৮ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১২:৫০

বাংলাদেশের উদ্বেগ পাত্তা দেয় না মিয়ানমার

মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকার ৪৬ কারখানায় তৈরি হচ্ছে ইয়াবা। নৌপথে কয়েকটি রুটে সেগুলো বাংলাদেশে পাচার করছে কারবারিরা। ইয়াবা তৈরি ও পাচার বন্ধে উদ্যোগ নিতে বছরের পর বছর ধরে মিয়ানমারকে অনুরোধ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) পাঁচ বছর আগে এ বিষয়ে একটি তালিকা দিয়েছে মাদকের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় কমিটিকে (সিসিডিএসি)। দুই বছর আগে হালনাগাদ তালিকাও দেওয়া হয়েছে। কূটনৈতিক যোগাযোগেও ঘুরেফিরেই আসছে ইয়াবা ইস্যু। মাদক ও অপরাধ নির্মূলবিষয়ক জাতিসংঘ কার্যালয়ের (ইউএনওডিসি) এবং বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশনের (বিমসটেক) বৈঠকেও ইয়াবা ইস্যুতে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গা করেনি মিয়ানমার। কারখানা বন্ধ বা ইয়াবা পাচার ঠেকাতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সিসিডিএসি বা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, শুরুতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার বাংলাদেশের অনুরোধকে পাত্তাই দেয়নি। ২০১৫ সালে ঢাকার পক্ষ থেকে ইয়াবার ৪৫টি কারখানার তালিকা দিয়ে সেগুলো বন্ধ করার অনুরোধ করা হলেও মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা বৈঠকের যৌথ স্মারকে সই করেননি। সিসিডিএসি বলছে, বাংলাদেশের দেওয়া ইয়াবা কারখানার নামের তালিকা হাস্যকর।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেখানে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পর গত দুই বছরে উভয় পক্ষের মধ্যে যোগাযোগের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এখন মিয়ানমারের সিসিডিএসি বাংলাদেশের ডিএনসির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছে। সামনে মিয়ানমারের সঙ্গে তৃতীয় দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

জানতে চাইলে ডিএনসির বিদায়ী মহাপরিচালক খন্দকার রাকিবুর রহমান ইয়াবা কারখানা বন্ধের ব্যাপারে পদক্ষেপ ও মিয়ানমারের কর্মকাণ্ড নিয়ে মন্তব্য করেননি। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবারের মিটিংয়ের আলোচ্যসূচি এখনো ঠিক হয়নি। কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে সেটা তখনই জানা যাবে। তবে আমরা বলতে পারি, এখন মিয়ানমারের সহায়তা পাচ্ছি। ’

সূত্র জানায়, সব ধরনের মাদকদ্রব্য প্রবেশ বন্ধ ও চোরাচালান ঠেকাতে ১৯৯৪ সালের ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি সই হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, উভয় পক্ষ মাদকদ্রব্যসংক্রান্ত তথ্য বিনিময়, মাদকসংক্রান্ত আইন-বিধি সম্পর্কে পরস্পরকে অবহিত করা, মাদক পাচার রোধ, মাদক থেকে অর্জিত অর্থের পাচার প্রতিরোধ, অর্থপাচার শনাক্ত, মাদক থেকে অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে দ্রুত পারস্পরিক যোগাযোগ ও মাদক ব্যবসায়ীদের প্রোফাইল বিনিময় করবে। এরপর ইয়াবার কারবার শুরু হলে চোরাচালান ঠেকাতে ও চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ মিয়ানমারকে বিভিন্ন সময় তাগাদা দিতে থাকে। কিন্তু মিয়ানমার তেমন আগ্রহ দেখায়নি। পরে ২০১১ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে দুই দেশ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে বৈঠক করে। ওই বৈঠকে মিয়ানমারকে তাদের সীমান্তে ইয়াবা কারখানার ব্যাপারে ধারণা দেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। সে সময় অভিযোগ আমলেই নেয়নি মিয়ানমার। তবে বৈঠকে বলা হয়, এর পর থেকে উভয় পক্ষ নিয়মিত মাদক নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার রোধে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসবে। পরে ঢাকায় বৈঠকটি আয়োজনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও মিয়ানমারের সাড়া মেলেনি। এরই মধ্যে ২০১৩ সালে ৪৩টি ইয়াবা কারখানার তালিকা পাঠানো হয় মিয়ানমারের কাছে। ২০১৪ সালের হালনাগাদ তালিকায় দেখা যায় তখনো ৩৭টি কারখানার অস্তিত্ব আছে। সেগুলো বন্ধে কয়েকবার চিঠি দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয় মিয়ানমারকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মিয়ানমারের সিসিডিএসি সম্মত হওয়ায় দ্বিতীয় বৈঠকটি হয় ২০১৫ সালের ৫ ও ৬ মে ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে। বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে ইয়াবার ৪৫টি কারখানা ও নেপথ্যের কারিগরদের নামের তালিকা দেওয়া হয়। তবে এবারও মিয়ানমার প্রতিনিধিরা ইয়াবা কারখানার অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করে। বৈঠকের শেষ দিন যৌথ স্মারক স্বাক্ষর এবং সংবাদ সম্মেলন করে যৌথ বিবৃতি দেওয়ার কথা ছিল। তবে সিসিডিএনসি প্রতিনিধিরা স্মারকেও সই দেননি, সংবাদমাধ্যমের সামনেও হাজির হননি।

