৭ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১৭

তলানিতে ঠেকেছে পাট রফতানি

লোকসানের বৃত্তে বিজেএমসি

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে রফতানিতে দাপটে অবস্থানে ছিল সোনালি আঁশ। সে সময় সোনালি আঁশের উপর নির্ভর করে এগিয়ে ছিল এ দেশের অর্থনীতি। কিন্তু সময়ের চক্রে সেই সোনালি আঁশ এখন আর স্বগৌরবে নেই, বরং তলানিতে ঠেকেছে সোনালি আঁশের রফতানির অবদান। ১৯৭৩ সালে মোট রফতানি আয়ের ৮৬ শতাংশ আসে পাট থেকে আর এখন আসছে ৫ শতাংশের মতো। এ খাত নিয়ে বর্তমান সরকারের মহৎ উদ্যোগের মধ্যেও সম্প্রতি বছরগুলোতে মোটা অংকের লোকসান গুনছে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বিজেএমজির অদক্ষতা ও কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কারণে এই খাতের ভরাডুবি হচ্ছে। এছাড়া এ খাত থেকে শুধু গতানুগতিক পণ্যই তৈরি করছে কর্তৃপক্ষ। পণ্য তৈরির ক্ষেত্রে কোনো বৈচিত্র্য নেই বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করে। এছাড়া বাংলাদেশের পাট পণ্যের বড় একটি অংশ ভারতে রফতানি হতো কিন্তু ওই দেশ চলতি বছরের শুরুতে পাটে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে। এতে সোনালি আঁশের রফতানি আয়ে ক্ষেত্রে বড় বাঁধা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে রফতানিকারকেরা বলেছেন, ভারতে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্কের কারণে চলতি অর্থবছর থেকেই রফতানি আয়ে সোনালি আঁশের অবদান আরো কমার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অর্থাৎ ১৯৭৩-৭৮ সময়কালে জিডিপিতে রফতানি আয়ের শুধু কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্যের অবদান ছিল যথাক্রমে ৩২ ও ৫৪ শতাংশ, যা একত্রে ৮৬ শতাংশ। ১৯৯০ সালে রফতানিতে পোশাক শিল্পের অবদান ৫০ শতাংশ অতিক্রম করে এবং পাট খাতের অবদান ২২ শতাংশে নেমে আসে। গত ৫ বছরে মোট রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশের উপরে পৌঁছেছে পোশাক শিল্পের অবদান। আর সোনালি আঁশের রফতানি আয় কমতে কমতে ৫ শতাংশে চলে এসেছে।

এদিকে বর্তমান সরকার পাট খাতের সাফল্যের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়েছে বিজেএমসিকে। কিন্তু গত এক দশকে শুধু ২০১০-১১ অর্থ-বছরে মাত্র ১৯ কোটি টাকা লাভ করে দেখাতে পেরেছে বিজেএমসি। এছাড়া প্রতি বছর ৬৬ থেকে সর্বোচ্চ ৭০০ কোটি টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনেছে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন। গত অর্থ-বছরেও প্রায় ৫০০ কোটি টাকা লোকসান করেছে বিজেএমসি। জানা গেছে, কয়েক দশক ধরেই লোকসানে থাকা বিজেএমসি ২০১১-১২ অর্থ-বছরে ৭৯ কোটি, ২০১২-১৩ অর্থ-বছরে ৩৮৫ কোটি এবং ২০১৩-১৪ অর্থ-বছরে ৪৫২ কোটি টাকা লোকসান করে। ২০১৪-১৫ অর্থ-বছরে বিজেএমসির লোকসানের অঙ্ক ৬৪০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে; যা আগের যে কোনো বছরের তুলনায় লোকসানের রেকর্ড।

সূত্র জানায়, সংস্থাটির ২৬টি প্রতিষ্ঠানে এখন ৮০ হাজারের বেশি শ্রমিক রয়েছেন। অথচ বেসরকারি খাতে এ ধরনের মিলগুলো চালাতে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। বর্তমানে ২৬টি মিলে বিজেএমসির প্রতি বছর গড়ে উৎপাদন হচ্ছে ১ লাখ ৮৭ হাজার টন পণ্য। বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পাটকল অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) সূত্রে জানা গেছে, বিজেএমএ ১৩১টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতি বছর গড়ে দুই লাখ টন পণ্য উৎপাদন করছে। আর এ পণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত রয়েছে মাত্র ৫২ হাজার শ্রমিক। ফলে লোকসান থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।

বেশি খরচ পড়া কারণ হিসেবে জানা যায়, কাঁচা পাট ক্রয়ে অদক্ষতা, উৎপাদনে সিস্টেম লস, বেশি খরচে পুরনো মেশিন পরিচালনা, কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি এবং বিপণন অদক্ষতায় ক্ষতি মিলে টন প্রতি সার্বিক খরচ ছাড়াচ্ছে ৫ হাজার টাকা। প্রায় ৪০ বছরের বেশি সময় থেকে একই ধরনের চটের বস্তা আর সুতা তৈরি করে চলেছে বিজেএমসি। পুরনো ডিজাইনের এসব পণ্যের চাহিদা না থাকায় বিক্রি হয় না। গুদামেই পড়ে থাকে। গুদামে পণ্য জমে থাকায় অনেক সময় দৈনিক উৎপাদন কমিয়ে দেয়া হয়। বেসরকারি পাটকলগুলোর অধিকাংশই পণ্য বৈচিত্র্যকরণ, আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, নিত্য-নতুন বিপণন কৌশল, ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটিয়ে শুধু স্থানীয় বাজারেই নয়, দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছে আন্তর্জাতিক বাজারেও। তবে সরকারি পাটকলে পণ্যে বহুমুখীকরণে নেই বলে অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক নাসিমা বেগম বলেছেন, এখন পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে বহুমুখীকরণের মাধ্যমে জিনিস তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া নতুন নতুন জিনিস তৈরির পরিকল্পনা চলছে। এর ফলে দেশের বাজারে এই পণ্যে চাহিদা আগের বাড়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের কদর বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।

বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের মোট রপ্তানির ২০ শতাংশ ভারতের বাজারে রপ্তানি হতো। কিন্তু বাংলাদেশী পাটপণ্যে টনপ্রতি সর্বোচ্চ ৩৫২ ডলারসহ বিভিন্ন হারে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে ভারত। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ায় ভারতের স্থানীয় পাট ও পাটজাত পণ্যের তুলনায় বাংলাদেশের পণ্যের দাম বেশি পড়বে। এতে ভারতের বাজারে স্থানীয় পাট ও পাটজাত পণ্যে প্রভাব বাড়বে, আর বাংলাদেশের পাট জৌলুস হারাবে।

এ কারণে বাংলাদেশের এ পণ্য ভারতে রফতানির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হবে বলে জানিয়ে রফতানিকারকরা বলেছেন, বাংলাদেশের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতের বড় ধরনের যড়যন্ত্র। পাটপণ্যে ভারত যদি অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ প্রত্যাহার না করে, তাহলে তাদের চেয়ে ভালো বিকল্প বাজারের সন্ধান করা হবে বলেও তারা জানান।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানিয়েছেন, পাটের বাজার স¤প্রসারণের আরও সুযোগ রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অন্তত ১০ টি দেশে পলিথিন নিষিদ্ধ। ২৮ দেশের এই জোটের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী বছর থেকে ইইউর সব দেশে পলিথিন নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। সব দেশেই পরিবেশ সচেতনতায় পাটসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক আঁশে তৈরি পণ্যের ব্যবহার বেড়েছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/68111