মেহেদী হাসান শিশির
৬ মার্চ ২০১৭, সোমবার, ৪:৪৬

রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতির যত কীর্তি

দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গায়ে মাইকের ব্যাটারির এসিড ছুড়ে দেয়া, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, শিক্ষিকা ও শিক্ষককে লাঞ্ছনা, ছাত্রী যৌন হয়রানি, ভর্তিবাণিজ্যের টাকা বাটোয়ারা, ফাও খাওয়া, ছাত্রী হলে জোর করে ঢোকাসহ বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে আলোচিত রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ (শনিবার স্থগিতকৃত) সভাপতি মেহেদী হাসান শিশিরের ছাত্রত্বও বাতিল হয়েছে। পরীক্ষায় ধারাবাহিকভাবে অকৃতকার্য হওয়ার কারণে তার ছাত্রত্ব বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে তার হিসাবের খাতায় যোগ হয়েছে নানা অপরাধের তকমা। সর্বশেষ এক লাখ টাকা চাঁদা না দেয়ায় একটি কনফেকশনারির দোকানে হামলা ভাঙচুর ও লুটপাট করা নিয়ে ব্যবসায়ী ও তার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে রক্তাক্ত হয়েছে উত্তরের উচ্চশিক্ষার এই পাদপিঠ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার দফতর সূত্র বলছে, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যাচে (২০০৮-০৯) শিক্ষাবর্ষের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন মেহেদী হাসান শিশির। শিশির সেমিস্টার ড্রপ দিতে দিতে সর্বশেষ ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের সাথে ৪র্থ বর্ষের ১ম সেমিস্টার পরীক্ষা দেন। ওই পরীক্ষার ফলাফলে শিশির ‘নট প্রমোটেড’ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থীকে ছয় বছরের মধ্যে তার কোর্স শেষ করতে হয়। কিন্তু ইতোমধ্যেই তার ৬ বছর শেষ হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাস করতে না পারায় গত বছর তার ছাত্রত্ব বাতিল করে কর্তৃপক্ষ।

তবে ছাত্রলীগের তকমা থাকায় ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে ভিসির কাছে আবেদন করেছিলেন শিশির। ভিসি বিষয়টি অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে উত্থাপন করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ÔRules & Regulations for four years Bachelor's Degree Program (Semester System)Õ এর আলোকে আবেদনটিও বাতিল করা হয়। এর ফলে মেহেদী হাসান শিশিরের পরীক্ষা দেয়ার সব সুযোগ নষ্ট হয়। গত বছর অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের এক সভার সিদ্ধান্তে বলা হয়, ওই সভায় মেহেদী হাসান শিশিরের ব্যাপারে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্টের ৩.৩(ব) অনুসরণে ছয়টি অ্যাকাডেমিক বছরের মধ্যে তার অনার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করতে হবে। শিশিরের ক্ষেত্রে তা অতিক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের রুলসের ১৭(ব) অনুসরণে কন্টিনিউয়াস অ্যাসেসমেন্টে মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেয়ার সুযোগও নেই শিশিরের। অন্য দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রুলসের ১৭(ধ) ধারা অনুসরণে একজন শিক্ষার্থীর সর্বোচ্চ তিনটি কোর্সের মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু শিশির চারটি কোর্সে ‘এফ’ পায়। রুলস অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট সেমিস্টারে উত্তীর্ণের জন্য এসজিপিএ ন্যূনতম ২.২৫ পেতে হবে। কিন্তু শিশির সংশ্লিষ্ট সেমিস্টারে ০.৪০ পায়। এ ছাড়াও রুলসে ন্যূনতম সিজিপিএ ২.২৫ পাওয়ার বিধান থাকলেও শিশির পায় ২.২০৪।

রেজিস্টার দফতর সূত্র জানায়, এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রুলসের আলোকে তার ছাত্রত্ব নিয়মানুযায়ী বাতিল হয়ে গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. এ কে এম নূর-উন-নবী জানান, আমার কাছে শিশিরের আবেদন এসেছিল। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠকে তা গ্রহণ করা হয়নি। শিশিরের ছাত্রত্ব অটো বাতিল হয়ে গেছে। তার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নেবে। আর অন্য যারা ক্যাম্পাসের বাইরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে তাদের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সূত্র জানায়, ছাত্রলীগ সভাপতি মেহেদী হাসান শিশির বর্তমানে শহীদ মোখতার এলাহী হলের ৬০৭ নম্বর রুমের আবাসিক ছাত্র। ছাত্রত্ব না থাকায় নিয়মানুযায়ী তার হলের সিটও বাতিল হওয়ার কথা। কিন্তু এখনো সেই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। বরং সেই রুমে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় এবং আশপাশের এলাকায় তার সমর্থকদের নিয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করে যাওয়ার ধারাবাহিক অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

সূত্র জানায়, ২০১২ সালে ইংরেজি বিভাগের ছাত্র মেহেদী হাসান শিশির রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি হন। এর পরই তার নেতৃত্বে একটি সঙ্ঘবদ্ধ সন্ত্রাসী চক্র গড়ে ওঠে ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায়। ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে সাবেক ভিসি ড. মুহাম্মদ জলিল মিয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর মেহেদী হাসান শিশিরের নেতৃত্বে মাইকের ব্যাটারির এসিড ছুড়ে মারা হয়। সেই সময়ে বর্তমান শিক্ষক সমিতির সভাপতি তুহিন ওয়াদুদ শিশিরসহ ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। শিক্ষক-ছাত্রলীগ সমঝোতার মাধ্যমে চলতি বছর ১১ জুন ছাত্রলীগ নেতাদের খালাস দেন আদালত। পছন্দের প্রার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে নিয়োগের দাবিতে ২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি শিশিরের নেতৃত্বে সংস্থাপন শাখায় ভাঙচুর চালিয়ে তছনছ করা হয়। একই সালের ২০ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি শিশিরের সাথে সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের তুমুল সংঘর্ষ হয়। একই সালের ২৬ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে শিশিরের নেতৃত্বে জোর করে ঢুকে নিজেদের নারী নেত্রীদের জোর করে হলে তুলে দিয়ে হইচই বাধিয়ে দেন।

২০১৫ সালের ১৯ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতির নেতৃত্বে কর্মকর্তাদের সাথে সংঘর্ষ হয়। একই সালের ৫ মে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে মেহেদী হাসান শিশির গ্রুপও সহসভাপতি মোহাম্মদ আলী রাজ গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

একই সালের ২৪ আগস্ট কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি করে শিশিরের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় ছাত্রীটি মামলা করেন কোতোয়ালি থানায়।

২০১৬ সালের ৬ জুন সিনিয়ররিটি-জুনিয়ররিটি নিয়ে সভাপতি মেহেদী হাসান শিশির ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মাহমুদের কর্মীদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। চলতি বছর ২০ ফেব্রুয়ারি ডাইনিংয়ে ফ্রি খাওয়া নিয়ে শিশির ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মাহমুদ গ্রুপের মধ্যে ফের সংঘর্ষ হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগ সভাপতি মেহেদী হাসান শিশিরের ইয়াবা সেবনের ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে নির্মাণাধীন হলের প্রাথমিক কাজও তার চাঁদা দাবির কারণে বন্ধ ছিল কয়েক দিন। ক্যাম্পাসের সামনে জয়িতা স্যানিটেশনের একটি যাত্রীছাউনি নির্মাণের সময়ও চাঁদার দাবিতে কাজ বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। সর্বশেষ শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন পার্কের মোড়ে রিফা কনফেকশনারির মালিকের কাছে এক লাখ টাকা চাঁদা না পাওয়ায় কনফেকশনারিটিতে হামলা চালিয়ে লুটপাট করা এবং বিকেলে ব্যবসায়ীদের সমাবেশে হামলার পর সংঘর্ষের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, পরীক্ষায় ধারাবাহিকভাবে অকৃতকার্য হওয়ার কারণে তার ছাত্রত্বও বাতিল করা হয়েছে গত বছর।

ব্যবস্থা গ্রহণ : সংগঠনবিরোধী কাজের অভিযোগে ২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সহসভাপতি রোকনুজ্জামান রোকন ও মোহাম্মদ আলী রাজ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তিতাস চন্দ্র রায় ও রাজীব মণ্ডলের সদস্যপদ স্থগিত করা হয় এবং তাদের বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রে চিঠি দেয়া হয়। এ ছাড়াও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দফতর সম্পাদক দেলোয়ার শাহজাদা স্বাক্ষরিত এত চিঠিতে গত শনিবার বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের মূল কমিটি স্থগিত করা হয়।

রংপুর মহানগরীর মোড় বনানীপাড়া এলাকার বাসিন্দা ছাত্রলীগ সভাপতি মেহেদী হাসান শিশির। এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, মেধাবী ছাত্র ছিল শিশির। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে রাজনীতির গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে দিয়ে এখন সে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনাসহ পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। এ নিয়ে তার পরিবারের মধ্যেও তীব্র ক্ষোভ রয়েছে।
রংপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান রনি জানান, কেন্দ্রীয় নেতা রংপুরের পথে আছেন। তারা আসার পর এ বিষয়ে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেয়া হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/201255