৮ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১২:৩২

জাতিসংঘ ফোরামে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিটিতে জানিয়েছেন, সরকার কার্যকর বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অনেক কমিয়ে এনেছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি ২০১৪-১৫ সালে র্যা বের হাতে নিহতের সংখ্যা ২৫ উল্লেখ করে বলেছেন যে ২০০৫-০৬ সালে সংখ্যাটি ছিল ২৬১ জন।

গত সোমবার জেনেভায় ইন্টারন্যাশনাল কভনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের (আইসিসিপি) সভায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম এবং আটকাবস্থায় নির্যাতনের প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী তাঁর সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো তুলে ধরতে গিয়ে এসব তথ্য জানান। এই সম্মেলনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

২০০৯ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত গত সাত বছরে বাংলাদেশ সরকার নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারসমূহ বাস্তবায়নে কী কী আইনি এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিয়েছে আইনমন্ত্রী তার বিবরণ দেন। সোম ও মঙ্গলবার উন্মুক্ত অধিবেশনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এই পর্যালোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ২২ মার্চ কমিটি রুদ্ধদ্বার অধিবেশনে বাংলাদেশ বিষয়ে তার পর্যালোচনা চূড়ান্ত করবে।

বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কমে যাওয়া প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রীর দাবির সঙ্গে মানবাধিকার সংগঠনের পরিসংখ্যান মিলছে না। জাতিসংঘ কমিটিতে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে পেশ করা স্মারকে ২০১৩ সালের মে মাস থেকে ২০১৬-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত র্যা বের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা ১৫৯ এবং পুলিশের হাতে ৪৪৬সহ বিভিন্ন বাহিনীর হাতে মোট ৭২৭ জনের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে।

একই সময়ে ২৩২ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর গুমের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৩৪ জনকে পাওয়া গেছে মৃত অবস্থায়, দীর্ঘ সময় নিখোঁজ থাকার পর ১৩৭ জনকে পাওয়া গেছে পুলিশের জিম্মায় এবং ৬১ জনের এখনো খোঁজ মেলেনি।

আইসিসিপি হচ্ছে ব্যক্তির জীবনধারণ, ধর্মপালন, মতপ্রকাশ, সংগঠন ও নির্বাচনী অধিকারগুলোর মতো মৌলিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ, যা ১৯৬৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অনুমোদিত হয় এবং ১৯৭৬ সাল থেকে তা কার্যকর হয়। বাংলাদেশ সনদটি অনুস্বাক্ষর করে ২০০০ সালে। সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকে প্রতি চার বছরে একবার নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলো সুরক্ষার বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে প্রতিবেদন পেশ করতে হয়। সেই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আইসিসিপির একটি কমিটি, যা জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিটি নামে পরিচিত। ১৮ জন বিশেষজ্ঞের ওই কমিটি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সুপারিশ করতে পারে।

আইসিসিপিতে বাংলাদেশ প্রতিবেদন পেশ করে ২০১৫ সালের ১৯ জুন। ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে কমিটি গত মে মাসে সরকারের কাছে ২৫টি প্রশ্ন রাখে। ১৯ ফেব্রুয়ারি সরকার লিখিতভাবে সেগুলোর জবাব দিয়েছে। এরপর সোমবার আইনমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জবাবদিহি, জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হামলার বিচার, নারী-পুরুষের সমতা, সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিকার, বাল্যবিবাহ নিরোধসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপের উল্লেখ করেন।

কমিটির কাছে আলাদাভাবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (জামাকন) একটি লিখিত প্রতিবেদন পেশ করে। একইভাবে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষে একটি প্রতিবেদন পেশ করে ১৯টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ মানবাধিকার ফোরাম, যার নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল। বাংলাদেশের ‘অধিকার’সহ ছয়টি বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সংগঠন যৌথভাবে আরেকটি প্রতিবেদন পেশ করে। তবে এসব প্রতিবেদনে উদ্ধৃত পরিসংখ্যানগুলোয় ভিন্নতা দেখা গেছে।

