৯ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১২:৪০

স্বেচ্ছা অবসরের হিড়িক বিমানে

মৃত্যুদণ্ডের বিধানে উৎকণ্ঠা চোরাচালান নিয়ে হয়রানি পেনশন নীতিমালা এড়ানোর কৌশল

দেশের একমাত্র সরকারি আকাশ পরিবহন সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বেচ্ছা অবসরের হিড়িক পড়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা, প্রকৌশলীসহ অবসর আবেদনের লম্বা একটি তালিকা সংশ্লিষ্ট বিভাগে জমা পড়লে সাধারণ কর্মচারীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে দুশ্চিন্তায় ফেললেও তারা একেবারে চুপ।

একসময়ের সোনার হরিণ হিসেবে বিবেচিত বিমানের চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ছেড়ে চলে যাচ্ছেন সংস্থাটির অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী। এমন বিষয়টি নিয়ে কেউ মুখ না খুললেও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে তা হচ্ছে, সরকারের পেনশন নীতিমালায় পরিবর্তন। এতে যারা শতভাগ সার্ভিস বেনিফিট তুলে নিতে চান তারা জুন ২০১৭ সালের আগে অবসরে যাচ্ছেন। কেননা এ মেয়াদের পর অবসরে গেলে মোট প্রাপ্যের ৫০ শতাংশ পেনশন বিক্রির যে নিয়ম সরকার করেছে; সে নীতিমালায় পড়তে চাচ্ছেন না অনেকেই। তবে শুধু যাদের চাকরির মেয়াদ ২৫ বছরের কাছাকাছি তাদের ক্ষেত্রেই এমনটি হচ্ছে বলে জানা গেছে।

অন্য যে বিষয়টি বিমানের প্রতিটি সদস্যকে ভাবিয়ে তুলেছেÑ তা হলো ‘বেসামরিক বিমান চলাচল আইন-২০১৭’। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি আইনের খসড়া অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এ আইনের ২৯ ধারা অনুযায়ী বিমান চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি করলে, যা মানুষের জীবনের জন্য হুমকি হতে পারে, তাহলে এর দায়ে দোষী ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। পাশাপাশি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও আইনের ২৬ ধারায় বলা হয়েছে, বিমানের ‘এয়ার নেভিগেশন অর্ডার (এএনও)’ অনুযায়ী পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা না করা, বিমান পরিচালনায় গাফিলতি প্রমাণিত হলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা হবে। গত বছরের ২৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট যাওয়ার পথে তাকে বহনকারী বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে তুর্কমেনিস্তানে জরুরি অবতরণ করতে হয়। বিমানের ওই ফাইটটিতে ইঞ্জিন অয়েল ট্যাংকের একটি নাট ঢিলে থাকায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা ছিল। এ বিষয়ে দু’টি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তদন্ত শেষে বিমানের ৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও পরে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

সূত্র জানিয়েছে, আইনটি অনুমোদনের পর বিমানের ফাইট অপারেশনের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানুষের কাজে ভুল হতে পারে। ওই ভুলের জন্য আইন অনুযায়ী যেকোনো সময় তাদের মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন বা অর্থদণ্ড হতে পারে। ফলে বিমানে চাকরি করা মানে জীবন হাতে নিয়ে চলা। এর চেয়ে চাকরি ছেড়ে অবসরে যাওয়াকেই অনেকে শ্রেয় মনে করছেন।

এ ছাড়া গত কয়েক বছরে সোনা চোরাচালান মামলায় বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। একটি সঙ্ঘবদ্ধ চক্র বিমান কর্মচারীদের রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রলোভনে ফেলে দেয়। এর মধ্যে অনেকে এ ফাঁদে পা দিয়ে চোরাচালানিদের সাথে হাত মেলান। সাম্প্রতিক সোনা জব্দের ঘটনাগুলোতে দেখা যায়, শিফটের দায়িত্ব পালনকারী বিমানের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী ফেঁসে যাচ্ছেন। নিরপরাধ হওয়ার পরও তাদের টানতে হচ্ছে মামলার ঘানি। দেশের বাইরে বা অন্য মামলায় জেলে অবস্থানকারীরাও চোরাচালান মামলার আসামি হচ্ছেন। এ নিয়ে বিরূপ প্রভাব পড়ছে গোটা প্রতিষ্ঠানে। এসব মামলায় তদন্তের নামে অহেতুক হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা। প্রত্যেকের আয়কর হিসাব বিবরণী, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, সম্পত্তির হিসাব নিয়ে টানাটানি হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকায় সার্বক্ষণিক আতঙ্কে থাকছেন সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আগাম অবসরে যাওয়ার পেছনে বিষয়ও কাজ করছে বলে জানা গেছে।

