৮ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১১:৪৯

প্রশ্নফাঁসের ফাঁস

আমিরুল আলম খান

পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস যেন গোটা জাতির ‘ফাঁসি’তে রূপ নিয়েছে। দেশজুড়ে এখন প্রশ্নফাঁস নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। সাধারণ মানুষ থেকে পণ্ডিতকুল-শিরোমণিরা তো বটেই, বিদেশী কন্সালট্যান্টদেরও ঘুম ‘হারাম’। এ সর্বগ্রাসী রোগের বিস্তার রোধে রাষ্ট্রের তামাম যন্ত্র জোট বেঁধেও বিহিত করতে না পেরে পেরেশান।

প্রশ্নফাঁস ‘স্রেফ গুজব’ বলে যারা এতকাল তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন, তারাও কবুল করছেন- সত্যিই প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। তাও প্রাথমিক সমাপনী থেকে কর্ম কমিশন পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে। স্বীকারোক্তি নাকি শাসকদের সততার স্বীকৃতি; হবেও বা।

দুনিয়ায় এমন দেশ নেই, যে দেশে লেখাপড়ার মান বিচারে পরীক্ষা নেয়া হয় না। পরীক্ষা যখন শেখা ওজনের দাঁড়িপাল্লা, তখন সব দেশে, সব কালে প্রশ্ন করে পরীক্ষা নেয়াই রেওয়াজ। তামাম দুনিয়ায় যিনি পড়ান, তিনিই প্রশ্ন করেন, তিনিই মান নির্ণায়ক মার্ক দেন। তাতে কারো আস্থার সঙ্কট দেখা দেয় না। তবে বাঙাল মুলুকে সে চর্চা অচল প্রমাণিত বহু আগেই। এমন অনাচার বোধকরি কোনো দেশে কোনো কালে হয়নি যে, ওস্তাদজী নিজেই প্রশ্ন ফাঁস করেন বা বেশি নম্বর দিয়ে নিজের শিষ্যের সর্বনাশ ঘটান।

বাঙাল মুলুকে কবে এ অনাসৃষ্টির শুরু, বা কে তার গুরু, তা এ অধমের অজানা। তবে পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে স্বজনকে ‘ফার্স্ট’ বানানোর সর্বনাশা অপকর্মের গুরু নাকি বঙ্গদেশে ‘আধুনিক শিক্ষার পীঠস্থান’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের ডাকসাইটে উপাচার্য শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। কলকাতার বিখ্যাত পাক্ষিক ‘দেশ’ সে গোমর ফাঁস করে দিয়েছিল। তাতে উপাচার্যজী লজ্জা না পেলেও যাকে ‘ফার্স্ট’ বানানো হয়েছিল, সেই তরুণ নাকি লজ্জায় মুখ লুকিয়েছিলেন। সে কালে তবু লজ্জা-শরম ছিল, এ কালে যে তা উধাও!

সেই থেকেই শুরু হোক বা না হোক, আমরা বিদ্যা নিয়ে যে কেরামতি দেখিয়েছি, তার জুড়ি দুনিয়ায় হয়তো নেই। শুরুটা আমরা করেছি সেই ১৯৭২ থেকে। তখন অবশ্য প্রশ্ন ফাঁস করতে হতো না, পরীক্ষার হলেই সবাই বই খুলে লিখে ডিগ্রি পেত। কোনো এক ‘অর্বাচীন’ উপাচার্য এতে বাদ সাধায় তার নকরি শেষ হতে কালবিলম্ব হয়নি। শতেকজনে মাত্র সাতজন হারে পাস করানোর ‘পাপে’ তার নকরি খতম হয়ে যায়।

সে ভুল বাঙালি অচিরেই শুধরে নিয়েছিল। প্রাজ্ঞ ও সর্বজনমান্য সে উপাচার্যের নকরি খাওয়া ছিল সবার জন্য এক চরম বার্তা। পরে আর কেউ এমন ‘সর্বনেশে কাণ্ড’ করার হিম্মত দেখাননি। ‘আকেলমান্দকে লিয়ে ইশারাই কাফি’। সেকালে এক নবীন কবি লিখেছিলেন, ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’। সে পাপ যেন শেষ হওয়ার নয়।

যারাই এ প্রশ্নফাঁসের অপকর্ম করুক, সে অপরাধের গুরুদণ্ড ১৯৮০ সালের পরীক্ষা আইনে লেখা আছে। কাজেই অপরাধী ধরা পড়লে, তার শাস্তিবিধান তেমন কঠিন কিছু নয়। কিন্তু আমাদের কানুন আর রেওয়াজে ফারাক বহুত। প্রশ্নফাঁসের ‘গুজব’ ছড়ালে আরো কঠিন শাস্তির হুমকি আছে হুকুমতের। তবে সে ভয়ে ভীত না হয়ে দেশের খবরের কাগজগুলো হামেশা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ছেপেই যাচ্ছিল। এর চেয়ে বেশি সচল ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম’। আর কী আশ্চর্য, পরীক্ষার হলে দেয়া প্রশ্নের সাথে তা বেশ মিলেও যাচ্ছিল।

