৭ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ৫:২৫

সুশাসন

সংবিধানে বারণ, কিন্তু মানছেন না ক্ষমতাধরেরা

ইকতেদার আহমেদ

প্রতিটি দেশের প্রত্যেক নাগরিকের নিজ নিজ অবস্থান অনুযায়ী আত্মসম্মান রয়েছে। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া আত্মসম্মানের হানি পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের সংবিধান দিয়ে বারিত। জাতিসঙ্ঘ সর্বজনীন মানবাধিকার দলিল, ১৯৪৮ এ নাগরিকদের আত্মসম্মানের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাবে না কিংবা কারো সাথে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না। জাতিসঙ্ঘ সর্বজনীন মানবাধিকার দলিলের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত এ মানবাধিকারটি আমাদের সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদের (৫) নম্বর দফায় স্থান পেয়েছে।

সংবিধান ও আইন মেনে চলা সব নাগরিকের কর্তব্য। এ কর্তব্যটি একজন সাধারণ নাগরিকের কাছে যতটুকু না গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত এবং যারা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিতের জন্য। আইন প্রণয়নের কাজটি সংসদের ওপর ন্যস্ত এবং সংসদ সদস্যগণ জনগণের পক্ষ হতে প্রদত্ত ক্ষমতার অনুবলে আইন প্রণয়নের কাজ সমাধা করে থাকেন। একজন সংসদ সদস্য শপথের অধীন এবং শপথ নেয়া ছাড়া তিনি সংসদ সদস্য পদে আসীন হন না। একজন সংসদ সদস্যকে শপথ নেয়ার সময় অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি বলতে হয়Ñ তিনি আইন অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সাথে তার দায়িত্ব পালন করবেন। দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের নয়-দশমাংশকে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেয়া হয়। একজন সংসদ সদস্যকে মন্ত্রী পদে নিয়োগ দেয়া হলে পুনরায় তাকে শপথ পাঠ করতে হয় এবং এ ক্ষেত্রেও শপথ পাঠ ছাড়া তিনি পদে আসীন হন না। একজন মন্ত্রীকে শপথ পাঠের সময় অপরাপর বিষয়ের পাশাপাশি বলতে হয়Ñ তিনি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন।

একজন সংসদ সদস্য এবং একজন মন্ত্রীর পঠিত শপথ অনুযায়ী তার পক্ষে আইনে অনুমোদিত নয় এমন কোনো ধরনের কাজ করার সুযোগ নেই। সংবিধান পরিপন্থী যেকোনো কাজ সংবিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করার শামিল। এ ধরনের কাজকে সংবিধানে শাস্তিযোগ্য করা হয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা সংবিধানের প্রাণ। প্রস্তাবনায় উল্লিখিত দিকনির্দেশনার আলোকে সংবিধানটি রচিত। প্রস্তাবনায় সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠাÑ যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে।

গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের পূর্বশর্ত হলো একটি সরকারের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। দেশে স্থানীয় সরকারসংক্রান্ত যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সমরূপ পূর্বশর্ত প্রতিপালন অত্যাবশ্যক। দেশের সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সরকারের সব পর্যায় এবং সমাজের সব স্তর থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা আমাদের দেশে বর্তমানে সর্বত্র দুর্নীতি যেভাবে সর্বগ্রাসী, তাতে আমরা যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ থেকে বিচ্যুত, এ প্রশ্নে দেশের সচেতন জনমানুষের মধ্যে কোনো ধরনের সংশয় নেই।

আমাদের সংবিধানের অনন্য বৈশিষ্ট্য আইনের দৃষ্টিতে সমতা। এ প্রসঙ্গে সংবিধানে সুস্পষ্টরূপে বিবৃত রয়েছেÑ সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। সংবিধানের এ অনন্য বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন সমাজের সবখানে পরিলক্ষিত হলে কোথাও কোনো ধরনের অন্যায় থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো অন্যায়ের শিকড় এত বিস্তৃত ও গভীরে নিবিষ্ট যে, এর মূল উৎপাটন কঠিন হয়ে দেখা দিয়েছে। এ বৈশিষ্ট্যটির যথাযথ প্রয়োগ না থাকার কারণেই দেখা যায় আজ ক্ষমতাধরদের আশীর্বাদপুষ্ট একশ্রেণীর প্রভাবশালী শত অন্যায়ের পরও আইনের ঊর্ধ্বে, আবার একশ্রেণীর অসহায় ও নিঃস্ব অন্যায় না করা সত্ত্বেও আইনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে নিষ্পেষিত ও সর্বস্বান্ত।

সব শ্রেণী-পেশার মানুষ নিয়েই আমাদের জনগণ। সংবিধানে জনগণকেই বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক। জনগণের মধ্যে সব শ্রেণীপেশা অন্তর্ভুক্ত হলেও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন না হওয়ায় সব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ক্ষমতাসীনদের হাতে কেন্দ্রীভূত, আর সাধারণ জনমানুষ ক্ষমতাসীনদের নানামুখী অন্যায়ের কবলে পড়ে আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচার ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত।

রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিক সংবিধান স্বীকৃত যেকোনো ধরনের মৌলিক অধিকার হতে বঞ্চিত হলে তা বলবৎ করার জন্য সংবিধানে হাইকোর্ট বিভাগের কাছে মামলা রুজু করার অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হলেও নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে তা সবার জন্য অবারিত নয়।