আগাম অবসরে যাচ্ছেন অনেকে : বিমান সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইওর কাছে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা আগাম অবসরের জন্য আবেদন জমা দিয়েছেন। এ ব্যাপারে বিমানের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক প্রশাসন মোমিনুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে প্রশাসনিক দফতর সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে নিশ্চিত করে জানান, স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে বিদায় নিতে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ কর্মকর্তা আবেদন করেছেন। এর মধ্যে, প্রকৌশল বিভাগ, কাস্টমার সার্ভিস, প্রশাসনিকসহ বিভিন্ন সেক্টরের বেশ কিছু কর্মকর্তা রয়েছেন। প্রতিদিনই এ সংখ্যা বাড়ছে।

তারা জানান, যারা আবেদন করেছেন তাদের চাকরির বয়স তিন মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত অবশিষ্ট আছে। আগাম অবসরের বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা মুখ না খুললেও সার্ভিস বেনিফিট কর্তন, নতুন বেসামরিক বিমান চলাচল আইন ও চোরাচালান নিয়ে ফেঁসে যাওয়ার বিষয়টি এ ক্ষেত্রে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন অনেকে। তালিকাভুক্তদের মধ্যে আছেন, বিমানের সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মীর আফতাব উদ্দিন। এ ছাড়া হ্যাঙ্গার বিভাগের একজনসহ আরো কয়েকজন আবেদন জমা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মীর আফতাব উদ্দিন নয়া দিগন্তকে বলেন, কোনো কারণ নেই। এমনিতেই আমি চলে যাচ্ছি।

তিনি বলেন, সরকারের সব নিয়মকানুন এখানে মানা হয় ঠিকই; কিন্তু ইমপ্লিমেন্ট হয় দেরিতে। বিমানের প্রকৌশল শাখার প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার গিয়াস উদ্দিন অবসরে যেতে আবেদন করেছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। তবে গিয়াস উদ্দিনের সাথে এ প্রতিবেদক যোগাযোগ করলে তিনি তা স্বীকার করেননি। তিনি বলেন, আমার চাকরির বয়স এখনো এক বছর বাকি আছে। তবে শুনেছি বিমানের বলাকা ভবন থেকে অনেকেই স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার জন্য আবেদন জমা দিয়েছেন।

বিমানের বলাকা ভবনের পেনশন শাখার পার্সোনাল অফিসার শেফালী বেগমের সাথে গতকাল বুধবার যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার জন্য যারা আবেদন করেছেন তাদের তালিকাটা এ মুহূর্তে আমার হাতে নেই। তা ছাড়া আমি আজই (গতকাল) এখানে যোগদান করেছি।

তিনি বলেন, যারা স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে চলে যেতে আবেদন করেছেনÑ তাদের বিষয়টি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ফাইল ব্যবস্থাপনা পরিচালক পর্যন্ত যাবে। এর পরও পেনশনসংক্রান্ত আরো অনেক প্রসেস আছে।

বিমানের জেনারেল ম্যানেজার (জনসংযোগ) শাকিল মেরাজের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সরকারি চাকরিতে ২৫ বছর পূর্ণ হলে যে কেউ আইনের বিধান মোতাবেক স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার অধিকার রাখেন। তারা সেই আইনের আলোকে ব্যক্তিগতভাবে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে দরখাস্ত করেছেন। এটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। এতে বিমানের কোনো সমস্যা নেই। আগে গেলে শতভাগ টাকা নিয়ে যেতে পারবেন। জুনের পরে গেলে ৫০ ভাগ টাকা পাবেন। বাকি ৫০ ভাগ পেনশন বেনিফিট হিসেবে পাবেন। এ ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে তিনি কথা বলতে চাননি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/202047