প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে কি হচ্ছে না, তা নিয়ে তরজা জারি আছে প্রায় হাফ দশক ধরে। কেউ কেউ চ্যালেঞ্জ করে চিৎকার করছিলেন, প্রশ্নফাঁসের সব আলামত ও প্রমাণ তাদের হাতে মজুদ আছে। কর্তারা তা মানছিলেন না। এখন মনে হচ্ছে, তার একটা হিল্লে হলো। কর্তারা কবুল করছেন, ‘হ্যাঁ, প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে।’ সেখানেই শেষ নয়, যারা প্রশ্ন ফাঁস করে তাদেরও নাকি তারা চেনেন এবং ধরেও ফেলেছেন। তবে বাঙালি ১৯৭১ ছাড়া আর কখনো কোনো বিষয়ে একমত হয়েছে, এমন নজির ইতিহাস ও ইতিকথায় নেই। তাই কারো আঙুল ওস্তাদজীদের দিকে, কারো বা বিজি প্রেসে ও আবার কারো কোচিং সেন্টারের পানে। তবে যারা নোট-গাইড ছেপে দেশের ‘সৃজনশীল শিক্ষায় বিপ্লব’ ঘটিয়েছেন, তাদের দিকে কেউ আঙুল তুলেছেন কি না তা আমাদের অজানা। কেউ আবার তর্জনী তোলেন ‘শিক্ষিত বেকারের দিকে’। হতে পারে, সবাই সত্য বলছেন, তা আংশিক হলেও। তাতে কার সত্য পরিমাণে বেশি, সে গবেষণা এখনো শেষ হয়নি।

অর্থনীতির কিছু সংজ্ঞা বেশ জুৎসই মনে হয় আমার কাছে (প্রথমেই মাফ চাচ্ছি, জীবনে অর্থনীতির এক পাতাও না পড়ে এত বড় গলাবাজি করার দুঃসাহস দেখানোর জন্য)। ‘শুধু চাহিদা জোগানে জোয়ার আনে না, জোগানও চাহিদায় তুফান তোলে।’ তত্ত্বটি আমাদের দেশে বেশ খাপে খাপে মিলে গেছে। বাজারে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিক্রি হলে পরীক্ষার্থী, শিক্ষক, বাবা-মা, ভাই-বন্ধুরা তা কিনতে বাজারে হামলে পড়বেন, তা তো ওই কেতাবি তত্ত্বেই পাওয়া। কিন্তু তার চেয়ে সর্বনাশা তত্ত্ব লিখে গেছেন গ্রাসাম না কী যেন নামের এক সাহেব। তার তত্ত্ব আরো খাঁটি। ‘খারাপ ভালোকে তাড়িয়ে দেয়।’ তিনি অবশ্য বলেছিলেন, ‘ব্যাড মানি ড্রাইভস গুড মানি আউট অব সার্কুলেশন।’ আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি-অর্থনীতি, কূটনীতি তথা জীবনের তাবৎ কর্মে এ তত্ত্ব মোক্ষম বটে! বাংলাদেশ থেকে ‘সুবচন নির্বাসনে’ যাওয়ার অফিসিয়াল দলিল রচনা করে সেই সত্তরের দশকেই হুলস্থুল ফেলে দিয়েছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আব্দুল্লাহ আল মামুন। এখন শুধু সুবচন নয়, তামাম ‘সুকর্ম, সুচিন্তা’ও নির্বাসনে।

দুনিয়ার কোথাও প্রশ্নফাঁসের এমন নজির নেই। কেননা, সেখানে জ্ঞানসাধনা আর পাস করা এক বস্তু নয়। পড়ুয়াকে তারা স্রেফ পরীক্ষার্থীর পর্যায়ে নামিয়ে আনেনি। এ ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বরেকর্ড গড়েছি। ভারত, শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের কথা না-ই বা বললাম। নেপাল, ভুটানও আমাদের চেয়ে ঢের ভালো আছে।

