩ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। ২০১৪ সালে এ দাম ১৫ টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। ২০১৫ সালে দর নির্ধারণ না করে গরিব-মিসকিনদের বঞ্চিত করে নামমাত্র মূল্যে চামড়া কিনেছেন ব্যবসায়ীরা। ২০১৬ সালে দাম নির্ধারণ করলেও তা ছিল অস্বাভাবিক কম। সেবার রাজধানী ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দর নির্ধারণ করা হয় মাত্র ৫০ টাকা। ঢাকার বাইরে এ দাম ছিল ৪০ টাকা। যদিও এ দামও পাননি চামড়ার প্রকৃত মালিক গরিব মানুষ। চামড়ার দর নিয়ে চরম অসন্তোষ দেখা দেয় গত ফেব্রুয়ারি মাসে। তিন হাজার টাকার চামড়ার দর ৮০০ থেকে এক হাজার টাকায় নেমে আসায় টানা ছয় দিন ঢাকায় ধর্মঘটও পালন করে বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি।

ইমেজ সঙ্কটে পুরো শিল্প : চামড়া শিল্পের বিপর্যয়ের কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু তাহের নয়া দিগন্তকে বলেন, সাভারের চামড়া শিল্পনগরী এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। এ কারণে আমরা চাইলেও কারখানা স্থানান্তর করতে পারছি না। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০১৪ সালের মধ্যে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো সাভারে স্থানান্তরের জন্য সময় বেঁধে দিয়েছিল। অন্যথায় তারা আর আমাদের অর্ডার দেবে না বলে সতর্ক করেছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে আমরা সাভারের চামড়া শিল্প পার্কে যেতে না পারায় ইমেজ সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানি অ্যাপেক্সসহ অনেক আন্তর্জাতিক ক্রেতাই সম্প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশের চামড়া থেকে। এখনই কার্যকর উদ্যোগ নেয়া না হলে চামড়া শিল্প চরম বিপর্যয়ে পড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

হাল ছেড়ে দিয়েছেন অনেকে : হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো সাভারে স্থানান্তরের ঘোষণা দেয়ার পরপরই এ খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কারখানা সম্প্রসারণ তো দূরের কথা মেশিনগুলো চালু রাখাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে উদ্যোক্তাদের কাছে। পরিবেশ উন্নয়নে চাপ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সময়মতো পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ হওয়ায় একের পর এক সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকান বায়ারদের সাথে। সর্বোপরি সরকারের পক্ষ থেকে কারখানা স্থানান্তরে তীব্র চাপের সাথে আদালতের কঠোর অবস্থান ত্রিমুখী সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে চামড়া শিল্পের উদ্যোক্তাদের। এরই মধ্যে আইন মেনে যারা সাভারে কারখানা স্থানান্তর করেছেন নানা সঙ্কটে পড়ে তারাও ভালো নেই। আবার যারা স্থানান্তরে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের ওপর নেমে আসছে নানামুখী চাপ। এই চাপ সামলাতে ব্যর্থ হয়ে ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে শত শত কারখানা। চাকরি হারিয়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক। অন্তর্জাতিক বাজারে ভাবমর্যাদা সঙ্কটে পড়ে কমতে থাকে রফতানি। কমতে থাকে এ খাত থেকে রফতানি আয়। এসব কারণে উদ্যোক্তারা অনেকটাই হতাশ এবং হাল ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানান অনেকে।