সালমা খাতুন দেশের প্রথম নারী রেলচালক। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ রেলওয়েতে যোগ দেন। লাবণ্য নামে ৪ বছরের এক মেয়ের মা তিনি :নাসিম সিকদার
৮ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১২:১১

বাড়ছে নারীর পদচারণা বিপরীত চিত্রও ভয়ঙ্কর

দেশে বাড়ছে নারীর পদচারণা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অবস্থান ও অগ্রগতি প্রশংসনীয়। জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরাম থেকে স্বীকৃতি মিলছে বাংলাদেশের নারীর কৃতিত্বের। নারী-পুরুষ সমতা সম্পর্কিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় পরপর দু’বার শীর্ষে অবস্থান করছে। শিক্ষায় নারীর অগ্রগতিতে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম স্থানে ছিল। প্রাথমিকে ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বালিকা। প্রাথমিকে শিক্ষকদের মধ্যেও ৫৭ শতাংশ নারী। সর্বশেষ এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় পাসের হারে এগিয়ে মেয়েরা। দেশের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের খাত তথা গার্মেন্ট শিল্পে ৭০ শতাংশেরও বেশি শ্রমিক নারী। আবার একই সাথে নারীদের বিপরীত চিত্রও ভয়ঙ্কর। হত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন তথা নারীর প্রতি নিষ্ঠুরতা আর নির্মমতা রেকর্ড ভাঙছে দিন দিন। যৌতুকের জন্য এখনো পুড়িয়ে মারা হচ্ছে নারীদের। কন্যা হয়ে জন্মানোর দায়ে মুখে বিষ ঢেলে হত্যা করা হচ্ছে অবুঝ শিশুকে। কন্যা প্রসবের দায়ে এখনো কপাল পুড়ছে অসংখ্য নারীর। এসবের কারণ বদলায়নি নারীর প্রতি মানসিকতা।

বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে ২০১৫ সালে ২১ হাজার ২২০টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ২০১০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার ৭৫২টি।

নারী ও পুরুষ উভয়ে মানুষ কিন্তু বিশ্বে নারীদের জন্য আলাদা করে একটি দিবস পালনের মধ্যেই যেন নিহিত রয়েছে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে নারীদের অবস্থান এবং চিত্র। আজ বুধবার সেই বিশ্ব নারী দিবস। অনেকে নারীদের জন্য আলাদা করে দিবস পালনকেও নারীর জন্য অমর্যাদা হিসেবে দেখে থাকেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি হলেও আজো নারী নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। দুর্ভাগ্যজনক হলো অনেক সময় নারী নিজ পরিমণ্ডলে মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারীদেরই হাতে। প্রায় ক্ষেত্রে নারী সংসারের জন্য সবটুকু উজাড় করে দিয়েও পান না প্রাপ্য সম্মান এবং অধিকার। ঘরে-বাইরে দিন-রাত খেটেও নারী এখনো অনেক ক্ষেত্রে যেন দাসী। প্রতিনিয়ত ভুগছেন নিদারুণ মর্মজ্বালায়।

মাঝখানে অল্প কিছু সময় বিরতি ছাড়া ২৭ বছর ধরে দেশের ক্ষমতা পরিচালনা করেছেন দুইজন নারী। দীর্ঘ এই সময়ে সংসদে বিরোধী দলের নেতাও ছিলেন নারী। বর্তমানে দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, স্পিকার নারী। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে একজন নারী বিচারপতি ছাড়াও সরকারের অনেক উচ্চ পদে রয়েছেন নারী। দীর্ঘকাল ধরে দেশ শাসনে নারীর এ অবস্থান বৃহত্তর ক্ষেত্রে নারীর মনোবল বাড়িয়েছে নিঃসন্দেহে কিন্তু তবু নারী এখনো মুক্তি পাননি দাসত্বের নিগড় থেকে।

বাংলাদেশে নারীর বিস্ময়কর অগ্রগতি : ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) প্রতিবেদনে নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠায় ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে পরপর দু’বার বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষস্থান অধিকার করে। ২০১৫ সালে ১৪৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৬৪তম এবং ২০১৬ সালে ৭২তম। ২০১৬ সালে ১৪৪টি দেশের মধ্যে এ তালিকায় ভারত ৮৭তম, পাকিস্তান ১৪৩তম, শ্রীলঙ্কা ১০০তম, নেপাল ১১০তম, ভুটান ১২১তম এবং মালদ্বীপ ১১৫তম স্থানে ছিল।
২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। অপর দিকে ২০১৫ সালের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল নবম। নারীর ক্ষমতায়নে অষ্টম। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অগ্রগতিতে বাংলাদেশের অবস্থান হয় বিশ্বে প্রথম।

ডব্লিউইএফ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারীর গড় আয়ুও পুরুষের চেয়ে বেশি।

শিক্ষায় নারীর জয়জয়কার : শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ৫৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী বালিকা। ৪৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ বালক। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৫৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বালিকা। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বালিকা শিক্ষার্থী শতকরা ৪৯ দশমিক শূন্য সাত ভাগ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীর হার শতকরা ৩৬ দশমিক ৮০ এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই হার শতকরা ২৭ দশমিক ৭২ ভাগ (মে ২০১৬ নাগাদ)।