আমরা এখন ধনী হওয়ার স্বপ্নে মশগুল। এ কালে ধনী হতে পুঁজি লাগে। আমরা নাকি পুঁজি সঞ্চয়ের আদি পর্বে আছি। শুনেছি, অর্থকড়ি বিষয়ে যার তত্ত্ব পুঁজিসঞ্চয়ীদের কাছে প্রায় বাইবেল, সেই অ্যাডাম স্মিথ নাকি ‘ফতোয়া’ দিয়ে গেছেন, ‘বড়লোক হতে হলে একটু-আধটু ফষ্টিনষ্টি (লুটপাট) করতেই হয়। ওটুকু না করবি তো, মরবি না খেয়ে।’ ওস্তাদজীর এমন নিদান থাকলে যারা টাকা আর বিদ্যার সমীকরণে দুটোকে সমান জ্ঞান করে, তারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করলে তাতে নাজায়েজের কী আছে? বিদ্যা নিয়ে কেউ স্কুল ও কেউ কোচিং সেন্টার খোলে। কেউ বা ‘সৃজনশীল নোট-গাইডের ব্যবসায়’ ফেঁদেছে। গোপনে নয়, দিনের আলোয় সবার চোখের সামনে দেশজুড়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে, বিলবোর্ড লাগিয়ে, পত্রিকা ছেপে (তাতে আবার বড় কর্তাদের বাণী রোশনাই ছড়ায়) ও লাইসেন্স নিয়ে (শিক্ষা বোর্ড, না জয়েন্ট স্টক কোম্পানির তা হয়তো পুলিশ জানে)। কেউ আবার তাদের বিজ্ঞাপন ছেপে টাকা কামাচ্ছে। কেউ সেখানে তশরিফ নিয়ে তাদের মান বাড়াচ্ছেন। এত আশীর্বাদ যাদের মস্তকে অহর্নিশ বর্ষিত হয়, তারা প্রশ্নফাঁসের ব্যবসায় করলে তা সহি হবে না কেন?

প্রশ্নফাঁস কোনো রোগ নয়, রোগের উপসর্গ। জ্বর হলে বুঝতে হবে দেহে কোথাও জীবাণু বাসা বেঁধেছে। সে জীবাণু অপসারণ না করে শুধু প্যারাসিটামলে যারা ব্যামো তাড়াতে চান তারা আর যা-ই হোক, বিজ্ঞান মানেন না। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কী করব? ব্যামো সারাব, আবার ব্যামোর কারণও নির্মূল করব? সেটাই উত্তম। চিকিৎসাশাস্ত্র বলে, ‘উপশম থেকে প্রতিষেধক উত্তম।’ আমাদের এই উত্তম পন্থা অনুসরণ করতে হবে।

তাহলে, প্রশ্নপত্র ‘কে ফাঁস করছে’, তার চেয়ে ‘কেন ফাঁস করছে’, সেটাই আসল তরজা। মুশকিল হলো, ‘কেন করে’ তার স্বরূপ উদঘাটন যেমন কঠিন, তার চেয়েও কঠিন তা নির্মূল করা। কিন্তু ‘কে করছে’ তা বের করা যেমন সহজ, তাকে বা তাদের গরাদে পুরে মরদের হাসি হাসা তার চেয়ে ঢের সহজ। আমরা সহজ পথটাই বেছে নিচ্ছি। তাতে নাকি পকেটও ভরে। তাহলে করণীয় কী? ‘কে করছে’, এর পেছনে ছোটা ভালো; কিন্তু ‘কেন করছে’ তার শিকড় আগে উপড়ানোই আসল কাজ।

এবারের উচ্চমাধ্যমিকে ‘ডিজিটাল পদ্ধতিতে’ সেন্টারে সেন্টারে প্রশ্ন ছেপে নাকি প্রশ্নফাঁস রোধের জবরদস্ত বন্দোবস্ত হচ্ছে! যারা প্রশ্নফাঁসের কিনার করতে এমন ধন্বন্তরি বাতলেছেন বা নসিহত করছেন, সেসব রাজপণ্ডিতের পাণ্ডিত্যে আমাদের আস্থার অভাব নেই। কিন্তু আড়াই হাজার সেন্টারে সকাল বেলায় ডিজিটাল মেসেজ পাঠিয়ে একেকটা ১০ পৃষ্ঠার প্রশ্ন ছেপে পরীক্ষা নেয়ার প্রাযুক্তিক সুবিধা, দক্ষতা ও সততা কোনোটাই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ নেই, এই নিরেট সত্যিটা তারা যদি মানেন, তবে বিজি প্রেসে প্রশ্ন ছেপেই পরীক্ষা নিতে হবে। তাহলে অন্তত পরীক্ষা নিতে পারবেন। অন্যথায় কী ঘটবে তা কল্পনা করাও নির্বুদ্ধিতা।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের পথ বাতলে দিয়েছেন ‘জুতা আবিষ্কারের’ গল্পটা বলে। মাটির পৃথিবীতে ধুলা থাকবেই। আর ধরণীতলে চরণ ফেললে পদযুগলে ধুলা লাগবেই। কিন্তু পণ্ডিত আর পারিষদকুলের মতলবি পরামর্শে ভিস্তিওয়ালা ডেকে পানির বান ডাকিয়ে, বা ঝাড়ুর ঝড় তুলে কিংবা পুরো ধরণী দামি চামড়ায় মুড়ে সমাধান মিলবে না। ‘মূর্খ’ চামারের পরামর্শ মতো, ‘চরণ দুটো ঢাকুন’। পড়ালেখায় ফাঁকিবাজি আগে বন্ধ করুন। তাহলে ‘ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে’।


লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাবেক চেয়ারম্যান, যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/201763