একজন মন্ত্রী বা একজন সংসদ সদস্য বা উচ্চাদালত বা অধস্তন আদালতের একজন বিচারক, প্রশাসন বা পুলিশ বিভাগের কোনো কর্মকর্তা বা যেকোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তিকে জনসম্মুখে বা জন-অনুপস্থিতিতে বেত্রাঘাত, কান ধরে উঠবোস করানো, চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি বা লাথি মারা, রিমান্ডের নামে শারীরিক নির্যাতন, করজোড়ে দাঁড় করানো প্রভৃতি অন্যায় এবং দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের পরিপন্থী। এ ধরনের কাজ সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ৩৫ দফা নম্বর (৫) এ বিবৃত নিষিদ্ধ কাজগুলোকে আকৃষ্ট করে।

আমাদের দেশে সম্প্রতি পুলিশ জনসম্মুখে একজন নাগরিকের জন্য অবমাননাকর বা লাঞ্ছনাকর ঘটনা ঘটিয়েছে, সে ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অন্যায় কাজের সাথে সম্পৃক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সচেষ্ট হয়েছে। যেকোনো কর্তৃপক্ষ এ ধরনের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সচেষ্ট হলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা যে এ ধরনের কাজ করা থেকে নিজেদের নিবৃত্ত রাখবেন, সে বিষয়ে দেশবাসীর মধ্যে সংশয় থাকার কোনো অবকাশ নেই।

অতীতে পুলিশ জনসম্মুখে সংগঠিত একজন নাগরিকের জন্য অবমাননাকর বা লাঞ্ছনাকর ঘটনা যেমন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে অনুরূপ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং উচ্চাদালতের বিচারক সংঘটিত সমরূপ ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে এ ধরনের ঘটনার সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদের এ ধরনের ঘটনা ঘটানো থেকে নিবৃত্ত রাখা যাচ্ছে না।

যেসব অন্যায় আচরণ দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এগুলো সংঘটন পরবর্তী অন্যায়কারীকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্রের পক্ষে এ ধরনের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের শৈথিল্য আইনকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে এর অপব্যবহারের ক্ষেত্র প্রস্তুতের সহায়ক হয়।

দেশের প্রত্যেক ব্যক্তির অবস্থানভেদে যেমন আত্মসম্মান রয়েছে, অনুরূপ তার পরিবারেরও আত্মসম্মান রয়েছে। একজন ব্যক্তি অপর কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তির চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি বা লাথি মারার কারণে অথবা কান ধরে ওঠবস করানোর কারণে বা করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করার কারণে যেভাবে অবমাননা বা লাঞ্ছনার মুখোমুখি হন, তা তার পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব, পাড়াপ্রতিবেশী এবং সর্বোপরি দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সম্মুখে তাকে হেয়প্রতিপন্ন করে। একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার কবলে পড়লে তার পক্ষে এটা কিছুতেই মেনে নেয়া সম্ভব নয়। যেকোনো পদধারী সচরাচর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হয়ে থাকেন। কিন্তু এমন অনেকে আছেন, যারা যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও পদে আসীন হয়েছেন; এরূপ ব্যক্তি কখনো উপরস্থ ক্ষমতাধরের অনাকাক্সিক্ষত চড়-থাপ্পড় বা কিল-ঘুষির সম্মুখীন হলে তাকে স্বীয় পদ বা ক্ষমতা হারানোর ভয়ে এ অপমান ও লাঞ্ছনাকে হজম করে এটিকে তার জন্য ক্ষমতাধর ওপরস্থের শাসন, স্নেহ বা আশীর্বাদরূপে দেখার বৃথা প্রয়াস নেন।

একজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি তার নির্বাচনী এলাকার সব জনগণের প্রতিনিধি। আবার একজন সংসদ সদস্যকে যখন মন্ত্রী পদে নিয়োগ দেয়া হয় তখন তিনি শুধু তার নির্বাচনী এলাকা নয়, সারা দেশের জনমানুষের প্রতিনিধি। একজন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীর কাছ থেকে দেশের জনমানুষ সব সময় ন্যায়ের প্রত্যাশী। এরূপ ব্যক্তি কখনো আইনকে নিজের হাতে তুলে নিবেন তা জনমানুষের প্রত্যাশার বাইরে। গণতন্ত্র ও আইনের শাসনে বিশ্বাসী একজন সংসদ সদস্য বা মন্ত্রীর পক্ষে কখনো ক্ষমতা ও আইনের অপপ্রয়োগ বা অপব্যবহারের সুযোগ নেই। কিন্তু একই সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী যখন তার মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিভাগের অধস্তন কর্মকর্তাকে চড়-থাপ্পড় মারার পর এবং সড়ক পরিদর্শনকালীন অটোরিকশা চালককে কান ধরে উঠবস করানোর পর কোনো ধরনের জবাবদিহিতার মুখোমুখি না হন, সে ক্ষেত্রে তার এ ধরনের কাজ বিস্তৃত হয়ে নিজ দলীয় সহকর্মীর ওপর প্রয়োগ হতে তাকে যে নিবৃত্ত করবে না এটি অস্বাভাবিক নয়। আর এরই বহিঃপ্রকাশ দেশবাসী প্রত্যক্ষ করল গণমাধ্যমে বহুলভাবে প্রচারিত সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাটির মধ্য দিয়ে।


লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail : iktederahmed@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/201467