মাছ মরেছে, বিক্ষোভ মিছিল করেছে হরিণধরার বাসিন্দারা
২৯ ডিসেম্বর ২০১৬, বৃহস্পতিবার, ১২:০৭

লবণাক্ত পানি ফেলা হচ্ছে ধলেশ্বরীতে: লবণ শোধনাগার ছাড়াই সাভারে চামড়া শিল্পনগর

সাভারে চামড়া শিল্পনগরে প্রায় ৬৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বর্জ্য পরিশোধনব্যবস্থায় চামড়ার বর্জ্যের লবণ পরিশোধনের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে চামড়ার বর্জ্য পরিশোধনের পর যে পানি ধলেশ্বরী নদীতে ফেলা হচ্ছে, তা লবণাক্ত। এলাকাবাসী বলেছে, লবণাক্ত পানি নদীতে ফেলায় মাছ মরে ভেসে উঠছে। এ নিয়ে প্রকল্প এলাকায় মিছিলও করেছে স্থানীয় বাসিন্দারা।
পশু জবাইয়ের পর পচন রোধে প্রাথমিকভাবে একটি চামড়ায় আকারভেদে চার থেকে ছয় কেজি লবণ ব্যবহার করা হয়। পরে ট্যানারিতে চামড়া পরিশোধনের পর্যায়ে আরও দুই দফা লবণ ব্যবহার করা হয়। সাভারের চামড়া শিল্পনগরে চালু হওয়া প্রায় ৩৪টি ট্যানারির লবণ ও বর্জ্যযুক্ত পানি কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারে (সিইটিপি) যাচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন রাসায়নিক ও অন্যান্য বর্জ্য পরিশোধন করা হলেও পানিতে লবণ থেকে যাচ্ছে। পাইপ দিয়ে সেই পানি পড়ছে সরাসরি ধলেশ্বরী নদীতে।
গতকাল বুধবার সরেজমিনে চামড়া শিল্পনগরে গিয়ে লবণযুক্ত পানি নদীতে পড়তে দেখা যায়। এলাকাবাসী বলেছে, ঈদুল আজহার পর যখন ট্যানারিগুলো বেশি পরিমাণে বর্জ্য উৎপাদন করেছে এবং বেশি পরিমাণে পানি নদীতে ফেলা হয়েছে, তখন অনেক মাছ মরে ভেসে ওঠে। অবশ্য এখন পানি পড়ছে আগের চেয়ে কম পরিমাণে। কারণ, ট্যানারিগুলোতে কাজের চাপ অনেকটাই কম।
চামড়া শিল্পনগরের প্রকল্প কার্যালয় লবণ পরিশোধনের ব্যবস্থা না থাকার কথা স্বীকার করেছে। প্রকল্পের পরিচালক আবদুল কাইউম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ট্যানারির মালিকদের বলেছি চামড়া ড্রামে দেওয়ার আগে লবণ ঝেড়ে নিতে। এ জন্য প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে।’ এ ছাড়া লবণ পরিশোধনের জন্য ৫০০ কোটি টাকার একটি পরিশোধন প্ল্যান্ট করার চিন্তা চলছে বলে তিনি জানান।
অবশ্য সিইটিপি নির্মাণ পরামর্শক দলের প্রধান ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন দরপত্র চূড়ান্ত হয়, তখন আমরা এ বিষয়ে বলেছিলাম। কিন্তু বাজেটে কুলাবে না বলে লবণ পরিশোধনের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। লবণাক্ততা দূর করার ব্যবস্থা থাকলে এ পানি আবার ব্যবহার করা যেত।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্পসচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘এগুলো করা হবে। আমি তো বলে দিয়েছি পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী পরিশোধন করে পানি ফেলতে যা করা দরকার, সেটাই যেন করে। আমি চীনাদের ডেকেছি, তারা শিগগিরই চীন থেকে আসবে। এসব বিষয় ফয়সালা করব।’ এর ভেতরে লবণ পরিশোধনের বিষয়টি থাকবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব সব। এমন কিছু ওইখানে যাবে না, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আগে কী আছে, না আছে তা বিবেচ্য নয়। এখন আমাদের যেটা প্রয়োজন, সেটা ওদের দিয়ে করাব।’
পরিবেশদূষণের কারণে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ১৫৪টি ট্যানারি পরিকল্পিত একটি শিল্পনগরে নিতে ২০০৩ সালে প্রকল্প নেয় সরকার। সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরা গ্রামে ধলেশ্বরী নদীর পাশে প্রায় ১৯৯ একর জমিতে শুরু হয় চামড়া শিল্পনগর গড়ে তোলার কাজ। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। মালিকদের গড়িমসি ও সময়মতো সরকারের সিইটিপি নির্মাণের গাফিলতির কারণে গত ১৩ বছরেও ট্যানারিগুলোকে সাভারে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এখন সরকার সিইটিপি চালানোর উপযোগী করেছে, তবে মাত্র ৩৪টি ট্যানারি সেখানে চালু করার মতো অবস্থায় আছে। বেশির ভাগ ট্যানারি এখন পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া জমিতে ভবনই নির্মাণ করতে পারেনি। যেসব ট্যানারির মালিক সাভারে যেতে পারেননি, তাঁদের দিনে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা গুনতে হচ্ছে।
শিল্প মন্ত্রণালয় বলেছে, চলতি ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ট্যানারিগুলো হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরের কাজ শেষ হবে। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোও ডিসেম্বরের পরে হাজারীবাগে ট্যানারি চলতে না দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে।
চামড়া শিল্পনগর প্রকল্পের সর্বশেষ অনুমোদিত ব্যয় প্রায় ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা, যার মধ্যে প্রায় ৬৩৯ কোটি টাকা দিয়ে সিইটিপি, ডাম্পিং ইয়ার্ড (শুকনো বর্জ্য ফেলার জায়গা), সুয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি), বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কেন্দ্র ও শক্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (এসডব্লিউএমএস) নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে বর্জ্যের লবণ পরিশোধনের ব্যবস্থা নেই।
