৬ মার্চ ২০১৭, সোমবার, ৮:০০

ইন্টার্ন চিকিৎসকরা কর্মবিরতিতে চরম ভোগান্তিতে রোগীরা

রোগীর স্বজনকে মারধর করার ঘটনায় চার ইন্টার্ন চিকিৎসককে শাস্তি দেয়ার প্রতিবাদে সারা দেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে দ্বিতীয় দিনের মতো কর্মবিরতি অব্যাহত রেখেছে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। শনিবার সকাল থেকে সারা দেশে ৭২ ঘণ্টার কর্মবিরতি শুরু করেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে রোগীরা। নিয়মিত চিকিৎসকরা ভর্তি রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। মুমূর্ষু রোগী নিয়ে এসে চিকিৎসাসেবা না পেয়ে হাসপাতাল ছেড়েছে স্বজনরা। রোগীদের জিম্মি করে এভাবে পেশাজীবীদের কর্মবিরতি বা ধর্মঘট পালনের সমালোচনা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ওই চারজনের শাস্তি বাতিল ছাড়াও সাত দফা দাবি দিয়েছেন।

৭২ ঘণ্টার মধ্যে দাবি মানা না হলে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন তারা। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বগুড়ার ঘটনার আগে-পরে একাধিকবার চিকিৎসকদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, রোগীদের জিম্মি করে কেউ কর্মসূচি পালন করতে পারবে না। তবে মন্ত্রীর সে নির্দেশনা আমলে নেননি ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। আবার ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতিকে পরোক্ষভাবে সমর্থন জুগিয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)।

হাসপাতালে রোগীদের ভোগান্তি চরমে: শনিবার সকাল থেকে ঢাকায় স্যার সলিমুল্লাহ মিটফোর্ড হাসপাতাল, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা কর্মবিরতি শুরু করেন। দণ্ডপ্রাপ্তদের শাস্তি বাতিলসহ বিভিন্ন দাবিতে মানববন্ধন করেন তারা। ফলে সেবা না পেয়ে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোতে চরম ভোগান্তিতে পড়ে রোগীরা। বিস্তারিত আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে-

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে জানান, চট্টগ্রামে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চার ইন্টার্ন চিকিৎসকের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে রোববার দুপুর থেকে ধর্মঘট পালন করে। তবে এই সময় জরুরি বিভাগে স্বাভাবিক চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম চললেও বন্ধ ছিল ওয়ার্ডগুলোতে সেবা দেয়া। গতকাল সরজমিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বেলা একটায় ধর্মঘট শুরু হয়। কর্মসূচিতে ২৬৩ জন ইন্টার্ন চিকিৎসকের সম্মতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। চমেক হাসপাতালের রোগীরা জানান, যেকোনো ধরনের ধর্মঘটে অবশ্যই দুর্ভোগ নেমে আসে। সেটি যদি হয় চিকিৎসা খাতে তাহলে তো ভোগান্তি আরো বেশি। শিক্ষানবিশদের কর্মবিরতিতে গত কয়েকদিন ধরেই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে রোগীদের। এই ধরনের পরিস্থিতি হয়তো কর্মসূচির কারণে চট্টগ্রামেও হতে পারে। তারা আরো জানান, সিরাজগঞ্জ সদর থেকে বগুড়া হাসপাতালে এক রোগীর ছেলে ও দুই মেয়ে গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মারধরের শিকার হলে ঘটনার সূত্রপাত।

এ বিষয়ে চমেক ইন্টার্ন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রাশেদুল ইসলাম বলেন, শজিমেকের চার ইন্টার্ন চিকিৎসকের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার ও নিরাপদ কর্মস্থলের দাবিতে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আমরা ধর্মঘট পালন করছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে। এখানে চিকিৎসা সেবা নিয়ে কোনো ধরনের হয়রানি হচ্ছে না। অন্যদিকে চমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মো. দিদারুল ইসলাম দাবি করে বলেন, ধর্মঘটের কারণে চিকিৎসাসেবায় ব্যাঘাত ঘটছে না। আমরা আশা করবো যত দ্রুত সম্ভব পরিস্থিতির সমাধান হবে।

