৯ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১২:২৬

ঝরে পড়ছে মর্যাদার পালক

শুধু মনুষ্য-সমাজে জন্মগ্রহণের কারণে মানুষ শ্রেষ্ঠ হতে পারে না। শ্রেষ্ঠত্বের জন্য প্রয়োজন অভ্রান্ত ধর্ম-দর্শনের চর্চা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, বর্তমান ভোগবাদী সভ্যতায় বস্তুবাদের তুলনায় ধর্ম-দর্শনের চর্চা হয় কম। আসলে বস্তু এবং ধর্ম এ দু’টি বিষয়ই মানবজীবনে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমান সভ্যতার সংকট হলো, যথা- বিষয়কে যথাস্থানে রাখার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। ধর্ম-দর্শনের আলোকে বস্তুর ব্যবহার হলে তা মানবজীবনে এবং সভ্যতায় অধিকতর কল্যাণকর বলে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ত্রুটি থাকায় বর্তমান সভ্যতায় বিজ্ঞান-প্রযুক্তি মানবজীবনে এবং সভ্যতায় কাক্সিক্ষত অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে কিনা সেই প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে এমন বাস্তবতায়ও কোনো কোনো সময় এমন কিছু উদাহরণ লক্ষ্য করা যায়, যাতে মনে হয় এখনো ধর্ম-দর্শনের গুরুত্বকে মানুষ স্বীকার করে।

পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের সুপ্রীম কোর্টের নতুন প্রধান বিচারপতি চৌধুরী ইবরাহীম জিয়া ঘোষণা করেছেন, পদোন্নতির ক্ষেত্রে নামাজ শর্ত। সুপ্রীম কোর্টের যে সব কর্মকর্তারা নামাজে মনোযোগী হবেন কেবল মাত্র তাদেরই পদোন্নতি হবে। এর একটি ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন। বিচারপতি মহোদয় মনে করেন, নামাজ আল্লাহর ফরজ বিধান। প্রতিটি মুসলমানের জন্য নামাজ আদায় করা ফরজ। যারা আল্লাহর ফরজ বিধান গুরুত্বের সঙ্গে পালন করবেন, তারা নিজেদের কর্মস্থলের দায়িত্বও গুরুত্বের সাথে আদায় করবেন বলে আশা করা যায়। সুপ্রীম কোর্টের কর্মকর্তাদের নামাজ পড়ার বিষয়টি গোপনভাবে লক্ষ্য রাখা হবে বলেও তিনি ঘোষণা করেন।

নামাজ পড়ার বিষয়টিকে বিচারপতি মহোদয় যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন তা ভেবে দেখার মত। বর্তমান সময়ে স্রষ্টার বিধিবিধান পালনে শুধু অন্যরা নয়, মুসলমানরাও কতটা গাফেল রয়েছে তা উক্ত ঘোষণা থেকে উপলব্ধি করা যায়। নামাজের গুরুত্ব ও লক্ষ্য সম্পর্কেতো মুসলমানদের জানা থাকার কথা। তাদের তো এ বিষয়টিও জানা থাকার কথা যে, কোনো সমাজে প্রকৃত অর্থে নামাজ কায়েম থাকলে সেই সমাজে অন্যায়, অশ্লীলতা ও দায়িত্বহীনতা বিরাজ করতে পারে না। মাননীয় বিচারপতি হয়তো তাঁর ঘোষণার মাধ্যমে ধর্ম-দর্শনের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে চেয়েছেন। বিচারপতির এই ঘোষণায় কবিতার একটি চরণের কথা মনে পড়ে গেল ‘আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’ মুসলমানদের ফরজ ইবাদত নামাজ পড়ার জন্য এখন প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হয়। এমন অবস্থায় তাদের আধমরাদের সাথে তুলনা করলে খুব ভুল হবে কী? শুধু কাশ্মীর বা পাকিস্তানে নয়, মুসলমানদের ‘আধমরা’ অবস্থা পৃথিবীর প্রায় সব জনপদেই লক্ষ্য করা যায়। মুসলমানদের সেই ঈমান ও প্রাণের জোর যেন লুপ্ত হতে চলেছে। ওহী গ্রন্থের সাথে দুর্বল সম্পর্ক এর বড় কারণ। ফলে অভ্রান্ত জ্ঞানের অভাবে নীতি-নৈতিকতার ক্ষেত্রেও নেমেছে ধস।