চামড়া শিল্পনগর প্রকল্প কার্যালয় এবং এ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশের কোনো সংস্থার এ ধরনের সিইটিপি নির্মাণের অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রথমে একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান সিইটিপির প্রাথমিক কিছু নথিগত কাজ করে। পরে এর আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। সেই দরপত্রে অংশ নিয়ে চীনা প্রতিষ্ঠান জিনসু লিংঝি এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন কোম্পানি কাজ পায়। তারাই এ প্রকল্পের নকশাসহ অন্য সবকিছু করেছে। সরকারের একটি কমিটি এর অনুমোদন দিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক আবদুল কাইউম বলেন, ‘এ ধরনের প্রকল্পের অভিজ্ঞতা কারোরই ছিল না। আমরা জানতামই না লবণ পরিশোধনের ব্যবস্থা দরকার। অবশ্য প্রকল্পের নকশা ও দরপত্র হয়েছে অনেক বছর আগে। তখন এ প্রকল্পের সঙ্গে আমরা ছিলাম না।’
চামড়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাঁচা চামড়ায় যখন লবণ দেওয়া হয়, তা অনেকটা গলে যায়। কিছু লবণ ঝেড়ে ফেলা যায়। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো লাভ হবে না, কারণ চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের দুটি পর্যায়েও (সোকিং ও পিকলিং) লবণ ব্যবহার করা হয়। এই দুই পর্যায়ে প্রতিটি চামড়ায় দুই থেকে তিন কেজি লবণ লাগে। ফলে পরিশোধনব্যবস্থা না থাকলে নদীতে যে পানি ফেলা হবে, তার সঙ্গে লবণ থাকবেই।
সিইটিপির পরামর্শক দলের প্রধান দেলোয়ার হোসেন বলেন, বর্জ্য শোধনের পর এই পানিতে লবণের মাত্রা থাকে প্রতি লিটারে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার মিলিগ্রাম।
এ মাত্রার লবণাক্ত পানি নদীতে ফেলা হলে প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে জানতে চাইলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণভাবে মিঠাপানিতে ১০ মিলিগ্রাম মাত্রার লবণাক্ত পানি ফেললে তা সহনীয় বলা যায়। সেখানে ১০ হাজার মিলিগ্রাম অতি উচ্চমাত্রা। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে চলতে থাকলে নদীটি লবণাক্ত পানির নদীতে পরিণত হতে পারে। তিনি বলেন, এ পানি যতটুকু জায়গায় ছড়িয়ে যাবে, ততটুকু জায়গায় মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী বাঁচবে না। লবণাক্ত পানি কতটুকু ছড়িয়ে পড়ছে, তা নিয়ে গবেষণা হলে বিস্তারিত প্রভাব বোঝা যাবে।
স্থানীয় বাসিন্দা দোকানমালিক মো. মাসুদ বলেন, মাস দেড়েক আগে একসঙ্গে প্রচুর পানি নদীতে ফেলা হয়েছে। তখন প্রচুর মাছ মরেছে। তিনি নিজেও বাইন মাছ ও চিংড়ি ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি গিয়ে দেখি, প্রচুর ছোট চিংড়ি নদীর কিনারে এসে মরার মতো পড়ে রয়েছে। খাবলা দিয়ে আমি সেই চিংড়ি ধরেছি। পরে এত মাছ মরতে দেখে এলাকাবাসী বিক্ষোভ মিছিল করে।’
লবণাক্ততা ঠেকাতে সরকারের ভরসা এখন চামড়া ঝাড়া, ট্যানারির মালিকদের সচেতনতা ও নদীতে পর্যাপ্ত পানির প্রবাহ থাকা।
সিইটিপির পরামর্শক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ট্যানারির শ্রমিকেরা চামড়াটাকে ঝাড়া দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করলে লবণের মাত্রা কমবে। এরপর নদীতে পানির প্রবাহ থাকলে বিশেষ কোনো ক্ষতি হবে না। তবে উচ্চমাত্রায় লবণাক্ত পানি নদীতে ফেলা হলে ফসলের ক্ষতি হতে পারে। এতে ট্যানারির মালিকদের সচেতনতা দরকার।
প্রক্রিয়াজাতকরণের দুই পর্যায়ে লবণ ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘ওই লবণটা তো ক্রোমিয়ামযুক্ত পানির সঙ্গে থাকে। সেটা আমরা আলাদা করে নিয়েই নিচ্ছি।’
তবে রিলায়েন্স ট্যানারির লেদার টেকনোলজিস্ট সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, ক্রোমিয়াম ব্যবহারের আগেই তিন পর্যায়ে লবণ ব্যবহার করা হয়। সেই লবণ ক্রোমিয়ামযুক্ত পানির সঙ্গে নয়, সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে সিইটিপিতে যায়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ট্যানারি শিল্পকে সাভারে সম্পূর্ণ পরিবেশসম্মত উপায়ে চালু করতে হবে। নইলে চারটি নদী ধ্বংস হবে। যদি সাভারে ট্যানারি শিল্প সম্পূর্ণ পরিবেশসম্মত না হয়, তাহলে যাঁর দায়িত্ব তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে। তবে চলতি মাসের পর হাজারীবাগে ট্যানারি চলতে দেওয়া যাবে না।
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1048593/%E0%A6%B2%E0%A6%AC%E0%A6%A3-%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%BE%E0%A6%A7%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A6%87-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E2%80%8B%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%9C%E0%A6%BE-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA