৭ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ৭:০৪

আইএমইডির প্রতিবেদন

১৩৩ প্রকল্পে ব্যয় হলেও বাস্তব অগ্রগতি শূন্য

গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ১৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে ৪৩৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ১৩৩ প্রকল্পে গত অর্থবছরে ৪৩৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয় হলেও বাস্তব অগ্রগতি শূন্য। এত টাকা ব্যয়ের পরও প্রকল্পগুলোর কোনো ভৌত কাজ হয়নি। এসব প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল এক হাজার ১৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এ ছাড়া একই অর্থবছরে ১১৩টি প্রকল্পে ৫৭১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি।

২০১৫-১৬ অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত সরকারের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে আইএমইডির এ প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়।

শত শত কোটি টাকার অর্থ ব্যয় হয়েছে, কিন্তু প্রকল্পে বাস্তব কাজ কেন হয়নি, তার কারণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দাবি, এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়নি। প্রকল্পের জন্য দামি দামি গাড়ি ক্রয়, বিদেশ সফর, বিশেষজ্ঞদের কমিশন, কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি খাতেই অর্থ খরচ হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন জরিপসহ প্রকল্পের প্রাথমিক প্রস্তুতিতেই অনেক টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।

তবে এ অবস্থার পেছনে প্রকল্প বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর গুরুত্বহীনতাকেই দায়ী করেছে আইএমইডি। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্প তালিকার অনেক তথ্য সঠিক নয়। তবে আইএমইডির দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা বলছেন প্রতিবেদনের তথ্যে কোনো ভুল নেই। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রকল্পে অর্থ খরচ হলেও বাস্তব অগ্রগতি শূন্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। এমন ঘটনা অবশ্যই আর্থিক ও পরিকল্পনা শৃংখলার পরিপন্থী। এসব কাজ প্রশ্রয় দেয়া যায় না। কোথায় কত টাকা ব্যয় করা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন হতে পারে, সম্ভাব্যতা যাচাই করা কিংবা প্রকল্পের প্রাথমিক কার্যক্রম করতেই এ অর্থ ব্যয় হয়েছে। কিন্তু ভৌত অগ্রগতি এখনও হয়নি। তা না হয়ে যদি দেখা যায়, গাড়ী ক্রয়, কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বা অপ্রয়োজনীয় ব্যয় করে টাকা খরচ করা হয়েছে তাহলে সত্যিই ব্যাপারটা দুঃখজনক হবে। মন্ত্রণালয়গুলোর উচিত, এসব বিষয় খতিয়ে দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক প্রকল্প পরিচালক এবং এডিপি ও সংশোধিত এডিপি তৈরির সঙ্গে যুক্ত পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, এ ধরনের প্রকল্পের ক্ষেত্রে বাসা ভাড়া, গাড়ির জ্বালানি ক্রয়, বছরের পর বছর বেতন-ভাতা নেয়া এবং টাকা দিলেও মালামাল না আসার কারণেও প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি শূন্য হতে পারে। মূল কাজ না করে এভাবে অর্থ ব্যয় করাও এক ধরনের অনিয়ম।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, টাকা খরচ হয়েছে কিন্তু বাস্তব অগ্রগতি যদি শূন্য হয়, তাহলে দুর্নীতি হতে পারে। তাছাড়া নিঃসন্দেহে এটা আর্থিক শৃংখলার পরিপন্থী। এ ধরনের ঘটনা দেশের অর্থনীতির জন্য দুঃখজনক। তাই বের করতে হবে কোথায় এ অর্থ ব্যয় হয়েছে। প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।

আইএমইডি বলেছে, গত অর্থবছরে ১৩৩টি প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ১৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্থানীয় মুদ্রা ৪৩৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা এবং বাকি ৫৮১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ছিল বৈদেশিক উৎস থেকে। কিস্তু পুরো অর্থবছরে ব্যয় হয় মোট ৪৩৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্থানীয় মুদ্রা থেকে ব্যয় হয়েছে ৪০৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এত টাকা ব্যয় হলেও প্রকল্পগুলোর কোনো ভৌত কাজ হয়নি। তাই বাস্তব অগ্রগতি বলা হয়েছে শূন্য। এছাড়া যেসব প্রকল্পে কোনো অর্থ ব্যয় বা কাজ কোনোটিই হয়নি সেসব প্রকল্পের অনুকূলে এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৫৭১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।