অপর দিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি প্রাইমারি স্কুলের মহিলা শিক্ষক ৫৭ দশমিক আট ভাগ আর পুরুষ শিক্ষক ৪২ দশমিক ২ ভাগ। (সেপ্টেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত)। তবে বর্তমানে প্রাইমারি স্কুলে নারী শিক্ষকের হার ৬০ শতাংশে পৌঁছেছে।

প্রায় প্রতি বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছেন ছেলেদের তুলনায়।
২০১৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় দশটি বোর্ডে পাস করে ১৪ লাখ ৫২ হাজার ৬০৫ জন শিক্ষার্থী। ছেলেদের পাসের হার ৮৮ দশমিক ২০ শতাংশ এবং মেয়েদের ৮৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এক লাখ ৯ হাজার ৭৬১ জন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পায়। এর মধ্যে ছেলে ৫৭ হাজার ৭২৭ জন এবং মেয়ে ৫২ হাজার ৩৪ জন।

২০১৬ সালের এইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ৮ লাখ ৯৯ হাজার ১৫০ জন। ছেলেদের পাসের হার ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর মেয়েদের পাসের হার ৭৫ দশমিক ৬০ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছেন ৫৮ হাজার ২৭৬ জন। এর মধ্যে ছাত্র ৩২ হাজার ৩৮১ জন, ছাত্রী ২৫ হাজার ৮৯৫ জন।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রাথমিক পর্যায়ে বর্তমানে ভর্তির হার শতকরা ৯১ ভাগ। মেয়েশিশুদের ক্ষেত্রে ৯৪ দশমিক ৭ শতাংশ ভর্তি হয়। আর ছেলেশিশুর ভর্তির হার ৮৭ দশমিক ৮ শতাংশ।

গার্মেন্টসহ সার্বিক খাতে নারীর অবদান : বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় তৈরী পোশাক খাত থেকে। এ খাতে রয়েছে ৩৫ লাখের বেশি শ্রমিক। এর মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি নারী। তবে বাংলাদেশ নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠায় অনেক এগিয়ে থাকলেও নারী-পুরুষ মজুরিবৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

বাংলাদেশে কৃষি ক্ষেত্রে নারীর অবদান ৫৩ শতাংশ। এখানেও নারী নানাভাবে বৈষম্যের শিকার।

সরকারি একটি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৬২ শতাংশ নারী আয়বর্ধক কাজে জড়িত। দক্ষিণ এশিয়ায় এই হার সর্বোচ্চ। ৫০ শতাংশ উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে এই হার বেশি।

নারীদের বিপরীত চিত্র : বাংলাদেশের মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া নারী ও শিশু ধর্ষণ, হত্যা, নারীর প্রতি সহিংসতা, নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা গত কয়েক বছর ধরে রয়েছে অন্যতম আলোচনার বিষয় হিসেবে। বাংলাদেশে স্থানীয় প্রশাসন, মেম্বার, চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সংসদে রয়েছে নারীদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ। কিন্তু তারপরও এ সমাজে নারীদের আরেকটি দিক রয়েছে যা শিউরে ওঠার মতো। জনপ্রতিনিধি হয়েও অনেক সময় নারীরা রক্ষা পাচ্ছেন না। নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন পুরুষ প্রতিনিধির হাতে।

কয়েক বছর আগে ইভটিজিংয়ের কারণে কিশোরী-তরুণীদের আত্মহনন উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যায়। প্রেম ও বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে এসিডে ঝলসে দেয়ার পর এখন চলছে কুপিয়ে হত্যা, আহত করা এবং কখনো কখনো দল বেঁধে ধর্ষণ। এখনো যৌতুকসহ বিভিন্ন কারণে নারীকে পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে। গাছে বেঁধে সবার সামনে পেটানো হচ্ছে নারীদের। বখাটেদের হাতে একের পর এক ঘটছে স্কুল-কলেজের ছাত্রীহত্যা। এখনো সন্ত্রাসীদের ভয়ে পড়ালেখা বন্ধ করে ঘরে আবদ্ধ থাকতে হচ্ছে নারীকে। এখনো পাচারের শিকার হচ্ছে নারী ও শিশুÑ যা রীতিমতো উদ্বেজনক।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ৩২৫টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৪৮ জন শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। ১৫ জন শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
২০১৫ সালে ৫২১ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যাদের মধ্যে ৯৯ শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়, ৩০ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় এবং ৪ জন শিশু ধর্ষণের অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। ২০১৪ সালে ৬৬৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪০১ জন।

অপর একটি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী গত বছর বাংলাদেশে এক হাজার ৫০ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হন। এর মধ্যে ৪১৫টি শিশু।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সালে ৭২৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। এর মধ্যে ধর্ষণের পর ৩৭ জনকে হত্যা করা হয় এবং ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেন আটজন। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৩৯ জন নারী।

গত বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মস্থলে যৌন নির্যাতন ও বখাটের উত্ত্যক্তের শিকার হন ২৪৪ জন। এর মধ্যে ছয়জন নারী আত্মহত্যা করেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় খুন হন সাতজন নারী। বখাটেদের প্রতিবাদ করায় লাঞ্ছিত হয়েছেন ১৩৮ জন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/201798