৮ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১২:১৪

তিন বছরের প্রকল্প বাস্তবায়নে ১৩ বছর

এক বিদ্যুৎ কেন্দ্রেই অপচয় ৬৬১ কোটি টাকা

মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর পর প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ

সিলেটে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সময়কাল ছিল তিন বছর। কিন্তু তা শেষ করতে লেগেছে ১৩ বছর। এর ফলে যেমন ১০ বছর সময় বেশি লেগেছে, তেমনি খরচ বেড়েছে ৬৬১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। উদ্বেগজনক তথ্যটি উঠে এসেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, অবশ্যই অতিরিক্ত ব্যয় করাটা অপচয়। জনগণের করের টাকার বেহিসাবি ব্যয়ের উদাহরণ। এটা প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় ভালো ইঙ্গিত দেয় না। বিষয়টি খতিয়ে দেখে সংশ্লিষ্টদের অবহেলা ও গাফিলতি পেলে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায় বেশি। তাই মন্ত্রণালয়ের কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

জানা যায়, বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও প্রয়োজনীয় সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সিলেটে ১৫০ মেগাওয়াটের একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয় ২০০১ সালে। যা ২০০১-০২ অর্থবছর থেকে ২০০৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। ৩৪২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিল বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করায় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এভাবে বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত ব্যয় করে প্রকল্পটির কাজ শেষ হয় ২০১৪ সালের জুনে।

এদিকে গত বছরের ৭ জানুয়ারি সমাপ্ত প্রকল্পটি পরিদর্শন করেন আইএমইডির পরিচালক বেগম নাসিমা মহসিন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মঙ্গলবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, মূল প্রকল্পে ২০২ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণের সংস্থান ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৈদেশিক সহায়তা পাওয়া যায়নি। পরে প্রকল্পটি বায়ার্স ক্রেডিট বা সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিটে বাস্তবায়নের উদ্যোগে নেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রকল্পটি সংশোধন করে ৪০৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। ২০০৪ সালের ৭ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সংশোধনী অনুমোদন দেয়া হয় প্রকল্পটির। এ ক্ষেত্রে বায়ার্স ক্রেডিট পেতে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি পরিদর্শন ও প্রকল্প সমাপ্তি প্রতিবেদন (পিসিআর) মূল্যায়ন করে যা পেয়েছি তাই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি। এখানে মিথ্যা বা ভুল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, টার্ন কি অংশের জন্য পাঁচবার আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। সর্বশেষ পঞ্চমবার দরপত্র মূল্যায়ন করে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি দরপত্র অনুমোদন করে। এর

ভিত্তিতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন করা হলে প্রকল্পে ব্যয় বেড়ে ৮৭৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকা দাঁড়ায়। ২০১০ সালের ২০ এপ্রিল একনেকে দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়।

অতিরিক্ত সময় ও ব্যয়ের জন্য প্রতিবেদনে চারটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হল : বৈদেশিক অর্থায়নে অনিশ্চয়তা, দরপত্র আহ্বানে জটিলতা, প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে বিলম্ব ও মামলা হওয়া। আইএমইডি বলেছে, এসব কারণে প্রকল্পটিতে ৩৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ সময় বেশি লেগেছে। আর ১৯৩ দশমিক ২৭ শতাংশ ব্যয় হয়েছে বেশি। এ অবস্থায় সময়মতো প্রকল্পের সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েছে সুবিধাভোগী সাধারণ মানুষ।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, প্রথমত. অহেতুক প্রকল্পটির মেয়াদ বেড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত যে ৬৬১ কোটি টাকা খরচ হয়েছে তা একরকম জলে গেছে। বিপরীতে বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত এই টাকা খরচ করে জনগণ কিন্তু বাড়তি কোনো সুবিধা পায়নি। বরং প্রকল্প সময়মতো শেষ করা হলে সাধারণ মানুষ যেমন আগে বেশি বিদ্যুৎ পেত তেমনি খরচও কম হতো। তিনি বলেন, তাই সবার আগে যথাসময়ে প্রকল্প শেষ করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে; না হলে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পে কখনও গতি আনা যাবে না।

গুরুতর একটি অনিয়মের মধ্যে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি ২০০১ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২০০৪ সালের জুনে শেষ হবে বলে একনেক অনুমোদন দেয়। অথচ প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয় মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২০০৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর। শুধু তাই নয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে একটি রিট পিটিশন দাখিল করা হয়। এর ফলে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ঠিকাদারকে কোনো অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি। এ কারণে দীর্ঘদিন প্রকল্পের কাজ থেমে থাকে। এভাবে প্রকল্পের অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধি পায়।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/03/08/107084