বাংলাদেশ মানবাধিকার ফোরামের প্রতিবেদনে ২০১৫ সালের প্রথম নয় মাসে কারাগারে ৫২ জনের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে বলা হয়, নিহত ব্যক্তিদের ৩১ জনই ছিলেন বিচারাধীন মামলার আসামি। বৈদেশিক অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়ার উল্লেখ করে মানবাধিকার ফোরাম বেসরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে পুলিশ সদর দপ্তর ২০১৫ সালের ২ আগস্ট এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অধিকার এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের যে অভিযোগ আনে সে বিষয়টি ফোরাম আইসিসিপিকে জানিয়েছে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদনে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা, ভিন্নমত প্রকাশের জন্য ব্লগার হত্যা, নারী-পুরুষের সম-অধিকার নিশ্চিত করার প্রশ্নে উত্তরাধিকার আইন সংস্কারে অনীহা, শ্রম অধিকার এবং ইউনিয়ন করার অধিকারের বিষয়ে বাধা এবং শ্রমিক আন্দোলন দমনে-নিপীড়নমূলক পদক্ষেপগুলোর বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।

তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন পুনরুজ্জীবনের পর এখন তাঁর সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একজন দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে সব বাধ্যবাধকতা পূরণে নজর দিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রশ্নে তিনি বলেন, বাংলাদেশ কখনোই প্রকৃত কোনো শরণার্থীকে ফিরিয়ে দেয়নি। ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের জন্য নতুন আবাসনের ব্যবস্থা বিষয়ে তিনি বলেন, সেখানে সব ধরনের নাগরিক সুবিধা—শিক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পরই সেখানে তাদের স্থানান্তর করা হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে তিন লাখ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছে। সমকামীদের অধিকার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সমাজ এখনো অতটা উদার হওয়ার জন্য তৈরি নয়। কোনো ধর্মই এটি সমর্থন করে না এবং জনগণের ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখানো সরকারের দায়িত্ব বলে এখনই এ নিয়ে বড় ধরনের সংস্কার সম্ভব নয়।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে উদার দেশগুলোর অন্যতম। এই দাবির সমর্থনে তিনি দেশে কতগুলো সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় এবং কতগুলো টেলিভিশন চ্যানেল চালু আছে তার বর্ণনা দেন। ধর্মনিরপেক্ষ লেখক, প্রকাশক এবং অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের (ব্লগার) ওপর হামলার বিষয়কে দুঃখজনক অভিহিত করে তিনি এগুলোর জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দায়ী করেন। সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যেই এসব ঘটনা ঘটেছে। বিদেশিদের ওপর হামলা তার সাক্ষ্য বহন করে।

তবে বৈশ্বিক মানবাধিকার আন্দোলন সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জাতিসংঘ কমিটির কাছে পেশ করা বক্তব্যে বলেছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার মতপ্রকাশ এবং সংগঠনের স্বাধীনতা আশঙ্কাজনকভাবে সংকুচিত করেছে। এসব অধিকার ক্ষুণ্ন করে এমন অনেকগুলো আইন করা হয়েছে উল্লেখ করে অ্যামনেস্টি তথ্যপ্রযুক্তি বা আইসিটি আইন ২০০৬, বিশেষ করে ৫৭ ধারায় বিভিন্ন মামলার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের বাইরে বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে হুমকির কারণে গণমাধ্যমে স্বনিয়ন্ত্রণ বা সেলফ সেন্সরশিপের ব্যাপকতা বাড়ছে। ২০১৩ সালের পর থেকে অনেক সংবাদকর্মীর বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপরাধের সাজানো মামলা দায়েরের মাধ্যমে অন্যদের ভয় দেখানোর কৌশল অনুসৃত হয়েছে বলে দাবি করে অ্যামনেস্টি শফিক রেহমান ও সিদ্দিকুর রহমান খানের বিরুদ্ধে মামলাগুলোর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছে। অ্যামনেস্টি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী আইনগুলো বাতিল এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহারেরও আহ্বান জানিয়েছে।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1101238