প্রকল্পগুলোর শূন্য অগ্রগতির কারণ হিসেবে আইএমইডি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরপত্র আহ্বানে বিলম্ব করা, দরপত্র রেসপন্সিভ না হওয়া, ঋণ না পাওয়া, অর্থছাড় না হওয়া বা দেরিতে অর্থছাড় হওয়া, ভূমি অধিগ্রহণ না হওয়া, মামলাজনিত সমস্যা, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধনে, সংশোধিত এডিপি অনুমোদনে বিলম্ব, উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরে দেরি, নামমাত্র বরাদ্দ ইত্যাদি। তবে এটা স্পষ্ট যে, এডিপির প্রকল্প বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় ও বিভাগ যথাযথ তদারকি এবং গুরুত্ব প্রদান করে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম যুগান্তরকে বলেন, এসব ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায়, চেয়ার-টেবিল কেনা, গাড়ি কেনাসহ গুরুত্বহীন কাজ করার প্রতি বেশি ঝোঁক থাকে। এতে মূল কাজের প্রতি প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ থাকে না। এজন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়। পরে সময় ও অর্থ অনেক বেশি চলে গেলেও লক্ষ্যমাত্রানুযায়ী কাক্সিক্ষত সুফল মেলে না। প্রকল্পে খরচ হবে কিন্তু বাস্তব কাজ শূন্য থাকবে, এটা মেনে নেয়া যায় না। তবে সম্ভাব্যতা যাচাই হলে সেটি ভিন্ন কথা। বিষয়গুলো হালকা করে দেখার সুযোগ নেই।

অর্থ ব্যয় হলেও বাস্তব অগ্রগতি শূন্য- এমন প্রকল্পের মধ্যে একটি হচ্ছে ঢাকা-চিটাগং রেলওয়ে ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট ট্র্যাক ডাবলিং বিটুইন লাকসাম এবং চিনকি-আস্তানা ফাস্ট রিভাইজড কম্পোনেন্ট শীর্ষক প্রকল্প। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৭৩১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নে গত অর্থবছর এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৯৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ৯৬ কোটি ৯৩ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। প্রকল্পটি ২০০৭ সাল থেকে শুরু হয়ে গত বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আইএমইডি বলছে, এত টাকা ব্যয় হলেও প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি শূন্য। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক রফিকুল আলম রোববার যুগান্তরকে বলেন, ২০১৫ সালের মার্চে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শেষ হয়েছে। এক্ষেত্রে যেটি হতে পারে, পেমেন্ট হয়তো পরবর্তী সময়ে দেয়া হতে পারে। এ কারণে বাস্তব অগ্রগতি শূন্য দেখিয়েছে আইএমইডি।

এ তালিকায় থাকা প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ডিস্ট্রিক্ট রোড ডেভেলপমেন্ট (রংপুর জোন) শীর্ষক প্রকল্পের বিষয়ে আইএমইডি বলেছে, গত অর্থবছরে এ প্রকল্পে ৬০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ক্রম পুঞ্জীভূত অগ্রগতি থাকলেও শুধু ওই অর্থবছরের বাস্তব অগ্রগতি শূন্য। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক সহিদুন্নবী বলেন, এটা ঠিক নয়। বাস্তবায়ন অগ্রগতি থাকলেও আইএমইডি কেন বলছে নেই, তা বোধগম্য নয়। তিনি জানান, আগামী জুনের মধ্যে প্রকল্পটি সমাপ্ত করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে আইএমইডির দায়িত্বশীল এক কর্মকতা বলেন, আমরা যেভাবে রিপোর্ট পেয়েছি, সেভাবেই প্রতিবেদন তৈরি করেছি। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকই ভালো বলতে পারবেন।

এছাড়া আইএমইডির প্রতিবেদনে বাস্তব অগ্রগতি শূন্য বলা হয়েছে- এমন প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৪১১ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে রিপ্লেসমেন্ট অব ওল্ড মেশিনারিজ অ্যান্ড অ্যাডিশন অব মেশিনারিজ ফর বিট সুগার প্রডাকশন অ্যাট ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস প্রকল্পে গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ব্যয় হয়েছে ৪৬ লাখ ৩ হাজার টাকা। প্রকল্পটি ২০১৩ থেকে শুরু হয়ে ২০১৮ সালের জুনে বাস্তবায়ন শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে। এস্টাবলিস্টমেন্ট অব জামালপুর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রকল্পটি ২০১৫ সাল থেকে শুরু হয়ে ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে। মোট ব্যয় ধরা হয় ১১১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। গত অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে ৪ কোটি ৭২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এক্সটেনশন অব ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব অর্থোপেডিক হাসপাতাল অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার (নিটোর) প্রকল্পটির মোট ব্যয় ৩৩৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। গত অর্থবছরে ব্যয় হয়েছিল ৪৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। একই অবস্থায় থাকা অন্য প্রকল্পগুলো হচ্ছে, প্লানিং-মনিটরিং-অ্যান্ড রিসার্স (হেলথ), সেক্টর ওয়াইড প্রোগ্রাম ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইভালুয়েশন, কনস্ট্রাকশন অব ব্রিজ ওভার শীতলক্ষ্যা অ্যাট কারাসিন্দুর অব গাজীপুর-আজমতপুর-ইটাখোলা রোড প্রজেক্ট এবং রিজিওনাল সাবমেরিন টেলিকমিউনিকেশন্স প্রজেক্ট বাংলাদেশ।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/03/07/106788