এক সময় বাংলাদেশে ছাত্রনেতাদের অনেক সম্মান ছিল। গ্রামেগঞ্জে এবং শহরেও বিচার-আচারের দায়িত্ব পালন করতেন ছাত্রনেতারা। নীতি নৈতিকতায় তারা পুষ্ট ছিলেন। গ্রামের মানুষ তো রীতিমতো অপেক্ষায় থাকতো কখন ছুটিছাটায় ছাত্রনেতারা গ্রামে আসবেন এবং বিরোধপূর্ণ বিষয়ে বিচার-ফয়সালা করে দেবেন। কিন্তু ছাত্রনেতাদের ইমেজের সেই পালকটা এভাবে খসে পড়লো কেমন করে? আসলে ছাত্রনেতারা যখন থেকে লেজুড়বৃত্তি গ্রহণ করেছে এবং ন্যায়ভ্রষ্ট হয়ে ভুল পথে গমন করেছে, তখন থেকেই শুরু হয়েছে ইমেজ ধসের পালা। এখন আর কেউ ছাত্রনেতাদের জন্য বিচারের অপেক্ষায় থাকে না বরং তাদের এড়িয়ে চলতেই চেষ্টা করেন সাধারণ মানুষ। কারণ ছাত্রনেতারা তো এখন ভয়ঙ্কর বস্তুতে পরিণত হয়েছেন। তবে এখনও আদর্শনিষ্ঠ কিছু নীতিবান ছাত্রনেতা আছেন এরা ব্যতিক্রমের পর্যায়ে পড়েন।

বর্তমান সময়ের ভয়ঙ্কর ছাত্রনেতাদের একজন রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতি মেহেদী হাসান শিশির। গত ৬ মার্চ তারিখে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয় : দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গায়ে মাইকের ব্যাটারির এসিড ছুঁড়ে দেয়া, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, শিক্ষক লাঞ্ছনা, যৌন হয়রানি, ভর্তি বাণিজ্যের টাকা বাটোয়ারা, ফাও খাওয়া, ছাত্রী হলে জোর করে ঢোকাসহ বিভিন্ন আপত্তিকর কর্মকা-ের কারণে এই ছাত্রলীগ নেতা সমাজে ভয়ঙ্কর মানুষ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। এ ছাড়া পরীক্ষায় ধারাবাহিকভাবে অকৃতকার্য হওয়ার কারণে তার ছাত্রত্বও বাতিল করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ ১ লাখ টাকা চাঁদা না দেয়ায় একটি কনফেকশনারির দোকানে হামলা ও লুটপাট করা নিয়ে ব্যবসায়ী ও তার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে রক্তাক্ত হয়েছে উচ্চশিক্ষার এই বিদ্যাপিঠ। উল্লেখ্য যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা মেহেদী হাসান শিশির বর্তমানে শহীদ মোখতার এলাহী হলের ৬০৭ নম্বর রুমের আবাসিক ছাত্র। ছাত্রত্ব না থাকায় নিয়ম অনুযায়ী তার হলের সিটও বাতিল হওয়ার কথা। কিন্তু এখনও সেই বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। বরং সেই রুমে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় এবং আশপাশের এলাকায় সমর্থকদের নিয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। উল্লেখ্য যে, ২০১২ সালে ইংরেজি বিভাগের ছাত্র মেহেদী হাসান শিশির রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি হন। এর পরেই তার নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী চক্র গড়ে ওঠে ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায়। সম্প্রতি এই ছাত্রনেতার ইয়াবা সেবনের ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।

এলাকাবাসী জানায়, মেহেদী হাসান শিশির একজন মেধাবী ছাত্র ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে রাজনীতির গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে এখন সে অপরাধী চক্রের নেতা হয়ে উঠেছে। তাই প্রশ্ন জাগে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর একজন মেধাবী ছাত্র এমন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে কেমন করে? এর কারণ কি তথাকথিত রাজনীতি? এ বিষয়ে কোন ব্লেমগেম নয় বরং প্রয়োজন যথার্থ আত্মসমালোচনা। দেশের মানুষ আমাদের জাতীয় রাজনীতির ও ছাত্র রাজনীতির গলদগুলো জানেন। দেশ ও জনগণের কল্যাণের কথা বলা হলেও এখন আমাদের রাজনীতির মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে ক্ষমতায় আরোহন! আর এ কাজে এখন যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহৃত হচ্ছেন ছাত্রনেতারা। আদর্শ-নিষ্ঠা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার অভাবে যা হয় সেটাই এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ও ছাত্রদের ক্যাম্পাসে। এমন পরিস্থিতির আশু পরিবর্তন প্রয়োজন। জানি না তেমন নৈতিকতা কখন ফিরে আসবে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে।

http://www.dailysangram.com/post/274876