৭ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ৬:৫১

ভারতের নিয়ন্ত্রণে ৫৩ নদীর পানি ভাটির নদনদীগুলো মরে যাচ্ছে

ভারতের নিয়ন্ত্রণে পদ্মা-তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র-মহানন্দাসহ অভিন্ন ৫৩ নদীর পানি। এ নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করে প্রতিবেশী দেশটি খাল খননসহ নানা কৌশলে অভিন্ন নদ-নদীর পানি একতরফা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ফলে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদী ও শাখানদীগুলো মরা নদীতে পরিণত হচ্ছে। কমেছে মাছ ও জলজ প্রাণী। বেড়েছে তাপমাত্রা। পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, কৃষি অর্থনীতি ও জলবাযুর ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

ভারতের সাথে বাংলাদেশের ছোট-বড় অভিন্ন ৫৪টি নদী হচ্ছেÑ করতোয়া, তালমা, ঘোড়ামারা, দেওনাই-যমুনেশ্বরী, বুড়ি তিস্তা, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র, জিঞ্জিরাম, চিলাখালী, ভোগাই, নিতাই, সোমেশ্বরী, যাদুকাটা, ধামারিয়া-যাদুখালী, নওয়াগাং, উমিয়াম, ধলা, পিয়াইন, গঙ্গা, ইছামতি-কালিন্দী, রায় মঙ্গল, বেতনা-কোদালিয়া, ভৈরব-কপোতাক্ষ, মাথাভাঙ্গা, পাগলা, আত্রাই, পুনর্ভবা, তেঁতুলিয়া, টাঙন, কুলিক বা কোকিলা, নাগর, মহানন্দা, ডাহুক, সারি-গোয়াইন, সুরমা, কুশিয়ারা, সোনাই-বরদল, জুরি, মনু, ধলাই, লংলা, খোয়াই, সুতাং, সোনাই, হওড়া, বিজনী, সালদা, গোমতি, কাকরাই-ডাকাতিয়া, সিলোনিয়া, মুহরী, ফেনী ও কর্ণফুলী। এরমধ্যে ভারত ৫৩টি নদী উপনদীতে বাঁধ, সেচ ক্যানেলসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণ করে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে।

হিমালয় পর্বতমালার উৎস থেকে যে কয়টি দেশ পানির বিপুল সম্ভার লাভ করে থাকে ভাটির বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। কিন্তু এসব নদীর প্রবাহ সরাসরি বাংলাদেশ পায় না। ভারতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীর সংখ্যা ৫৪টি। এরমধ্যে ভারত ৫৩টি নদী ও উপনদীতে অসংখ্য বাঁধ, সেচ ক্যানেল ও জলবিদ্যুৎসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ভারত গঙ্গা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার ও মহানন্দাসহ হিমালয় অঞ্চলের নদী ও উপনদীগুলোতে প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক নদীর মাধ্যমে পানি পাওয়া যায় ৭৪ শতাংশ, বৃষ্টির পানি ২৪ শতাংশ এবং ভূগর্ভ থেকে উত্তোলিত পানির পরিমাণ ২ শতাংশ। নদী পরিবাহিত পানির ৮৫ শতাংশই প্রবেশ করে জুন-অক্টোবর সময়ে। এ সময়ে আসা মোট পানির ৫৪ শতাংশ সরবরাহ করে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা সরবরাহ করে ৩১ শতাংশ এবং মেঘনা নদী সরবরাহ করে ১৫ শতাংশ পানি।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে মাথাভাঙ্গা, বেতনা, সোনামুখী, ভৈরব, রায়মঙ্গল, কুমার ইছামতি এই ছয়টি অভিন্ন নদী রয়েছে। এই নদীগুলোর ওপর নির্ভর করে সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিনাইদহ জেলার কৃষি ও নাব্যতা। ভারতে নদিয়া জেলার করিমপুর থানার গঙ্গারামপুরের আট কিলোমিটার ভাটিতে ভৈরব নদের উৎসমুখে একটি ক্রসবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। জলঙ্গি নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে একটি রেগুলেটর। ওই বাঁধ ও রেগুলেটর দিয়ে ভারত জলঙ্গি নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ফলে ভাটিতে ভৈরব নদ মরে গেছে। ভৈরব শুকিয়ে যাওয়ায় পানি পাচ্ছে না কপোতাক্ষ নদ। কপোতাক্ষ নদ ভরাট হয়ে যাওয়ায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে স্থায়ী জলাবদ্ধতাসহ মারাত্মক বিপর্যয় নেমে এসেছে।

গুগল আর্থম্যাপে দেখা যায়, ফারাক্কার উজানে গঙ্গায় ভরা যৌবন, আর ফারাক্কার ভাটিতে বাংলাদেশে পদ্মা শুকিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। ভারত গঙ্গার পানি কৃত্রিম চ্যানেলের মাধ্যমে ভাগীরথী নদীতে প্রবাহিত করছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে মহানন্দা নদী ভারত থেকে প্রবেশ করেছে। ভারত বাঁধ দিয়ে মহানন্দার পানি একতরফা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এতে রংপুর, দিনাজপুর পাবনা ও নাটোর জেলার ৫৫টি নদী মরে গেছে। নওগাঁয় পানি প্রবাহের মূল উৎস ছোট যমুনা। ছোট যমুনার মাতৃনদী খুলসী। কিন্তু ভারত খুলসী নদীতে রেগুলেটর নির্মাণ করে সব পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ফলে নওগাঁর ৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাসহ বরেন্দ্র অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ভারত জলপাইগুড়ি জেলার আমবাড়ি-কালাকাটায় একটি ব্যারেজ নির্মাণ করে করতোয়া নদীর পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। করতোয়ার একটি অংশ গজলডোবার কাছে তিস্তা নদীতে মিলিত হয়েছে। ভারত গজলডোবায় ব্যারাজ নির্মাণ করে তিস্তার পানি সরিয়ে সেচ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করছে।