সম্প্রতি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএনসির এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তাঁরা (মিয়ানমারের প্রতিনিধি) আমাদের বলেছেন, কারখানার নামের তালিকাটা পিকুলিয়ার (হাস্যকর)। ওই নামে কিছু পাওয়া যায়নি। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় বর্মী নামগুলো আমরা ইংরেজিতে বলায় কিছু এদিক-সেদিক হতে পারে। আমরা আবার সেদিকটা দেখছি। আশার কথা হচ্ছে, তারা এখন আমাদের জবাব দিচ্ছে, চিঠি দিচ্ছে। ’

ডিএনসির আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘ওই তালিকা করা হয়েছিল গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য থেকে। তালিকা দেওয়ার পর মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপিসহ বিভিন্ন দপ্তর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। ২০১৫ সালের ১৭ জুন টেকনাফের সীমান্ত থেকে বিজিবির নায়েক রাজ্জাককে তুলে নিয়েছিল বিজিপি। এটি ইয়াবার বিরুদ্ধে কার্যক্রমের একটি জবাব বলে সন্দেহ করছেন অনেকে। এসব কারণে মিয়ানমারকে কোনো চাপ না দিয়ে তাদের বুঝিয়ে সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে। মিয়ানমার মাইন্ড করতে পারে ভেবে ইয়াবা কারখানার ব্যাপারে সাংবাদিকরা তথ্য চাইলেও তা দিচ্ছে না ডিএনসি। এমনকি আলোচনার ব্যাপারেও আমরা আপনাদের তথ্য দিচ্ছি না। ’

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দুই বছর ধরে ইয়াবা কারখানা বন্ধ করাসহ সার্বিক বিষয়ে সহায়তা চেয়ে মিয়ানমারকে নিয়মিত চিঠি দিচ্ছে বাংলাদেশ। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর মিয়ানমারের সিসিডিএসি বাংলাদেশের ডিএনসিকে তৃতীয় দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়ে চিঠি পাঠায়। এর জবাবে ২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চিঠি দিয়ে সম্ভাব্য তারিখ জানায়। পরে আলোচনার মাধ্যমে ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য হয়। তবে শেষ মুহূর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আপত্তির কারণে ওই সময় বৈঠক স্থগিত করা হয়। শিগগির এ বৈঠক হতে পারে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সমালোচনা হচ্ছে : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইউএনওডিসির দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে মাদকের বড় সমস্যা হিসেবে মিয়ানমারের ইয়াবা রুট বিভিন্ন সময় আলোচনায় উঠে আসে। সেখানে সীমান্ত থেকে কিভাবে ইয়াবা বাংলাদেশে ঢুকছে তা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। মিয়ানমারের ইয়াবার উৎপাদন বন্ধ করতে সেখানকার ওয়া ও শান রাজ্যসহ কিছু এলাকায় কারবারিদের বিকল্প পেশা তৈরির ব্যাপারেও বলা হয়। তবে মিয়ানমারের সিসিডিএসিসহ অন্যান্য বিভাগ এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। বিমসটেকের বৈঠকেও মিয়ানমারের ইয়াবা নিয়ে আলোচনা হয়। গত বছরের ১২ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর ইয়াঙ্গুনে বিমসটেক সম্মেলন হয়। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের ইয়াবা পাচারের বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়। ইউএনওডিসির গ্লোবাল স্টার্ট রিপোর্টে বাংলাদেশ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশকে বড় ধরনের ঝুঁকিতে ফেলেছে ইয়াবা। দ্য চ্যালেঞ্জ অফ সিনথেটিক ড্রাগস ইন ইস্ট অ্যান্ড সাইথ ইস্ট এশিয়া অ্যান্ড ওশেনিয়া-২০১৫ রিপোর্টে মিয়ানমারকে মেথামফেটামিন মাদক তৈরির প্রধান দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মিসইউজ অব প্রেসক্রিপশন ড্রাগস মেজর প্রবলেম ইন সাউথ এশিয়া নামের রিপোর্টে বলা হয়, ইয়াবার পাচার বাংলাদেশের জন্য বড় সংকট হয়ে এসেছে।

ডিএনসির পরিচালক (অপারেশনস ও গোয়েন্দা) সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সীমান্ত এলাকা থেকেই ইয়াবা আসছে। এসব বিষয়ে আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করছি। এখন মিয়ানমারের সহায়তাও পাওয়া যাচ্ছে। আশা করছি, সেখান থেকে ইয়াবার সরবরাহ বন্ধ করা হবে। ’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/03/08/471877