বগুড়া প্রতিনিধি জানান, শজিমেক হাসপাতালে রোগীর স্বজনকে মারধর ও কানধরে উঠবস করার ঘটনায় ৪ ইন্টার্ন চিকিৎসকদের শাস্তি প্রত্যাহারের দাবিতে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। রোববার দুপুরে চিকিৎসকরা কাজে যোগ না দিয়ে হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে এক মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। মানববন্ধন কর্মসূচিতে হাসপাতালে কর্মরত ইন্টার্ন চিকিৎসকসহ মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অংশ নেয়। এদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কাজে ফেরাতে দফায় দফায় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ইন্টার্ন চিকিৎসকদের একাংশ তাদের দাবির ব্যাপারে অনড় থাকায় তারা এখনো তাদের কাজে ফেরেনি। ফলে চিকিৎসা কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ অবশ্য হাসপাতালের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে অন্য চিকিৎসকদের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছে। ইন্টার্ন চিকিৎসকদের শাস্তি প্রত্যাহারের দাবিতে রোববার দুপুরে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধনকালে শাস্তিপ্রাপ্ত ছাত্রলীগ নেতা ডা. কুতুবুদ্দিন বলেন, তাদের শাস্তি প্রত্যাহার সহ ৭ দফা দাবি মেনে নিতে হবে। তা না হলে কর্মবিরতি কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। তারা বিভিন্ন ধরনের দাবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন।

স্টাফ রিপোর্টার, রংপুর থেকে জানান, অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতির ফলে দুর্ভোগে পড়েছে রোগীরা। চিকিৎসাসেবা না পেয়ে অনেকে মেডিকেল হাসপাতাল ছেড়ে বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি হচ্ছেন। দরিদ্র রোগীরা হাসপাতাল ছেড়ে বাসা বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন। এদিকে কর্মবিরতির দ্বিতীয় দিনে ইন্টার্ন ডাক্তাররা মেডিকেল কলেজ চত্বরে মিছিল ও সমাবেশ করেছে। এতে বক্তব্য রাখেন ইন্টার্নি ডাক্তার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহফুজুল হক রাকিব, সাধারণ সম্পাদক আহমেদুল বারী বাঁধন, ডা. সুলতান আরেফিন, ডা. শাহনাজ নাজনিন, ডা. রাশেদ মিজান রবি, ডা. শাহানা শোভা প্রমুখ। বক্তব্যে তারা বলেন, আমরা মানবসেবায় নিয়োজিত। কাজ করতে গিয়ে হয়তো বা ভুল হতেই পারে। তাই বলে আমাদের অসম্মান করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা মেনে নেবো না। ভুল করলে তা শাস্তি হবে, তাই বলে অসম্মান করা যাবে না। কিন্তু বগুড়ায় আমাদের সহকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়ে আবার তাদেরকেই শাস্তি দেয়া হয়েছে। এটা মেনে নেয়া সম্ভব নয়। তাই আমরা প্রাথমিকভাবে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে কর্মবিরতি শুরু করেছি। এরপরও যদি ৪ ইন্টার্নির স্থগিত আদেশ প্রত্যাহার করা না হয় তবে বৃহত্তর আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে। এদিকে হঠাৎ করে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই কর্মবিরতিতে ভোগান্তিতে পড়েছে রোগীরা। ১ হাজার শয্যা হাসপাতালে প্রতিদিন ২ হাজারের বেশি রোগী থাকে। এতো রোগী সামাল দিতে ইন্টার্নি ডাক্তার ছাড়া হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও পরিচালক।

এব্যাপারে হাসপাতালের পরিচালক ডা. অজয় কর জানান, ইন্টার্ন ডাক্তারদের কর্মবিরতির ফলে তেমন সমস্যা হবে না রোগীদের। কারণ ডাক্তারদের বাড়তি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, গত শনিবার বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে চার ইন্টার্ন ডাক্তারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে ইন্টার্ন ডাক্তাররা।

স্টাফ রিপোর্টার, ময়মনসিংহ থেকে জানান, বগুড়া মেডিকেলের চার ইন্টার্ন চিকিৎসকের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার এবং সর্বস্তরের চিকিৎসকদের নিরাপদ কর্মস্থল চাই এই স্লোগানে ময়মনসিংহে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা কর্মবিরতি, মৌন মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। ময়মনসিংহের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের উদ্যোগে বগুড়া মেডিকেলের চার ইন্টার্ন চিকিৎসকের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার এবং সর্বস্তরের চিকিৎসকদের নিরাপদ কর্মস্থল চাই দাবিতে রোববার দুপুরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ক্যাম্পাসে মৌন মিছিল ও ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। মানববন্ধন কর্মসূচি চলাকালে বক্তারা বলেন- বগুড়া মেডিকেলের চার ইন্টার্ন চিকিৎসকের শাস্তি প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতির ফলে হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত ও রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বগুড়া মেডিকেলের চার ইন্টার্ন চিকিৎসকের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা গতকাল থেকে কর্মবিরতি অব্যাহত রেখেছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=56244