তিস্তা মহানন্দা বহুমুখী বাঁধের আওতায় ভারত অভিন্ন নদী মহানন্দা, নাগর, তিস্তা, বুড়িতিস্তা, চড়াকাটা, যমুনেশ্বরী, করতোয়ার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এসব অভিন্ন নদীর মধ্যে সর্ববৃহৎ ব্রহ্মপুত্র। তিব্বতের কৈলাসটিলা শৃঙ্গে উৎপত্তি হয়ে ভারতের অরুণাচল ও আসাম হয়ে এ নদী বাংলাদেশে ঢুকেছে। এর দৈর্ঘ্য দুই হাজার ৯০০ কিলোমিটার। নদীর ৪০ শতাংশ পানি চীন, নেপাল-ভুটান ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসে। চীন ইয়াংগুন স্যাংগো প্রকল্পের আওতায় ব্রহ্মপুত্রের প্রায় পুরো পানি প্রত্যাহার করে তার উত্তরাঞ্চলের গোরী মরুভূমিকে শস্য-শ্যামলা করার পরিকল্পনা করেছে। চীন ইয়াংগুন স্যাংগো প্রকল্পের সাহায্যে প্রায় ৮০ হাজার মেগাওয়াট পানিবিদ্যু উৎপাদন করার পরিকল্পনা করেছে। এই প্রকল্প পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে ব্রহ্মপুত্র নদের পুরো অববাহিকা একসময় মরুভূমিতে পরিণত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।

অভিন্ন নদী জিনজিরাম, চিতলখালী, ভোগাই বংশ, নিতাই, সোমেশ্বরী, জাদুকাঠা বক্তি, হালুয়াখালী, নায়াগাং ও উমিয়াম নামে ময়মনসিংহ ও রংপুর অঞ্চলের নদীগুলোর উৎপত্তি মূলত মেঘালয়ের গারো পাহাড় ও খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়। ভারত বাঁধ, রেগুলেটর, সেচ ক্যানেলসহ নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করে একতরফা পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ফলে ভাটির বাংলাদেশের এই নদীগুলো মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। মরে যাচ্ছে ময়মনসিংহ ও জামালপুরের প্রধান নদ পুরাতন ব্রহ্মপুত্র।

দক্ষিণ ত্রিপুরার মহারানী এলাকায় গোমতী নদীতে একটি বাঁধ নির্মাণ করেছে ভারত। এতে শুষ্ক মওসুমে গোমতীর প্রবাহ একেবারেই কমে গেছে। গোমতীর পানির ওপর নির্ভরশীল সোনাইমুড়ী সেচ প্রকল্পসহ ছোট ছোট অনেক সেচ প্রকল্প বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ভারত ত্রিপুরায় পাম্প বসিয়ে সিলোনিয়া নদীর পানি সরিয়ে নিচ্ছে। মুহুরী প্রকল্পের প্রাণ ফেনী নদী। ভারত পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় ফেনী নদীর প্রবাহ কমে গেছে।

দেশের নদী ও পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত অভিন্ন নদ-নদীগুলোর পানি নিয়ন্ত্রণ এবং প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এতে ব্রহ্মপুত্রের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ অংশে ধান ও গমের উৎপাদন ভয়াবহ হুমকিগ্রস্ত হবে। গঙ্গার ওপর নির্ভরশীল দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকার ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটবে। বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়বে, যার প্রভাবে নদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত কৃষি, মৎস্য, পশুসম্পদ, শিল্পকারখানা বিপর্যস্ত হবে। পাশাপাশি আর্সেনিক দূষণ তীব্র হবে। নদীতে নাব্যতা কমে গিয়ে নৌচলাচল ব্যাহত হবে, ভূগর্ভের পানির স্তর নেমে যাবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রকৃতিগত দিক দিয়ে নদী হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বুনিয়াদ। পেশাগত দিক থেকে জীবন-জীবিকার একটি অংশ নির্ভরশীল এ দেশের নদ-নদীর ওপর। এ দেশের কৃষিসম্পদ, যোগাযোগব্যবস্থা, ব্যবসাবাণিজ্য, পরিবেশÑ এর সবই নদীনির্ভর। নদীকে বাদ দিয়ে এ দেশের উন্নয়ন তথা মানুষের জীবন কল্পনাই করা যায় না। সংখ্যার দিক থেকে মতপার্থক্য থাকলেও কমপক্ষে চার শতাধিক নদ-নদী জালের মতো বিস্তার করে আছে পুরো দেশে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী আবদুল হামিদ বলেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীগুলো আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে চিহ্নিত। এসব নদীর উজানে কিছু করতে হলে আন্তর্জাতিক আইন মেনে করতে হবে। কিন্তু ভারত এই আইনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না। তার মতে, ভারতের সাথে পানি সমস্যা দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করা যাবে না। গঙ্গার পানি বণ্টনের সঙ্গে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদীর বিষয় আলোচনাভুক্ত করতে হবে। আন্তর্জাতিক নদীর পানির সুষ্ঠু ব্যবহারের স্বার্থে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও চীনের পানি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পানি ফোরাম গঠন করা যেতে পারে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/201410